সর্বোচ্চ আদালত
সর্বোচ্চ আদালত

গ্রেফতারের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুসরণের নির্দেশ

আসামি গ্রেফতার করতে হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সংবিধানের ৩২নং অনুচ্ছেদ কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে বলে রায় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আদালত বলেন, ‘এখন থেকে যে কাউকে গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ মানতে হবে।’

উল্লেখ্য, সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে রয়েছে ‘জীবন ও ব্যক্তির স্বাধীনতা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না।’

কাউকে গ্রেফতার করতে হলে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে উল্লেখ করে আগাম জামিনের ক্ষেত্রে সর্বমোট ১৬ দফা নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট। পাশাপাশি হত্যা, ধর্ষণ ও ডাকাতির মামলায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে জামিন না দেওয়াসহ ১৬ দফা নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি ৮ সপ্তাহের বেশি আগাম জামিন না দিতেও নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।

হাইকোর্ট বিভাগের উদ্দেশে আপিল বিভাগ বলেন, ‘হাইকোর্টকে এফআইআর সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আসামি যেন কোনও সাক্ষীকে ভয় ভীতি দেখাতে না পারে, সে বিষয়টি আগাম জামিনের শর্ত হিসেবে জুড়ে দিতে হবে। কাউকে অনির্দিষ্টকালের জন্য জামিন দেওয়া যাবে না।’

আগাম জামিন নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ৩১ জনকে হাইকোর্টের দেয়া আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনাসহ এই রায় দিয়েছেন।

দেশের উচ্চ আদালতে আগাম জামিন বিষয়ে নতুন নীতিমালা করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আগের নীতিমালায় এ নিয়ে হাইকোর্টের প্রতি সাতদফা নির্দেশনা থাকলেও এবার তা বাড়িয়ে ১৬ দফা করা হয়েছে।

যেকোনো মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আগাম জামিনের জন্য হাইকোর্টে আসেন বেশিরভাগ আসামি। তেমনি রাজধানীর হাতিরঝিল থানার নাশকতার মামলায় গত বছরের ৩ অক্টোবর পুলিশের প্রতিবেদন (রিপোর্ট) না দেয়া পর্যন্ত মির্জা ফখরুলসহ বিএনপির শীর্ষ নেতাদের জামিন দেন হাইকোর্ট।

সেই আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল নিষ্পত্তি করে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ জানান তারা এর রায়ে কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরবেন।

গত ৭ আগস্ট সেই রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করেন আপিল বিভাগ। রায়ে আগাম জামিনের ক্ষেত্রে নতুন করে ১৬ টি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নতুন করে ব্যাখ্যা এসেছে সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে এখন থেকে যে কাউকে গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে ৩২ অনুচ্ছেদ মেনে চলতে হবে।

১৬টি নীতিমালার মূল হলো আট সপ্তাহের বেশি আগাম জামিন দিতে পারবেন না হাইকোর্ট। হত্যা ডাকাতি, ধর্ষণ এসব ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে কখনোই আগাম জামিন দেয়া যাবে না। সেইসঙ্গে আগাম জামিনের অপব্যবহার করলে তা বাতিল চাইতে পারবে রাষ্ট্রপক্ষ।

১৬টি নীতিমালা হলো-:

  • হাইকোর্টকে এফআইআর সূক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
  • অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনা করতে হবে।
  • আগাম জামিন দিলে পলাতক হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না।
  • চরিত্র আচার আচরণ বিবেচনায় নিতে হবে।
  • গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তি অপদস্থ সম্ভাবনা আছে কি না তা দেখতে হবে।
  • কেউ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটাও খেয়াল রাখতে হবে।
  • আগামী জামিন ব্যতিক্রম ক্ষমতা এ ক্ষমতা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।
  • কোনো সাক্ষীকে ভয় ভীতি দেখাতে না পারে আগাম জামিনের ক্ষেত্রে এমন শর্ত জুড়ে দিতে হবে।
  • জামিন দেয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
  • হত্যা ও ধর্ষণে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে কেউ জামিন পাবে না।
  • আমাদের আইনে এক সময় ৪৯৭ (ক) কিন্তু সেটা বাতিল হয়েছে।
  • অনির্দিষ্টকালের জন্য আগাম জামিন দেয়া যাবে না। এটা তদন্ত ব্যাঘাত ঘটায়।
  • আগাম জামিনের ক্ষেত্রে তদন্তের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
  • আগাম জামিনের পর তদন্ত কর্মকর্তাকে সহযোগিতা করতে হবে।
  • ৮ সপ্তাহের বেশি আগাম জামিন নয়।
  • আগাম জামিনের অপব্যবহার করলেই তা বাতিল চাইতে পারবে রাষ্ট্রপক্ষ।

তবে, এ রায় আপিল বিভাগ একরাশ হতাশা প্রকাশ করে রায়ে উল্লেখ করেছেন ২০ বছর আগে সরকারকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল, যেন আগাম জামিনের বিষয়ে আইন করে আইন কমিশন। কিন্তু সে বিষয়ে কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি।

অন্যদিকে, এ রায় নিম্ন আদালতে যাওয়ার ২ সপ্তাহের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে মির্জা ফখরুল, মির্জা আব্বাস, মওদুদ আহমদ, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনসহ সংশ্লিষ্টদেরকে।

এর ফলে উচ্চ আদালতে আগাম জামিন পাওয়া আগের চেয়ে কিছুটা সহজ হবে বলে মনে করছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা।

বিএনপি নেতাদের পক্ষের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন আপিল বিভাগের নতুন নির্দেশনার বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত ছিল চার সপ্তাহের বেশি জামিন দেয়া যাবে না। জনস্বার্থে ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হওয়া দরকার ছিল। আপিল বিভাগের নতুন নির্দেশনায় তার প্রতিফলন ঘটেছে।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান বলেন, সংবিধানের ১১১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই রায় হাইকোর্ট ও সব নিম্ন আদালতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে নিম্ন আদালতে কেউ আগাম জামিনের জন্য যায় না। সবাই হাইকোর্টে আগাম জামিনের আবেদন করে থাকে। সেকারণে কার্যত হাইকোর্টের ক্ষেত্রেই এই নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে।

বিএনপির আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, যদিও বিএনপি নেতাদের মামলা ঘিরে এমন নির্দেশনা দিলেন আপিল বিভাগ। তবে, আমরা আশা করছি, এই নীতিমালা যেন সবারক্ষত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য হয়।