জামিন জালিয়াতি

জামিন জালিয়াতিতে জড়িত কিছু অসাধু আইনজীবী ও আদালতের কর্মচারী

চট্টগ্রামের সদরঘাট থানা পুলিশ ২০১৭ সালের ১৮ আগস্ট নব্বই হাজার পিস ইয়াবাসহ আহম্মেদ নুর ও মোহাম্মদ রাসেল নামে দু’জনকে গ্রেফতার করে। আইনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তাদের বিরুদ্ধে বিচারিক আদালতে বিচার শুরু হয়। সুপ্রীমকোর্টের একটি অসাধু চক্র এদের সঙ্গে জেলখানায় যোগাযোগ করে। অর্থের বিনিময়ে ভুয়া জামিন আদেশে চক্রটি দুই আসামিকে কারাগার থেকে বের করে আনে। পরবর্তীতে বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালতকে আসামিদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়।

অন্যদিকে ঢাকা জজ কোর্টের উমেদার (দৈনিক ভিত্তিতে বেতন) মোঃ ইসমাইল হোসেনসহ ৫ জন মিলে বিচারাধীন ৭৬টি দায়রা ও বিশেষ মামলার ১০৬ আসামিকে জাল জামিনের মাধ্যমে জেল থেকে মুক্ত করার আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ হয়। ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ৭ জুন পর্যন্ত বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে চক্রটি ভুয়া জামিননামার মাধ্যমে এসব আসামির জামিন করানোর চেষ্টা করে। শুধু তাই নয়, জাল আদেশবলে একটি পাসপোর্ট ও একটি মোটরসাইকেল জিম্মায় দেয়ারও ব্যবস্থা করে। ঘটনাটি জানার পর ঢাকা মহানগর দায়রা জজের নির্দেশে নাজির উবাইদুল করিম আকন্দ কোতোয়ালি থানায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এর পর দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকেও মামলা দায়ের করা হয়। সাক্ষ্য-প্রমাণ উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ২০১৭ সালের ২২ মার্চ বিশেষ জজ আখতারুজ্জামান আসামিদের প্রত্যেককে দন্ডবিধির ৪৬৬ ও ৪৭১ ধারায় ৭ বছর করে মোট ১৪ বছরের সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করেন। একই সঙ্গে ১০ হাজার করে মোট ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। চক্রটির মধ্য উমেদার ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে রয়েছে মোসলেম উদ্দিন ভুইয়া (বেঞ্চ সহকারী), শেখ নাঈম (এমএলএসএস), আলমগীর হোসেন (উমেদার) ও জাহাঙ্গীর। এদেরকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।

এমন জামিন জালিয়াতির ঘটনা বিচারিক ও উচ্চ আদালতে ঘটছে অহরহ। ইতোমধ্যে সুপ্রীমকোর্টের দুজন স্টাফকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ঢাকা সিএমএম কোর্টসহ বিভিন্ন আদালতে ২০টির মতো মামলা বিচারাধীন। যার কোনটা সাক্ষী শেষ পর্যায়ে আবার কোনটার সাক্ষী চলছে। শীঘ্রই বেশ কিছু রায় ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে। সুপ্রীমকোর্টের তদন্ত কমিটি জামিন জালিয়াতি রোধে ১৩ দফা সুপারিশ করেছে। সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে, জামিন জালিয়াতি আগের চেয়ে অনেকাংশে কমলেও চক্রটি উচ্চ আদালতসহ বিভিন্ন বিচারিক আদালতে সক্রিয়। তারা মামলার প্রকৃত তথ্য গোপন রেখে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে জামিন নিয়ে আদালতকে বিভ্রান্ত করছে। এতে জঙ্গী তৎপরতা, খুন, ডাকাতি ও মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত ভয়ঙ্কর আসামিরা ভুয়া জামিননামায় চম্পট দিচ্ছে। এই জালিয়াতির ঘটনায় মামলা শুনানির পর্যায়ে আদালত বলেছে, আদালতে জামিন জালিয়াতির ঘটনা বেড়েই চলেছে। এই জালিয়াতিতে একশ্রেণীর কর্মচারীর সঙ্গে কিছু অসাধু আইনজীবীও জড়িত। জামিন জালিয়াতির হাত থেকে এই কোর্টকে রক্ষা করতে হবে। এজন্য আইনজীবীসহ সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।

৭৬ মামলায় জালিয়াতির প্রধান আসামি ইসমাইল হোসেনের ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারার জবানবন্দীতে উঠে এসেছে ভয়াবহ চিত্র। জবানবন্দীতে ইসমাইল জানায়, ২০০৮ সাল থেকে অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে সে উমেদার হিসেবে কর্মরত ছিল। দৈনিক ভিত্তিতে বেতন পায়। ইসমাইল ও পিয়ন নাঈম পেশকার মোসলেহ উদ্দিনের কথায় কাজ করত। বিভিন্ন জামিননামায় মাঝে মাঝে ভুয়া স্মারক নম্বর দিত। পিয়ন নাঈম জামিননামাগুলো তাকে সরবরাহ করত এবং স্মারক নম্বরগুলো সে বলে দিত। এসব জামিননামা রেজিস্ট্রারে এন্ট্রি করা হয়নি। নাঈম তাকে বলত চাকরি করতে হলে সে যা বলবে তাকে তাই লিখতে হবে। নাঈম আরও বলত, তোরা তো অফিসের কেউ না। বিষয়টি পেশকারকে বললে সে বলত-নাঈমের কথামতো কাজ করবে। তার কথামতো আমি ভুয়া স্মারক নম্বরগুলো বসিয়েছি। আমরা সবাই মিলে এসব কাজ করেছি।

এ মামলায় হাইকোর্টে রাষ্ট্রপক্ষের ডিএজি একেএম আমিনউদ্দিন মানিক গণমাধ্যমকে বলেছেন, যারা পলাতক আছে তারা আপীল করেনি। অন্যরা আপীল করেছে। আপীল শুনানি হয়েছে। এখন আবার শুনানি হবে। আমি মনে করি, এ ধরনের অপরাধ যারা করে তাদের কঠোর শাস্তি দেয়া উচিত। যাতে অন্যরা আর এমন জালিয়াতি করতে সাহস না পায়।

বিশেষ জজ আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, তর্কিত ৭৬টি মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায় মামলাগুলোর জামিননামা ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে কর্মরত এ্যাডভোকেটগণের মধ্য থেকেই দাখিল করা হয়েছে। বেলবন্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়- এ্যাডভোকেটগণের অধিকাংশই তাদের রেজিস্ট্রেশন নম্বর দাখিল করেননি। এই পাঁচ আসামি ভুয়া জামিননামা তৈরি করে আদালতের বিচারকদের অজ্ঞাতসারে পরস্পর অন্যায়ভাবে লাভবান হবার লক্ষ্যে আসামিদের জেলহাজত থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করে। এরা আদালতের নথি জাল করে ভুয়া জামিননামার মাধ্যমে আসামিদের মুক্তির ব্যবস্থা করে সংশ্লিষ্ট আদালতের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।

জামিন জালিয়াতি প্রসঙ্গে সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল জাকির হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, যারা এ সমস্ত জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সুপ্রীমকোর্টের বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়ার পর জামিন জালিয়াতি অনেকাংশে কমে গেছে।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেছেন, এগুলো ভয়াবহ জালিয়াতি। আসামি জাল কাগজ দিয়ে যেভাবে জামিন হাসিল করেছে, সেটা গুরুতর অপরাধ। এর সঙ্গে হয়ত বা কিছু অসাধু আইনজীবী ও আদালতের কিছু স্টাফ জড়িত রয়েছেন। কিছু কিছু আইনজীবী মিথ্যা তথ্য দিয়ে, তথ্য গোপন করে আসামির জামিন করান। তাদের ব্যাপারে আদালত যদি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ না নেন, সনদ বাতিল বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না করেন, তা হলে এ ধরনের ঘটনা কমবে না। পাশাপাশি আদালতের যে সমস্ত অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

উচ্চ আদালতে জালিয়াতির মূল হোতা মঞ্জু রানী বরখাস্ত
নব্বই হাজার পিস ইয়াবা মামলায় সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন তদন্ত করে দেখতে পায় জাল জামিন আদেশ তৈরির ক্ষেত্রে হাইকোর্টের ফৌজদারি বিবিধ শাখার ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। তদন্তে আরও বেরিয়ে আসে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী, আইনজীবীর সহকারী, সংশ্লিষ্ট সাক্ষী ও অন্যান্য ব্যক্তিও দায়ী। জামিন আদেশের কপি জালিয়াতির মূল হোতা ফৌজদারি মিস শাখার জমাদার মঞ্জু রানী কৈরীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি ও বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। ফৌজদারি মিস শাখার অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত অনুবাদক মশিউর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গত ১০ জুলাই একটি মামলায় আসামিকে জামিন করিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতির কারণে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে তার বন্ধু মুদ্রাক্ষরিক তথা অফিস সহকারী মেহেদী হাসানের কাছ থেকে একটি মামলার কাগজপত্র গ্রহণ করে আসামি সোহেল মোল্লার জামিনের দায়িত্ব নেয়। একই সঙ্গে সোহেল মোল্লার মামা নুরুজ্জামান হাওলাদারের সঙ্গে কথোপকথনের প্রমাণ পাওয়া যায়। শুধু তাই নয় সে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে ১৫ হাজার টাকা লেনদেন করেছে। সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপীল ) বিধিমালা ১৯৮৩ এর ২(২) সংশোধিত প্রজ্ঞাপন ১০৮৯ এর ২(৪) বিধি অনুযায়ী তা অসদাচরণের শামিল। ওই বিধিমালার ৩(বি) বিধি মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় ৯ জুলাই থেকে ওই বিধিমালার ১০(১) বিধি অনুয়ায়ী মশিউর রহমানকে চাকরি হতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

সুপ্রীমকোর্টে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে
সুপ্রীমকোর্টের স্পেশাল অফিসার সাইফুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেছেন, জামিন জালিয়াতি বন্ধে ইতমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সেকশনগুলোতে নজরদারি করা হচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। বিচারপতিদের অর্ডারগুলো অনলাইনে আসছে। যা সরাসরি সেকশনে চলে যাচ্ছে। এছাড়া জামিন জালিয়াতির সঙ্গে সুপ্রীমকোর্টের স্টাফ মঞ্জু রানী কৈরী ও মশিউর রহমানকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি ও বিভাগীয় মামলা চলছে। অপরাধীরা যাতে শাস্তি পায় তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আশা করি, ইতোমধ্যে জালিয়াতির পরিমানটা কমে গেছে। সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন এখন জালজালিয়াতির ঘটনায় বেশ সচেতন বলেই এসব ঘটনা বেশি বেশি ধরা পড়ছে। বিচার বিলম্বের বিষয়টি দূর করতে আমাদের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে জালজালিয়াতির মামলাগুলো মনিটরিং করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আশা করছি শীঘ্রই এসবের বিচার দৃশ্যমান হবে।

অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে
ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক বলেছেন, জামিন জালিয়াতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। এটি একটি মারাত্মক অপরাধ। মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল বিচারাঙ্গন। আর সেখানে এসে জালিয়াতির মধ্যে পড়বে তা কোনভাবে মেনে নেয়া যায় না। আইন অঙ্গনে অবশ্যই এই জালিয়াতি বন্ধ করতে হবে। জামিন জালিয়াতির মামলায় জড়িতদের শাস্তি না হওয়ায়, বিচারিক দীর্ঘসূত্রতার কারণে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ায় এমন ঘটনা থামছে না। এই জালিয়াতির মতো খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, নিম্ন আদালতে জামিন জালিয়াতির ঘটনায় ৫ জনকে সাজা দেয়া হয়েছে। সে মামলা এখন উচ্চ আদালতে আপীল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

জালিয়াতি বন্ধে সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের সুপারিশ
জামিন জালিয়াতি রোধে ১৩ দফা সুপারিশ করেছে কমিটি। সুপারিশে জামিন আবেদনে টেন্ডার নম্বর পড়ার সময় সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর সদস্য নম্বর উল্লেখ রাখা, এফিডেভিট করার সময় তদবিরকারকের ভোটার আইডি কার্ড অথবা জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি সংরক্ষণ করা, ফাইলিং ও এফিডেভিট শাখায় আইনজীবী ও আইনজীবীর সহকারী শনাক্তকরণের লক্ষ্যে ডাটাবেজ তৈরি, জামিন আদেশের কপি প্রস্তুত ও স্বাক্ষর করা এবং বিচারপতিগণের স্বাক্ষর মিলিয়ে দেখার সময় যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা, আদালত থেকে শাখায় মোশন মামলার (জামিন আবেদন) নথিসহ অন্যান্য নথি গ্রহণকারীর একটি প্রাপ্তি রেজিস্টার সংরক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে। সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, শাখায় এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে নথি মুভমেন্টের (প্রেরণ) সময় মুভমেন্ট রেজিস্টারে শুধু এন্ট্রি দেয়া হয় কিন্তু গ্রহণকারীর স্বাক্ষর নেয়া বা রিসিভ দেখানো হয় না। ফলে নথি খোঁজার ক্ষেত্রে গ্রহণকারী অস্বীকার করলে নথি গ্রহণের বিষয়ে তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায় না। কাজেই প্রতিটি মুভমেন্টের ক্ষেত্রেই গ্রহণকারীর স্বাক্ষর রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এছাড়া শাখায় শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও জবাবদিহিতার স্বার্থে শাখার তত্ত্বাবধায়কদের মধ্যে নথিতে স্বাক্ষর করা, নথি রিসিভ করা, টাইপ হওয়া, নথি যথাযথভাবে র‌্যাকে রাখা প্রভৃতি বিষয় তদারকির জন্য সহকারী রেজিস্ট্রার কর্তৃক আলাদা কর্মবণ্টন প্রস্তুত করতে হবে।

জড়িতদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ
গত ২০ মে প্রায় সাত লাখ পিস ইয়াবা আটকের মামলায় জাল নথি দাখিল ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে জামিন হাসিলের চেষ্টা করেছিলেন এক আসামি সালেহ আহম্মেদ ওরফে সালেহ ওরফে বার্মাইয়া সালেহ। মামলার নথিপত্র পর্যালোচনায় হাইকোর্টের নিকট তা উদঘাটিত হয়েছে। এর পর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোঃ মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই আসামির জামিন আবেদন খারিজ করে দেন। একই সঙ্গে মামলার তদবিরকারকসহ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেয়া হয়।

সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল ইউসুফ মাহমুদ মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, নথিতে যে মামলার কথা বলা হয়েছে ওই মামলায় আসামি জামিনে ছিলেন। আসামিপক্ষ থেকে কারাগারে থাকার যে আদেশের অনুলিপি দাখিল করা হয়েছে তা জাল। ফলে আসামির পক্ষে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জামিনের চেষ্টা করা হয়েছে। পরে আদালত মামলার নথি পর্যালোচনা করে জালিয়াতির সত্যতা পান। তাই আসামির জামিন আবেদন খারিজ করে দিয়েছে এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছে।

মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২০ জুন ৬ লাখ ৮০ হাজার পিস ইয়াবা ও নগদ সাত লাখ টাকা উদ্ধার করে র‌্যাব। ওই ঘটনায় পরদিন ফেনী মডেল থানায় ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এই মামলায় কারাগার থেকে জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন আসামি বার্মাইয়া সালেহ। জামিন আবেদনে বলা হয়, আসামি ঘটনার সময় টেকনাফ মডেল থানার একটি মামলায় কারাগারে আটক ছিলেন। ফলে ইয়ারা পাচারের মামলার অভিযোগের সঙ্গে তার কোন সম্পৃক্ততা নেই।

জালিয়াতির কারণে রিকল
চলতি বছরের ২৩ মার্চ নোয়াখালীর সুবর্ণচরের গৃহবধূ গণধর্ষণের মূলহোতা মোঃ রুহুল আমিনের এক বছরের জামিন আদেশ বাতিল করা হয়েছে। এর আগে দেয়া জামিন আদেশ প্রত্যাহার (রিকল) করেছে আদালত। বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি এসএম কুদ্দুস জামানের নেতৃত্বে হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ এ আদেশ প্রদান করেছে। আদালত ৫ দিনের মাথায় জামিন আদেশ প্রত্যাহার করেছে। উল্লেখ্য, আসামি পক্ষের আইনজীবী তথ্য গোপন ও ভিন্ন বেঞ্চে শুনানি করে আসামিকে জামিন করিয়ে নেন। আদেশের পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, রুহুল আমিনের জামিন নজিরবিহীন ঘটনা। যেখানে পুরো জাতি ধর্ষণ মামলার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন এবং ক্ষুব্ধ, সেখানে জামিন হওয়ায় সবাই হতবাক। এটা খুবই ঘৃণ্য তৎপরতা। ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করায় আসামিপক্ষের আইনজীবীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধান বিচারপতির নজরে আনা হবে। আসামি রুহুল আমিনের জামিন নিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের বিভ্রান্ত করেছেন। জামিন আবেদনে এনএক্স-১৭ নম্বর কোর্টের কথা ছিল। ওই কোর্টে না গিয়ে এনএক্স ১৪ নম্বর কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে যায়। যেদিন জামিন হয় সেদিন আসলে রাষ্ট্রপক্ষ বুঝতেই পারেনি জামিন হয়েছে। পরে দেখা যায় রুহুল আমিন জামিন নিয়ে গেছে। গত ১৮ মার্চ হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ আসামিকে রুল জারিসহ এক বছরের অন্তবর্তীকালীন জামিন প্রদান করে। বিষয়টি সেদিন জানাজানি না হলেও ২১ মার্চ সাংবাদিকদের নজরে আসে। এরপর আইনজীবী থেকে শুরু করে সাধারণ জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রুহুল আমিনের জামিন নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে চার সন্তানের জননীর সঙ্গে কয়েক জনের কথাকাটাকাটি হয়। এর জেরে রুহুল আমিনের নির্দেশে ১০-১২ জন তাদের বাড়িতে গিয়ে স্বামী-সন্তানদের বেঁধে ওই নারীকে গণর্ধষণ ও মারধর করে। এ ঘটনায় আসামি রুহুল আমিনকে গ্রেফতার করা হয়। রুহুল আমিন ছাড়া অন্য যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা হলেন- মোঃ সোহেল, বাদশা আলম ওরফে কুড়াইল্যা বাসু, সোহেল, বাদশা আলম, জসিম, বেচু, স্বপন, হাসান আলী বুলু ও ছালাউদ্দিন।

জামিন জালিয়াতি থেকে সুপ্রীমকোর্টকে রক্ষা করতে হবে
হাইকোর্ট বলেছে, সুপ্রীমকোর্টে জামিন জালিয়াতির ঘটনা বেড়েই চলেছে। এই জালিয়াতির সঙ্গে কিছু অসাধু আইনজীবী জড়িত। জামিন জালিয়াতির হাত থেকে এই কোর্টকে রক্ষা করতে হবে। এজন্য আইনজীবীসহ সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। চলতি বছরের ২১ মে জালিয়াতির মাধ্যমে জামিন নেয়ায় খুনের মামলার যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মোয়াজ্জেম হোসেনের জামিন বাতিল করে তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয় আদালত। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি রিয়াজ উদ্দিন খানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই আদেশ দেন। এ সময় আদালত এমন মন্তব্য করে। মাগুরার জোড়া খুনের মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয়েছিল আসামি মোয়াজ্জেম হোসেনের। তিনি বিচারের শুরু থেকে ছিলেন পলাতক। নিম্ন আদালতের রায় ঘোষণার প্রায় ২২ বছর পর ২০১৭ সালে আত্মসমর্পণ করেন এই আসামি। আদালত তাকে কারাগারে পাঠান। সেখান থেকে তিনি সাজার রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করেন। জামিনও চান। চলতি বছরে হাইকোর্ট জামিন না দিয়ে আবেদন খারিজ করে দেন। এরপরই হাইকোর্টের অন্য একটি বেঞ্চে মামলার সব নথি জাল করে জামিন চান। এপ্রিল মাসে হাইকের্টের ওই বেঞ্চ আসামিকে জামিন দেন। পরে মিথ্যা তথ্য ও জাল নথি দাখিল করে জামিন পাওয়ার বিষয়ে তথ্য পান রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সরওয়ার কাজল। এরপরই তিনি নথি পর্যালোচনা করে বিষয়টি বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি রিয়াজ উদ্দিন খানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন। হাইকোর্ট আসামি মোয়াজ্জেমের জামিন বাতিল করে দেন। একই সঙ্গে তাকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করতে মাগুরার পুলিশ সুপার ও সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। আর মোয়াজ্জেমের আইনজীবী জাফর আলী খানকে জালিয়াতির বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলে আদালত।

এদিকে ভুয়া কাগজের মাধ্যমে জালিয়াতি করে জামিন নেয়ায় খুলনার একটি মাদক মামলার তিন আসামির জামিন বাতিল করেছে হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তাদের গ্রেফতার করতে পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ওই জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত তিন আসামিসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। ১৫ জুলাই বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোঃ মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। তিন হাজার পিস ইয়াবাসহ রানা বেপারি, তন্নী বেগম, রানু বেগম ও মোঃ সুমন নামের চারজনকে গ্রেফতার করে খুলনার ডুমুরিয়া পুলিশ। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে গত ৬ মার্চ ডুমুরিয়া থানায় মামলা হয়। এই মামলায় রানা বেপারি, তন্নী বেগম ও রানু বেগম হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেন। ১৭ জুন তাদের ছয়মাসের জামিন দেয় হাইকোর্ট। পরে ওই মামলার অপর আসামি মোঃ সুমনও হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেন। তাতে মামলার মূল এজাহারের কপি দাখিল করা হয়, যেখানে ৩ হাজার পিস ইয়াবা জব্দের তথ্য রয়েছে। এই জামিন আবেদনের ওপর শুনানিকালে আদালত দেখতে পায়, আগে তিনজনের করা জামিন আবেদনের সঙ্গে মামলার যে এজাহার দাখিল করা হয়েছিল তাতে তাদের কাছ থেকে কোন মাদক বা ইয়াবা উদ্ধারের তথ্য নেই। এটা দেখার পরই আদালত আগের জামিন দেয়া তিনজনের জামিন বাতিল করে এবং তাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়। এই তিনজন ছাড়াও তাদের পক্ষে তদবিরকারক আসাদ মোড়ল এবং আইনজীবীর সহকারী আইয়ুব আলীকে মামলার আসামি করতে রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দেয়া হয়। সূত্র : জনকণ্ঠ