বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে কেউকে অপরাধী বলা যাবে না

আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে কেউকে অপরাধী বলা যাবে না বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আদালতে একজন অভিযুক্ত বিচার প্রক্রিয়া শেষে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত না হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে বলা যাবে না যে তিনি প্রকৃত অপরাধী বা তাকে দিয়েই অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে।

বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যায় তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে জামিন মঞ্জুর করে দেওয়া রায়ে এমন পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত ২৯ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) হাইকোর্টের দেওয়া এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি রোববার (০১ সেপ্টেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়।

আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, ইদানিং প্রায়শ লক্ষ্য করা যায় যে, বিভিন্ন আলোচিত অপরাধের তদন্তকালীন সময়ে পুলিশ, র‌্যাবসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তারকৃত অভিযুক্তদের সংশ্লিষ্ট আদালতে হাজির করার আগেই বিভিন্ন গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করা হয়। যা অনেক সময় মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অমর্যাদাকর এবং অ-অনুমোদনযোগ্য এবং বিভিন্ন মামলার তদন্ত সম্পর্কে অতি উৎসাহ নিয়ে গণমাধ্যমের সামনে ব্রিফিং করা হয়ে থাকে। আমাদের সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত আদালতে একজন অভিযুক্ত বিচার প্রক্রিয়া শেষে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত না হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে বলা যাবে না যে তিনি প্রকৃত অপরাধী বা তাকে দিয়েই অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে।

আদালত রায়ে আরও বলেন, গণমাধ্যমের সামনে গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা সংগত নয় যে, তার মর্যাদা ও সম্মানহানী হয় এবং তদন্ত চলাকালে অর্থাৎ পুলিশ রিপোর্ট দাখিলের আগে গণমাধ্যমে গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তি বা মামলার তদন্ত কার্যক্রম সম্পর্কে এমন কোনো বক্তব্য উপস্থাপন সমীচীন নয়, যা তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে বিতর্ক বা প্রশ্ন সৃষ্টি করতে পারে। আমাদের আরো স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, মামলার তদন্ত এবং বিচার পর্যায়ে একজন অভিযুক্তের প্রাপ্ত আইনি অধিকার নিশ্চিত করা সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

উপরোক্ত বিবেচনায় আদালতে সুচিন্তিত অভিমত এই যে, গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের আদালতে উপস্থাপনের আগেই গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন এবং মামলার তদন্ত পর্যায়ে তদন্তের বিষয়ে গণমাধ্যমে কতটুকু প্রকাশ করা সমীচীন হবে সে বিষয়ে অতিদ্রুত একটি নীতিমালা করা বাঞ্ছনীয়। এই নীতিমালা প্রণয়ন ও যথাযথভাবে অনুসরণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ/সুরক্ষা বিভাগের সচিব ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেওয়া হলো।

অন্যদিকে হাইকোর্টের প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে মিন্নির জামিন মঞ্জুরের বিষয়ে বলা হয়-

  • মামলার এজাহারে বর্তমান আসামিকে (মিন্নি) এক নম্বর সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সংবাদদাতা এজাহারে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ঘটনার বিষয়ে ভিকটিম রিফাতের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনেছেন।
  • গ্রেপ্তারের আগে আসামিকে (মিন্নি) দীর্ঘ সময় স্থানীয় পুলিশ লাইনসে আটক রাখা হয়।
  • গ্রেপ্তার করে রিমান্ড শুনানির সময় আসামি আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ না পাওয়া।
  • ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দেওয়ার আগেই অর্থ্যাৎ রিমান্ডে থাকাবস্থায় গণমাধ্যমের সামনে স্থানীয় পুলিশ সুপারের বিভিন্ন বক্তব্য; যথা ‘আসামি দোষ স্বীকার করেছে, মিন্নি শুরু থেকেই যারা হত্যাকারী ছিল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে এবং এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হওয়ার আগেও সে পরিকল্পনার জন্য যা যা দরকার হত্যাকারীদের সঙ্গে মিটিং করেছে’।
  • আসামি একজন মহিলা এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারার ব্যতিক্রমের সুবিধা পেতে পারে।

এসব কারণে তাকে জামিন দেওয়া ন্যায়সঙ্গত মনে করছি। আদালত বলেন, আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি-কে বরগুনার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সন্তুষ্টি সাপেক্ষে জামিননামা সম্পাদনের শর্তে জামিন প্রদান করা হলো। আসামি কর্তৃক অন্তবর্তীকালীন জামিনের সুবিধা অপব্যবহারের অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট আদালত আইনের নির্ধারিত নিয়মে জামিন বাতিল করতে পারবে।

আদালত বলেন, আসামি রিমান্ডে থাকাবস্থায় প্রেস ব্রিফিংয়ে এসপির বক্তব্য দেওয়া কতটুকু আইন ও ন্যায়সঙ্গত সে বিষয়ে এসপির ব্যাখ্যা ও কাগজপত্র পর্যালোচনা করা হয়েছে।

আদালত বলেন, যে পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় ওই বক্তব্য দেওয়া হয়ে থাকুক না কেন, বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে যে, একজন রিমান্ডে থাকাবস্থায় আইনের নির্ধারিত নিয়মে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দেওয়ার আগেই এসপির এ ধরনের বক্তব্য তদন্ত সম্পর্কে জনমনে নানাবিধ প্রশ্ন ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তার বক্তব্যের বিষয়বস্তু যদি ধরেও নেওয়া হয় যে সত্য, তাহলেও গণমাধ্যমের সামনে এপর্যায়ে প্রকাশ করা ছিল অযাচিত এবং ন্যায়-নীতি, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের পরিপন্থি। একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার কাছ থেকে এ ধরনের কাজ প্রত্যাশিত ও কাম্য ছিল না। তিনি নিজেই তার দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, যা দুঃখজনক এবং হতাশাজনক।

আদালত বলেন, যেহেতু মামলাটির তদন্ত কাজ চলমান, সেকারণে এ মুহূর্তে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে আদালত বিরত থাকছে। তদন্ত শেষে পুলিশ রিপোর্ট দাখিল হলে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ বিষয়ে সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।