অধ্যাপক খায়ের মাহমুদ

চুল সমাচার!

খায়ের মাহমুদ:

বছর পাঁচেক আগে একটা বই পড়েছিলাম ‘দ্য বেটার অ্যাঙ্গেল অব আওয়ার নেচারস; হোয়াই ভায়োলেন্স হ্যাজ ডিক্লাইন’। ২০১১ সালে প্রকাশিত বইটির লেখক জগৎ বিখ্যাত স্টিভ পিনকের। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম বা হিউমেন রাইটস ক্লাসে ছাত্ররা যখন খুব হতাশ হয়ে পড়ে তখন আমি এই বইটির উদাহরণ দেই। কারণ, বইটিতে লেখক প্রমাণ করেছেন মানুষ বিভিন্ন ধরনের সংঘাত এবং যুদ্ধকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে এবং উদাহরণ হিসেবে আপনি যদি গত শতাব্দীর দিকে নজর দেন, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পৃথিবীতে মানবাধিকারের বিভিন্ন সনদ এবং দেশীয় অভ্যন্তরীণ আইন-কানুনের উন্নতির ফলে সংঘাতে বা বিভিন্ন অপরাধে মানুষের মৃত্যুর হার ক্রমশই কমেছে দেখবেন। অত্যন্ত পজেটিভ একটা বই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে সব বই এখন আর টাকা দিয়ে কিনে পড়া লাগে না, এ বইটিও লেখকের কল্যাণে এখন ফ্রি পড়া যাচ্ছে। গুগলের সহায়তায় যে কেউ পড়তে পারেন। কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলাম আমাদের দেশের বেশ কিছু জেলায়, বিশেষ করে যেখানে বাচ্চাদের পছন্দের চুল কাটায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে সেখানকার পুলিশ বা স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বইটি হয়তো পড়ে ফেলেছেন এবং ভাবছেন তাদের এবার ‘সমাজ সংস্কারে’ একটু মন দেওয়া যাক।

কিশোর এবং উঠতি বয়সী বাচ্চাদের চুল কাটায় নানান নিষেধাজ্ঞা নিয়ে খবর পত্রিকায় আসছে বেশ কিছু দিন ধরেই। খবরে বলা হচ্ছে, মডেলদের মতো করে বা বখাটেদের মতো করে চুল কাটা যাবে না বলে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। আপাতত মনে হচ্ছে সবার চুল ছোট করে কাটলেই দেশের সব কিশোর অপরাধ বন্ধ হয়ে যাবে। কেউ কেউ তাই কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ‘জিহাদ’ ঘোষণা করছেন এ ধরনের চুল কাটার বিরুদ্ধে। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না চুলের সঙ্গে অপরাধের কী সম্পর্ক? অপরাধ বিজ্ঞানের কোনও মতবাদে এমন কিছু আছে বলে আমার জানা নেই,লম্ব্রোসো মতবাদ নামে এক বিতর্কিত মতবাদে মানুষের শারীরিক গঠনের সঙ্গে অপরাধ প্রবণতার যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছিল, লম্বা চোয়াল বা মানুষের ঠোঁটের আকৃতির বিষয় সেখানে থাকলেও চুল বিষয়ে কিছু ছিল না। এই তত্ত্ব তারা কোথায় পেলেন?

ইভটিজিং প্রতিরোধে ফ্যাশনেবল চুল-দাড়ি-গোঁফ ছাঁটার ওপর নির্দেশনা প্রথম এসেছিল গত মার্চে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলায়। সেখানে স্টাইল করে চুল-দাড়ি কাটার ক্ষেত্রে জরিমানার বিধান রেখে নোটিশের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ৪০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। হেয়ারস্টাইলের কোনও ক্যাটালগ দোকানে প্রদর্শনও করা যাবে না। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি আলোচনার পর সে বেআইনি নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া হয়।

ভেবেছিলাম বিষয়টি হয়তো আর বাড়বে না, কিন্তু হয়েছে তার ঠিক উল্টো। টাঙ্গাইলের পর একে একে ঝালকাঠি, ঢাকার সাভার এবং মাগুরা জেলা পুলিশও সেলুন মালিকদের বখাটে স্টাইলে চুল কাটা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। এ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে মাগুরায় মাইকিংও করা হয়। পুলিশের এমন কর্মকাণ্ডে স্বাভাবিকভাবেই নানান সমালোচনার সাথে প্রশ্ন উঠেছে তারা এটা করতে পারে কিনা? উত্তরটি খুব সহজ- অপ্রাপ্ত বয়স্ক, প্রাপ্ত বয়স্ক কারো সাথেই তারা এটা করতে পারে না, এটা তাদের কাজ না, এটা সরাসরি মানুষের মৌলিক মানবাধিকার ‘ব্যক্তি স্বাধীনতায়’ হস্তক্ষেপ। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ পড়লে ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়টি স্পষ্ট। চুল কাটায় নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি এতই সংক্রমিত হয়েছে যে, এটি এখন আর পুলিশ বা স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, কিছুদিন আগে বগুড়াতে এক প্রধান শিক্ষক এবং দু’দিন আগে রাজশাহীতে স্কুল সভাপতি নিজে জোর করে বাচ্চাদের চুল কেটে দিয়েছেন। একবার ভাবুন তো কী ভয়ঙ্কর, পাশবিক কাজ, কারও অনুমতি ছাড়া জোর করে এ ধরনের কাজ শিশুমনে কী প্রচণ্ড ভয় এবং ক্রোধের জন্ম দিয়েছে। এটি শিশুর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের শামিল। উন্নত বিশ্বে এমন কাজ হলে এরা প্রত্যেকেই ‘ফিজিক্যাল এসল্ট’ বা অনধিকার শারীরিক হস্তক্ষেপের দায়ে দায়ী হতেন।

এই নিষেধাজ্ঞার ভয়াবহ দিকটা হচ্ছে, তারা শিশু এবং উঠতি বয়সীদের উদ্দেশ্যে মূলত এটা করছেন। বাংলাদেশ জাতিসংঘ শিশু সনদের অন্যতম প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ (২০ নভেম্বর, ১৯৮৯)। এ সনদের আলোকে আমরা ২০১৩ সালে আমাদের শিশু আইনকে যুগোপযোগী এবং আধুনিক করেছি। সারা পৃথিবীর মতোই বাংলাদেশেও এখন ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু হিসেবে পরিগণিত এবং সকল সুরক্ষার দাবিদার। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিশুর প্রতি যেকোনও ভুল পদক্ষেপ বা সহিংসতার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ অর্থাৎ ৬ কোটি ৩০ লক্ষ শিশুর বসবাস। এটা একদিকে যেমন প্রচণ্ড সম্ভাবনার যে আমাদের বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে সমানভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ যদি না আমরা এই শিশুদের বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ না দিতে পারি।

আগেই উল্লেখ করেছি শিশুদের সুস্থ শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য আমাদের অত্যন্ত আধুনিক আইন রয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানে শিশু সুরক্ষায় প্রয়োজনে বিশেষ বিধান করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা আছে [অনুচ্ছেদ ২৮(৪)]। শিশু আইন ২০১৩-তে শিশুর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ, অহেতুক দুর্ভোগ সৃষ্টি করা বা শরীরের কোনও অঙ্গ বা ইন্দ্রিয়ের ক্ষতি হয় বা কোনও মানসিক বিকৃতি ঘটে এমন কাজকে করা হয়েছে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিষয়টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এও গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ যারা করবেন তারাই যদি এই বিষয়গুলো নিয়ে অন্ধকারে থাকেন, পরিণতি ভয়াবহ হবে এটাই স্বাভাবিক।

শিশুমনের প্রাধান্য কতটা জরুরি তার একটা উদাহরণ দিয়ে লেখাটা শেষ করতে চাই। এটি একটি সত্য ঘটনা, যা অস্ট্রেলিয়া হাইকোর্টের ১৯৯৫ সালের একটা মামলা সূত্রে জানা। আহ হিন তেও নামে এক মালয়েশিয়ান নাগরিক ১৯৮৮ সাল থেকে অনেক বছর যাবৎ অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করে আসছিলেন। এই সময় তিনি একজন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিককে বিয়ে করেন এবং স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি চান। তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে সুখেই কাটছিলো তার দিন। কিন্তু তার এই আবেদন বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায় তিনি হেরোইনসহ গ্রেফতার হন। স্বাভাবিকভাবেই তার স্থায়ীভাবে থাকার আবেদন বাতিল করে ডিপোর্টেশন বা দেশে ফেরত পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়। আহ হিন ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন। আদালতে তার আইনজীবী বলেন, তাকে ফেরত পাঠালে তার তিন সন্তান বাবাকে মিস করবে, যা তাদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার জন্য ক্ষতিকর এবং অস্ট্রেলিয়া জাতিসংঘ শিশু সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে এটা করতে পারে না। আদালত তাদের আবেদন গ্রহণ করে আহ হিনের দেশে ফিরে যাওয়ার আদেশ বাতিল করেন। উল্লেখ্য, সনদের সর্বক্ষেত্রে শিশুর প্রাধান্যের কথা বলা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ৩)।

এই ছোট্ট ঘটনাটা থেকে বোঝা যায় শিশুমনের স্বাভাবিক বিকাশ কতটা জরুরি। আশা করি আমাদের অতি উৎসাহী নিষেধাজ্ঞা প্রদানকারী লোকজন খুব দ্রুতই এটা বুঝতে পারবেন।

একই সঙ্গে এটাও ভেবে দেখতে হবে, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা যখন বিভিন্ন মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, ঠিক তখন শুধু চুল-দাড়ির স্টাইলে নিষেধাজ্ঞা জারির মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা ফেরানোর বিষয়টি আসলে কতটা আইনসঙ্গত।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।