কাজী শরীফ; সহকারী জজ, নোয়াখালী

প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতিমালা: ডাকনাম, ম্যাজিস্ট্রেট ও হাকিম বিতর্ক

কাজী শরীফ :

ওবায়দুল গণি চন্দন নামে বাংলাদেশে একজন ছড়াকার ও শিশু সাহিত্যিক ছিলেন। যিনি মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে চন্দন ভাই মারা যান। চন্দন ভাই প্রথম আলোতে কোন লেখা দিতেন না। কারণ প্রথম আলো তার ডাকনাম পত্রিকায় ব্যবহার করতো না। ওবায়দুল গণি নামে লেখা ছাপালে চন্দন ভাইয়ের পরিচয় অসম্পূর্ণ থাকে যুক্তিতে তিনি প্রথম আলোর মত শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় লেখা দেয়া থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিলেন। প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতিমালা হলো ডাকনাম ব্যবহার না করা। এ সম্পাদকীয় নীতিমালা নিয়ে প্রশ্ন তোলার জায়গা থাকলেও আমি তুলবোনা। কারণ মতিউর রহমানের মত গুণী সম্পাদকের সম্পাদকীয় নীতিমালা নিয়ে সাংবাদিকতার ছাত্র না হয়ে প্রশ্ন তোলা আমার উচিত হবে না বলেই আমি মনে করি।

শুরুতেই বলে রাখি “প্রথম আলোর পাঠক” এ পরিচয় দিয়েও আমি বেশ আনন্দ অনুভব করি। গত দেড় যুগের বেশি সময় জুড়ে প্রথম আলো যে অবস্থানে পৌঁছেছে তাতে আমার খুবই আনন্দ হয়। কিন্তু আমার প্রিয় পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতিমালা নিয়ে আমার মনের ভেতর জমে থাকা প্রশ্ন এভাবে পড়ে থাকুক তাও আমি চাইনা। তাই আজ কলম ধরলাম।

আমার জিজ্ঞাস্য হলো ডাকনাম বাদ দেয়ার এ রীতি প্রথম আলো সবসময় সবার জন্য সমানভাবে অনুসরণ করে তো?

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত “ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না” চলচ্চিত্রের পরিচালক জাকির হোসেন রাজুকে আমরা চিনি। তার “অনেক দামে কেনা” চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার তারিখ উল্লেখের সময় প্রথম আলো পরিচালকের নাম জাকির হোসেন লিখে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ছবির কাহিনিকার আব্দুল্লাহ জহির বাবুর নাম থেকেও বাবু বাদ দিয়ে প্রথম আলো আবদুল্লাহ জহির লিখে। প্রথম আলোর যুক্তি হলো প্রথম আলো ডাকনাম ব্যবহার করেনা। যদি তাই হয় তাহলে অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম, নুসরাত ইমরোজ তিশা, আজমেরী হক বাঁধন, অভিনেতা জিয়াউল ফারুক অপূর্ব, আফরান নিশোদের বেলায় কীভাবে ডাকনাম পত্রিকায় লেখা হয়?

আজকের প্রথম আলোর বিনোদন পাতার টেলিফোন কথোপকথনে একটু চোখ বুলান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুর কাদের। যার ডাক নাম জিয়া। মনজুর কাদের সাহেবের ডাকনাম পত্রিকার নীতিমালার কারণে বাদ পড়লেও তার স্ত্রী জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী সোমনূর মনির কোনালের ডাকনাম “কোনাল” পত্রিকায় সবসময় থাকে বলে আমি বিস্মিত হই!

চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর সাবেক মন্ত্রী ও মেয়র সাদেক হোসেন খোকা নাম থেকে খোকা বাদ দিতে চেয়েছিলেন। প্রথম আলো তখন খোকা দিয়েই লিখতো। সাবেক প্রতিমন্ত্রী ফজলুর রহমান পটল বহুচেষ্টা করেও প্রথম আলোর পাতা থেকে পটল সরাতে পারেননি। ডাকনাম ব্যবহারের রীতি মানলে খোকা বা পটল পত্রিকায় উল্লেখ করার কথাই ছিলোনা!

যে নীতিমালা বিভিন্নজনের জন্য বিভিন্ন রকম সে নীতিমালার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নজরে আসায় সে বিষয়েও লিখছি। প্রথম আলো জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলা বিচারিক হাকিম লিখে। ইংরেজির বাংলা প্রতিশব্দ করার চেষ্টা নিয়ে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু হাকিম কি বাংলা শব্দ? হাকিম আরবি শব্দ। ইংরেজি বাদ দিয়ে বিদেশি শব্দ আরবিতে লেখার যৌক্তিকতা আমার মাথায় আসেনা!

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই হাকিম বহুদিন ধরে বাংলা শব্দভাণ্ডারে থাকতে থাকতে বাংলা প্রচলিত শব্দের জায়গা দখল করেছে তবুও প্রথম আলো তার সম্পাদকীয় নীতিমালার বিতর্ক এড়াতে পারেনা। যে প্রথম আলো জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে বিচারিক হাকিম লিখে সে প্রথম আলোই আবার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কীভাবে ও কোন যুক্তিতে লিখে তা আমার মত এক সাধারণের কাছে বোধগম্য নয়।

জনাব মতিউর রহমান, আপনি আমার প্রিয়তম পত্রিকার সম্পাদক। ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতি করা আপনি সাম্য ও সমতার কথা বলে আসলেও সম্পাদকীয় নীতিমালায় সমতার অভাব খুব প্রকটভাবে ধরা পড়ে। নিজ পত্রিকার এমন স্ববিরোধী সম্পাদকীয় নীতিমালায় কেমন সমতা রক্ষিত হয় জানাবেন কী!

আপনার জানাশোনার গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অপচেষ্টা আমি করবোনা। শুধু বাংলাদেশের সংবিধানে খানিকটা মনযোগ দেয়ার অনুরোধ করছি। সংবিধানের ১১৫ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে “বিচারবিভাগীয় পদে বা বিচারবিভাগীয় দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উক্ত উদ্দেশ্যে প্রণীত বিধিসমূহ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দান করবেন।” ১১৬ ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে বিচার কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ ও ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন।”

সংবিধানের কোথাও হাকিম শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। সাংবিধানিকভাবে যেখানে ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটি আছে, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যেখানে ম্যাজিস্ট্রেট বলছে কিংবা The Code of Criminal Procedure যেখানে পদের নাম ম্যাজিস্ট্রেট রেখেছে সেখানে জোর করে অনুবাদ করার যৌক্তিকতা কোথায়? যদি যৌক্তিকভাবেও হতো তথাপি কারো বেলায় ম্যাজিস্ট্রেট আর কারো বেলায় হাকিম লেখার কারণ কী?

পদের নামের যেকোন অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে। ক্রিকেটে বোলার, ব্যাটসমান বা আম্পায়ারের অনুবাদ করার চেষ্টা কি কেউ করেছে নাকি তা যুক্তিযুক্ত? বোলারকে বল নিক্ষেপক, ব্যাটসম্যানকে ব্যাটধারী কিংবা বল আক্রমণকারী কিংবা আম্পায়ারকে যদি কেউ খেলার বিচারক বলে তা কতটুকু শ্রুতিমধুর হয় তাও কী আলোচনা করা উচিত নয়!

জনাব মতিউর রহমান, আপনার প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা। সে বিনয় থেকে নায়ক নায়িকাদের ডাকনাম পত্রিকায় উল্লেখ করা গেলে পরিচালকের ডাকনাম ব্যবহারের নীতিমালায় ভিন্নতা কেন জানতে চাই। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে বিচারিক হাকিম লিখলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জেলা হাকিম না লিখে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট লেখার কারণও জানতে চাই। আর যদি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটই লেখা যায় তাহলে বিচারিক হাকিম কেনো লেখা হয়?

সম্পাদকীয় নীতিমালার এ দ্বৈতনীতি কি তবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? আপনি উত্তর না দিলে মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নেয়াটা নিশ্চয়ই অযৌক্তিক হবেনা? আপনার উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম।

লেখক: সহকারী জজ, নোয়াখালী।