অ্যাডভোকেট লুবনা ইয়াসমিন

ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন পর্যালোচনা

লুবনা ইয়াসমিন:

ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন, বিচার ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করা হয়েছে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বা অনলাইন গণমাধ্যমে কাউকে নিয়ে মানহানিকর বা বিভ্রান্তিমূলক কিছু পোস্ট করলে, ছবি বা ভিডিও আপলোড করলে, কারও নামে অ্যাকাউন্ট খুলে বিভ্রান্তিমূলক পোস্ট দিলে, কোনো স্ট্যাটাস দিলে কিংবা শেয়ার বা লাইক দিলেও সাইবার অপরাধ হতে পারে। কাউকে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে হুমকি দিলে, অশালীন কোনো কিছু পাঠালে কিংবা দেশবিরোধী কোনো কিছু করলে তা সাইবার অপরাধ হবে। আবার ইলেকট্রনিক মাধ্যমে হ্যাক করলে, ভাইরাস ছড়ালে কিংবা কোনো সিস্টেমে অনধিকার প্রবেশ করলেও সাইবার অপরাধ হতে পারে।

একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করা যাক, ২০১৭ সালে একটি মামলা পরিচালনা করি জেলা জজ আদালত ঢাকায়। একজন একাউন্টেটের বিরুদ্ধে তার অফিসের আন্তর্জাতিক সংস্থার বিদেশী কর্মকর্তা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ এর ৫০৬ ( দণ্ড বিধি) ৬৬ এবং ৬৭ (২) ধারায় অভিযোগ এনেছিলেন।

বিদেশী বাদী অভিযোগ এনেছিল যে তার মোবাইলে একটি ম্যাসেজ আসে সেখানে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। সে শুধু দেখিয়ে ছিল তার মোবাইলে আসা একটি ম্যাসেজ। ম্যাসেজটি ছিল “(name ….you Buddhist killed Muslim get ready for your death within few days” Jamate Taliban)” এইরকম। এক্ষেত্রে বিবাদী যে ধারাগুলোতে অভিযুক্ত হয়েছিলেন তা হচ্ছে- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ এর সেকশন ৫০৬ (দণ্ড বিধি ): অপরাধজনক ভীতিপ্রদর্শনের শাস্তি এবং ৫৭ (২) ইলেকট্রনিক ফরমে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ। যার শাস্তি ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং অনুন্য ৭ বছর এবং এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড।

মামলার গোপনীয়তা রক্ষার্থে নাম ও বিস্তারিত প্রকাশ করা হলো না। কেউ কেউ ভোগে পাপে এই একাউন্টেন্ট ভদ্রলোক ভুগেছিলেন তাপে। প্রকৃতপক্ষে পুরো বিষয়টি ছিল অফিসের অভ্যন্তরিন কোন্দল।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনটির যেমন সুফল রয়েছে, একই সঙ্গে এর কিছু খারাপ দিকও রয়েছে। অসাবধানতাবশত কোনো অপরাধের জন্য কাউকে কঠিন সাজার মুখোমুখি করা সম্ভব এই আইনে। তাই অনলাইন ব্যবহারে সচেতনতার বিকল্প নেই।

কম্পিউটারে সিস্টেম বা ফেসবুক হ্যাকিং করেছেন, অনলাইনে মানহানিকর বা বিভ্রান্তিমূলক কিছু পোস্ট করেছেন, আপনার রেহাই নেই। অপরাধ প্রমাণ হলেই হতে পারে সর্বোচ্চ ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড।সঙ্গে গুনতে হতে পারে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড। সাইবার অপরাধে রয়েছে কঠিন সাজা। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩)-এ রয়েছে সাইবার অপরাধের বিচারের বিধান। যদিও এই আইনের কিছু ধারা নিয়ে বিতর্কের পর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর ধারা ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ এই ৫ টি ধারা “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮” সালের আইন দ্বারা বিলুপ্ত করা হয়েছে। তবে অন্যান্য ধারায় বিচারের সুযোগ রয়েছে সাইবার অপরাধের। এই ধারায় চলমান মামলাগুলো ২০০৬ সালের ধারা অনুযায়ী পরিচালিত হবে। কিন্তু নতুন কোনো মামলা আর উপরোক্ত ধারা গুলো দ্বারা পরিচালিত হবে না। এবার আসুন জেনে নেই কোন কোন ধারা গুলো বাতিল হলো

ধারা ৫৪: কম্পিউটার সিস্টেম, ইত্যাদির অনিষ্ট সাধন ও দণ্ড। এখানে অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো কাজ করতে তা বেআইনি হত এবং অপরাধ হিসাবে গণ্য হত। এই ধারাটি বিশাল একটি ধারা ছিল যার আওতাধীন ১ উপধারার অধীন ক-ঝ পর্য়ন্ত বিভিন্ন অপরাধের বর্ণনা ও দন্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে, কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম ইত্যাদির ক্ষতি, অনিষ্ট সাধন যেমন ই-মেইল পাঠানো, ভাইরাস ছড়ানো, সিস্টেমে অনধিকার প্রবেশ বা সিস্টেমের ক্ষতি করা, অবৈধ প্রবেশ, অন্যায় ভাবে হস্তক্ষেপ ইত্যাদি অপরাধ করলে সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও সর্বনিম্ন সাত বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। আইনের এই বিধান অনুযায়ী উভয় (কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড) প্রদানের বিধানও রয়েছে। ২০১৩ সালের আইন দ্বারা সংশোধনি আনা হয় যা অনধিক দশ বৎসর কারাদণ্ড করা হয়।

ধারা ৫৫: কম্পিউটার সোর্সকোড পরিবর্তন সংক্রান্ত অপরাধ ও উহার দণ্ড। আইনের ৫৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কম্পিউটারের সোর্স কোড পরিবর্তন সংক্রান্ত অপরাধের কথা। এখানে বলা হয়েছে, কম্পিউটারের সোর্স কোড পরিবর্তন সংক্রান্ত অপরাধ করলে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

ধারা ৫৬: কম্পিউটার সিষ্টেমের হ্যাকিং সংক্রান্ত অপরাধ ও উহার দন্ড। ৫৬ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ক্ষতি করার উদ্দেশে এমন কোনো কাজ করেন, যার ফলে কোনো কম্পিউটার রিসোর্সের কোনো তথ্য বিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তিত হয় বা এর উপযোগিতা হ্রাস পায় অথবা কোনো কম্পিউটার, সার্ভার, নেটওয়ার্ক বা কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করেন, তবে এটি হবে হ্যাকিং অপরাধ, যার শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।

ধারা ৫৭: ইলেক্ট্রণিক ফরমে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও উহার দণ্ড। ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কোনো মিথ্যা বা অশ্লীল কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে, যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয় অথবা রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, তাহলে এগুলো হবে অপরাধ। এর শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা। উভয় (কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড) দণ্ড দেওয়ার বিধানও এই আইনে রয়েছে।

ধারা ৬৬: কম্পিউটার ব্যাবহারের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটন ও উহার দণ্ড। আইনের ৬৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কারও কম্পিউটার ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত হলে, অপরাধকারী যে দণ্ডে দণ্ডিত হবেন, ইচ্ছাকৃতভাবে অপরাধে সহায়তার জন্য কম্পিউটারের মালিকও সমান সাজা পাবেন।

আজ এ পর্যন্তই, পরবর্তী পর্বে দেখানোর চেষ্টা করবো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ তে উপরোক্ত আইনগুলো নতুন রূপে কিভাবে ধরা পড়েছে।

লেখক: পেশায় আইনজীবী। জনস্বাস্হ্য সেবা নিয়ে ইউনিসেফ, কানাডিয়ান সিডা, সেইভ দি চিলড্রেন, ইউএসএইডের সহায়তায় প্রকল্প এভিআরডিসি সাথে নিউট্রিশন কোঅর্ডিনেটর হিসাবে কাজ করেছেন দীর্ঘ সময়। এছাড়াও আইন কমিশনে চিকিৎসায় অবহেলা নিয়ে গবেষক হিসাবে কাজ করেছেন।