সরকারি চাকরিজীবীদের গ্রেপ্তারে অনুমতি লাগবে

সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ের একজন জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা যাবে। কিন্তু মঙ্গলবার থেকে কার্যকর হতে যাওয়া সরকারি চাকরি আইনে একই ধরনের অপরাধে মামলার আসামি হওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করতে চাইলে সরকার বা নিয়োগ কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি লাগবে।

বহুল আলোচিত এই আইন বৈষম্যমূলক এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে এটি ইতিমধ্যে চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। আইনটি কার্যকর হলেই আদালতে চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন সংগঠনসংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।

সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারের আগে অনুমতি লাগবে কি না, তা নিয়ে প্রায় অর্ধযুগ ধরে সরকার ছাড়াও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় সংসদে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। এমনকি বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।

সরকারের অনুমোদন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না—এই বিধান যুক্ত করে ২০১৩ সালে সংসদে দুদক আইন সংশোধন বিল পাস হয়। এর মাধ্যমে দুদকের ক্ষমতা খর্ব করার অভিযোগ ওঠে। ওই বছরের ২৫ নভেম্বর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে চার আইনজীবী সংশোধনী আইন চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। ২০১৫ সালের ৩০ জানুয়ারি দুদক আইনের সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট।

দুদক আইন ছাড়াও দেশে বিদ্যমান ফৌজদারি আইনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুরক্ষা দেওয়া আছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা অনুসারে সরকারি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেলে অভিযোগপত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দপ্তরের অনুমোদন লাগবে। তবে গ্রেপ্তারে বাধা নেই। কিন্তু নতুন আইনে অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হওয়ার আগে গ্রেপ্তার করতে চাইলে সরকারের অনুমতি লাগবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, কোনো আইনই স্থায়ী কিছু নয়। সময়ের প্রয়োজনে এটি সংশোধন বা সংযোজন হতে পারে। তবে সরকারি চাকরিজীবী আইনটি জনপ্রশাসনে গতি আনতে সামগ্রিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, কাউকে ছাড় দেওয়ার উদ্দেশ্যে আইনটি করা হয়নি। তা ছাড়া কেউ অপরাধ করলে দুদক আইনসহ নানা ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা তো রয়েছে।

ফরহাদ হোসেন আরও বলেন, সরকারকে সামনে এগিয়ে যেতে অনেক সময়, অনেক রকম সিদ্ধান্ত নিতে হয়। একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যদি একজন কর্মকর্তা ঝামেলা বা ঝুঁকি মনে করেন, তাহলে এগোতে চাইবেন না। আবার জনস্বার্থে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতেও হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি কুইক রেন্টাল প্রকল্পের দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন, সরকার দ্রুততার সঙ্গে কুইক রেন্টাল প্রকল্পগুলো স্থাপনের সুযোগ না দিলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আজকের সহনশীল অবস্থায় আসত না। সে ক্ষেত্রে আইনি সুরক্ষার প্রয়োজন ছিল। তার মানে এই নয় যে কেউ দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাবেন।

দুদকের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেছেন, এর আগে সরকারি কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দিয়ে দুদক আইন সংশোধনের উদ্যোগটি হাইকোর্ট আটকে দিলে সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেনি। তার মানে রায়টি বহাল আছে।

ওই মামলার আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, দুদক আইনের মতো নতুন এই আইনকেও খুব শিগগির চ্যালেঞ্জ করা হবে। গত বছরের নভেম্বরে আইনটির গেজেট হওয়ার পর থেকে তাঁরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। তাঁর মতে, কতিপয় ব্যক্তির দুর্নীতি সুরক্ষায় সরকারি চাকরিজীবী আইনটি হয়েছে।

দুদক আইনে বলা আছে, অন্য আইনে যা কিছু থাকুক না কেন, দুদক আইন প্রাধান্য পাবে। আবার সরকারি চাকরি আইনেও বলা আছে, আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলি কার্যকর হবে। তবে আইনজ্ঞরা বলছেন, দুদক আইনের অবস্থান সব আইনের ঊর্ধ্বে।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেছেন, এটা কার্যত দুর্নীতি সুরক্ষার আইন হয়েছে। প্রচলিত আইন এবং আদালতের রায় উপেক্ষা করে সরকারি চাকরিজীবী আইনে একদিকে আমলাতন্ত্রকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে, আরেক দিকে জনপ্রতিনিধিদের হেয় করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, সংসদ যথেষ্ট পর্যালোচনা করে আইনটি পাস করেনি।’

দেশে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য এই প্রথম একটি আইন হয়েছে, যার লক্ষ্য সরকারি কর্মচারীদের জনমুখী করা, তাঁদের দক্ষতা বাড়ানো ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। এত দিন রাষ্ট্রপতির বিধি দিয়ে প্রায় ১৪ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিচালিত হতেন, এর বাইরেও একই রকম বিধি দিয়ে পরিচালিত হতেন আরও সাত থেকে আট লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী। নিজস্ব আইন থাকায় সাংবিধানিক পদে ও বিচার বিভাগে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ, পোশাকধারী শৃঙ্খলিত যেকোনো বাহিনী, নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী, উন্নয়ন প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ কয়েকটি খাত এই আইনের আওতায় পড়বে না।

নতুন আইনে সরকারি কর্মচারীদের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। নিয়োগ কর্তৃপক্ষ লঘু বা গুরুদণ্ড প্রদান করলে একজন কর্মচারী রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে পারবেন। এরপর রাষ্ট্রপতি যে আদেশ দেবেন, তার বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। তবে রাষ্ট্রপতির আদেশের বিরুদ্ধে তাঁর কাছে পুনর্বিবেচনার আবেদন করা যাবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) শুরু থেকেই আইনটির নামসহ কিছু বিষয় নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে। সর্বশেষ গত ২৩ জুন এক গবেষণা প্রতিবেদনে টিআইবি বলেছে, সরকারি চাকরি আইন নামটিই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই আইনের নাম হওয়ার কথা জনপ্রশাসন আইন। সংস্থাটির মতে, আইনে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব কর্তৃত্ব সরকারের কাছে রাখা হয়েছে, যা ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’—এই সাংবিধানিক অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের দিকে ‘সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট’ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবিধানের সঙ্গে মিল রেখে সরকারি কর্মচারী আইন নামে এটি প্রণয়ন করতে অনুশাসন দেন। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে সরকারি কর্মচারী আইনের খসড়া মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে। পরে আইনটির নাম বদল করে রাখা হয় সরকারি চাকরি আইন।

আলোচিত এই আইন প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, ফৌজদারি আইনে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য মামলা, অভিযোগপত্র বা গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে যে সুবিধা রাখা হয়েছে, তার বাইরে নতুন কোনো সুযোগের দরকার আছে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া সরকারি চাকুরেদের সুরক্ষা দিয়ে দুদক আইন সংশোধন করতে চাইলেও আদালত এর বিপক্ষে রায় দিয়েছেন।

তিনি মনে করেন, সরকারি চাকরিতে অপরাধমূলক কাজ করা কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা খুবই কম। তাঁদের অপরাধের দায় বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর চাপানোর চেষ্টাটা লজ্জাজনক। সূত্র- প্রথম আলো