শ্রীনগর উচ্চ আদালত

আদালতের অচলাবস্থায় কাশ্মিরি বন্দিদের দুর্ভোগ চরমে

ভারত শাসিত কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন বাতিলের পর একদিকে সেখানকার হাজার হাজার মানুষকে আটক করা হয়েছে আর অপরদিকে কমানো হয়েছে শ্রীনগরের উচ্চ আদালতের বিচারকের সংখ্যা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আইনজীবীদের আদালত বর্জন কর্মসূচি। সবমিলে ভোগান্তিতে পড়েছেন কাশ্মিরি বন্দি এবং তাদের স্বজনেরা।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, কবে নাগাদ এই ভোগান্তির অবসান হবে তারও কোনও ইঙ্গিত পাচ্ছেন না কাশ্মিরিরা।

গত ৫ আগস্ট কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেওয়ার ঘোষণাকে ঘিরে ৪ আগস্ট থেকেই অচল হয়ে আছে কাশ্মিরের মানুষের জীবন। ইন্টারনেট ও মোবাইল সংযোগ বন্ধ রয়েছে। শুন্য হয়ে রয়েছে রাস্তাঘাট। মোতায়েন করা হয়েছে হাজার হাজার অতিরিক্ত সেনা সদস্য। কর্তৃপক্ষ স্কুল-আদালত স্বাভাবিকভাবে চালানোর ঘোষণা দিলেও তা হচ্ছে না। সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বন্ধ রাখা হয়েছে বেশিরভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য। তবে ভারত শাসনের বিরোধিতাকারীদের হামলার আশঙ্কার কথাও বলছেন অনেক ব্যবসায়ী। রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী ও অ্যাকটিভিস্টসহ হাজার হাজার মানুষকে আটক রাখা হয়েছে। অনেককেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে রাজ্যের বাইরের কারাগারে।

কাশ্মিরের প্রধান শহর শ্রীনগরের উচ্চ আদালতের বড় একটি হল ঘরের সোফায় বসে থাকা আলতাফ হোসেন লোন বেশ উদ্বিগ্ন। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ৫০ কিলোমিটার দূরের বারামুল্লাহ শহরের নিজ বাড়ি থেকে শ্রীনগর এসেছেন তিনি। তার উদ্দেশ্য ভাই সাব্বিরের জন্য এক আইনজীবীর খোঁজে। গ্রামের নেতা সাব্বিরকে গ্রেফতার করা হয়েছে চরম বিতর্কিত জননিরাপত্তা আইনে। এই আইনের অধীনে গ্রেফতারকৃতদের অভিযোগ গঠন ছাড়াই দুই বছর পর্যন্ত আটক রাখা যায়।

সাব্বিরের জন্য কোনও আইনজীবী খুঁজে পাননি তার ভাই আলতাফ। কারণ জম্মু-কাশ্মির বার অ্যাসোসিয়েশন তাদের সাবেক সভাপতি মিয়া আবদুল কাইয়ুম ও নাজির আহমেদ রোঙ্গাকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ৫০ দিনেরও বেশি সময় ধরে আদালত বর্জন করে চলেছে। তাদের দুজনকেই জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে উত্তর প্রদেশের আলাদা দুটি কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে প্রায় দুই হাজার দুইশো আইনজীবীর আদালত বর্জনে ভোগান্তিতে পড়েছে আটককৃতদের পরিবারের সদস্যরা।

আইনজীবী ছাড়া কিভাবে ভাইকে মুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করবেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন আলতাফ। ইতিমধ্যেই তিনি সাব্বিরের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ খারিজ করতে ‘হেবিয়াস কর্পাস’ আবেদন করেছেন তিনি। সাধারণত কোনও আটককৃত ব্যক্তিকে আদালতের সামনে হাজির করে তার আটকের বৈধতা পরীক্ষার আবেদন জানাতে ‘হেবিয়াস কর্পাস’ আবেদন করা হয়।

গত ৫ আগস্ট থেকে এধরণের প্রায় আড়াইশোটি আবেদন জমা পড়েছে। তবে এর বেশিরভাগই শুনানি হয়নি। এসব আবেদনের শুনানির জন্য মাত্র দুজন বিচারক নিয়োগ দিয়েছে আদালত। আইনজীবী সংকটের পাশাপাশি আদালতের বিচারক সংখ্যাও ১৭ থেকে কমিয়ে নয় জন করা হয়েছে। হতাশ আলতাফ হোসেন বলেন, আমি জানি না কী করতে হবে। তিনি জানান এখন সাব্বিরের স্ত্রী, দুই সন্তান আর তাদের ৮০ বছর বয়সী মাকে দেখভাল করতে হচ্ছে তাকে।

আইনজীবীরা বলছেন, সহকর্মীদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত তাদের আদালত বর্জনের কর্মসূচি চলবে। তবে কোনও কোনও আইনজীবী পরিবারের সদস্যদের পক্ষে ‘হেবিয়াস কর্পাস’ আবেদন করতে সাহায্য করছেন। আদালতে পরবর্তী শুনানির সময়ে আবেদনকারী বা তাদের আত্মীয়রা বিচারকের সামনে হাজির হতে পারে।

শ্রীনগর আদালতে তারিক নামে আরেক ব্যক্তি জানান গত ৭ আগস্ট গ্রেফতার হওয়া শ্বশুরের জন্য আইনজীবী খুঁজছেন তিনি। তিনি বলেন, ৬৩ বছর বয়সী মানুষটিকে মধ্যরাতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে গিয়ে কয়েক দিন স্থানীয় থানায় আটকে রাখে। পরে তাকে শ্রীনগর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তারিক বলেন, তিনি জামাত-ই-ইসলামির (কাশ্মিরে দিল্লির শাসনের বিরোধিতা করে দলটি) মতাদর্শ অনুসরণ করেন কিন্তু পাঁচ বছর ওই দল ছেড়ে দেন তিনি। তারিক বলেন, আমরা একমাস ধরে দৌড়ে বেড়াচ্ছি। তার দুটো অপারেশন হয়েছে।

শ্রীনগর উচ্চ আদালতের এই অচলাবস্থা সুপ্রিম কোর্টে তোলা হয়েছে। এমনকি প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ ঘোষণা করেছেন, সংবাদমাধ্যমে যেরকম বাজে পরিস্থিতির খবর প্রকাশিত হচ্ছে তা সত্যি কিনা তা প্রত্যক্ষ করতে শ্রীনগর সফর করতে পারেন তিনি। তবে এখনও সফরের দিন ঠিক করেননি তিনি।

তবে আদালতের অচলাবস্থায় ভারতের বিভিন্ন কারাগারে আটক থাকতে বাধ্য হচ্ছে হাজার হাজার কাশ্মিরি। কাশ্মির বার অ্যাসোসিয়েশনের আইনজীবী মুদাচ্ছির বলেন, সাধারণত একটি হেবিয়াস কর্পাস আবেদন উপস্থাপনের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আদালত নোটিশ জারি করে আর চতুর্থ কর্মদিবসের আগেই রাজ্য সরকারকে তার জবাব দিতে হয়। তার ১৫ দিনের মধ্যেই মামলার সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। এখন এই প্রক্রিয়া সপ্তাহ, মাস এমনকি বছরও লেগে যেতে পারে।

নিজেদের কাজ চালিয়ে যেতেও সমস্যাও পড়ছেন আইনজীবীরা। সিনিয়র আইনজীবী রফিক বাজাজ বলেন, ‘আমরা ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। শুরুর দিকে স্ট্যাম্প ও কাগজের ঘাটতি ছিলো। আমরা সাধারণ সাদা কাগজে জামিন আবেদন লিখেছি। মানুষ বহু দূর থেকে পায়ে হেটে থানায় আসে তথ্যের জন্য। আবেদন লিখতে স্টেনোগ্রাফারেরও সংকট আছে। ইন্টারনেট না থাকায় আমরা আটকের কারণও জানতে পারছি না’। পরিণতি যাই হোক না কেন আদালত বর্জন অব্যাহত থাকবে বলে জানান এই সিনিয়র আইনজীবী। তিনি বলেন, এটা অধিকার ও পরিচয়ের প্রশ্ন। বাংলাট্রিবিউন