সহকারী জজ ছগির আহমেদ টুটুল

প্রসঙ্গ: ফৌজদারী আদালত, শ্রেণীবিভাগ ও দন্ড আরোপের ক্ষমতা

ছগির আহমেদ টুটুল:

আমরা জানি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ফৌজদারী বিচার ব্যবস্হার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ফৌজদারী আদালত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৪ অনুযায়ী বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট দুইটি বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত। যথা-হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপীল বিভাগ। এখন প্রশ্ন হলো হাইকোর্ট বিভাগ কি তার আদি এখতিয়ার প্রয়োগ করে কাউকে মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করতে পারবেন। আরো সহজ করে বললে হাইকোর্ট বিভাগ বিচারিক আদালত হিসেবে কাউকে মৃত্যুদন্ড কিংবা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করতে পারবেন কিনা। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১০- এ বলা হয়েছে, সংবিধান ব্যাখ্যার সাথে জড়িত জনগুরুত্বপূর্ণ মামলা হাইকোর্ট বিভাগ অধস্তন আদালত থেকে প্রত্যাহার করে এনে নিজে স্বয়ং মীমাংসা করতে পারবেন। তার মানে এক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগ বিচারিক আদালত হিসেবে জনগুরুত্বপূর্ণ মামলা মীমাংসা করতে পারবেন। এছাড়াও বিশেষ আইনে বিশেষ ফৌজদারী আদালত গঠিত হতে পারে। যেমন-নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে গঠিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল একটি ফৌজদারী আদালত। সুপ্রীম কোর্ট এবং বিশেষ আইনে গঠিত ফৌজদারী আদালত ব্যতীত দুই শ্রেনীর ফৌজদারী আদালত রয়েছে। যথা- (১) দায়রা আদালতসমূহ (২) ম্যাজিস্ট্রেট আদালতসমূহ [ধারা-৬(১)]

ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা-৬ অনুযায়ী ফৌজদারী আদালতের শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে,উচ্চ আদালত[সুপ্রীম কোর্ট] ব্যতীত দুই শ্রেনীর ফৌজদারী আদালত রয়েছে। (১) দায়রা আদালতসমূহ (২)ম্যাজিস্ট্রেট আদালতসমূহ [ধারা-৬(১)]

ম্যাজিস্ট্রেট দুই প্রকার। যথা-(১) জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (২) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট [ধারা-৬(২)]। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন নিয়োগ দিয়ে থাকে। আর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়ে থাকেন।

মহানগর এলাকার বাহিরে চার ধরণের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত রয়েছে। যথা- (১) চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত (২) প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালত (৩) দ্বিতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালত (৪) তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালত [ধারা-৬(৩)]। বাস্তবিকপক্ষে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটকে বলা হয় সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। আর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটকে বলা হয় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটকে মহানগর এলাকায় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বলা হয়। এই কথাটি বলা আছে ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা- [৬(৩)(b)]-তে।

মহানগর এলাকায় দুই ধরণের ম্যাজিস্ট্রেট আদালত রয়েছে। (১) চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। (২) মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত [ধারা-৬(৩)] আমরা আগেই জেনেছি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট ও বলা হয়।

চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা-৩২ অনুযায়ী একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারেন। চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু তারা সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করতে পারেন। এক্ষেত্রে তাদেরকে বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট বলা হবে। বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটদের দন্ড আরোপের ক্ষমতা [ধারা-২৯(গ) +ধারা-৩৩(ক)]ধারা অনুযায়ী নির্ধারণ করা হবে। ফৌজদারী কার্যবিধির ২৯(গ) ধারায় বলা হয়েছে, সরকার হাইকোর্ট বিভাগের সাথে পরামর্শ করে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অথবা চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে মৃত্যুদন্ড ছাড়া সকল অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা অর্পণ করতে পারবে। ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৩(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ২৯(গ) ধারা ক্ষমতাবলে বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট [চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট] মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ৭ বছরের অধিক কারাদণ্ড ব্যতীত আইনে অনুমোদিত যেকোন কারাদণ্ড প্রদান করতে পারবেন। তার মানে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড প্রদান করতে পারবেন। ফৌজদারী কার্যবিধি অনুযায়ী প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটরা ৫ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড প্রদান করতে পারবেন। কিন্তু সরকার বিশেষ ক্ষমতা দিলে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটরা ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড প্রদান করতে পারবেন। আর সরকার কর্তৃক এই বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বলা হয়। আশা করি বিষয়টা আপনাদেরকে পরিষ্কারভাবে বুঝাতে সক্ষম হয়েছি। ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা-৬ এর উপধারা-৩ এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বলতে অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে ও অন্তর্ভুক্ত করবে। তার মানে অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড প্রদান করতে পারবেন।

ফৌজদারী কার্যবিধির ৯ ধারাতে দায়রা আদালত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, দায়রা আদালতে তিন ধরণের জজ থাকে। তারা হলেন দায়রা জজ, অতিরিক্ত দায়রা জজ এবং যুগ্ম দায়রা জজ। দায়রা আদালতের সর্বোচ্চ বিচারক হলেন দায়রা জজ। একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন। দায়রা আদালত হলো এক বা একাধিক জেলা নিয়ে গঠিত দায়রা বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ ফৌজদারী আদালত। দায়রা আদালত [Court of Session] মহানগর এলাকায় মহানগর দায়রা আদালত [Metropolitan Court of Session] নামে পরিচিত। ফৌজদারী কার্যবিধির ৩১ ধারাতে দায়রা আদালতের দন্ড প্রদানের ক্ষমতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, দায়রা জজ এবং অতিরিক্ত দায়রা জজ আইনে অনুমোদিত হয়ে যেকোন দন্ড দিতে পারবে। তবে দায়রা জজ এবং অতিরিক্ত দায়রা জজ মৃত্যুদন্ড দিলে হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন নিয়ে তা কার্যকর করতে হবে। আর যুগ্ম দায়রা জজ সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড দিতে পারবে। দায়রা আদালতের বিচারকদেরকে সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিবেন। সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগীয় পদে দায়িত্বপালনকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিবেন। যেহেতু দায়রা জজ, অতিরিক্ত দায়রা জজ এবং যুগ্ম দায়রা হলো বিচার বিভাগীয় পদ, তাই রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তাদেরকে নিয়োগ দিবেন।

পরিশেষে বলতে চাই, ফৌজদারী কার্যবিধির ৩২ ধারা অনুযায়ী দ্বিতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট অনধিক ৩ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ড প্রদান করতে পারবে। আর তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট অনধিক ২ বছরের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা প্রদান করতে পারবে। আর বাস্তবিকপক্ষে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটকে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বলা হয়।

লেখক: সহকারী জজ, শরীয়তপুর।