প্রসঙ্গ গ্রেফতারকৃত শিশু অভিযুক্ত ও শিশু আদালত: একটি সাংবিধানিক অসামঞ্জস্যতার প্রশ্ন

রাজীব কুমার দেব:

সাংবিধানিক প্রাধান্যতা সংবিধানের একটি মৌলিক নীতি। সাংবিধানিক প্রাধান্যতা ও সাংবিধানিক কাঠামোর আলোকেই প্রতিটি আইন প্রণীত হয়। প্রণীত আইন বা আইনের কোন নীতি যদি সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবে সংবিধান সেই অসামাঞ্জস্যতাকে চ্যালেঞ্জ করারও বিধান রেখেছে। অপরদিকে প্রণীত ও কার্যকর আইন যতই মন্দ হোক না কেন এর বিধি বিধান অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালিত হতে হবে- অসামঞ্জস্যতার অজুহাত দেখিয়ে এর প্রতিপালন হতে বিরত থাকা যাবে না।

সাংবিধানিক প্রাধান্যতা ও সংঘর্ষ কিংবা অসামঞ্জস্যতার প্রশ্নকে সামনে রেখে যদি ১৯৭২ সনের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩(২) ও ২০১৩ সনের শিশু আইনের ধারা ৫৪(৪) বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে সাংবিধানিক ও আইনি তর্ক স্পষ্ট হয়ে উঠে।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩(২) অনুসারে গ্রেপ্তারকৃত প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থাপন করতে হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাঁকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাবে না। অপরদিকে শিশু আইনের ধারা ৫২(৪) অনুসারে গ্রেপ্তারকৃত অভিযুক্ত শিশুকে নিকটস্থ শিশু আদালতে উপস্থাপন করতে হবে। সংবিধান ও শিশু আইনে “ফোরাম অব ল” একই না হওয়ায় অর্থাৎ গ্রেফতারকৃত শিশু কে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থাপন না করে শিশু আদালতে উপস্থাপনের বিধান থাকায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেঃ-

প্রথমত: ২০১৩ সনের শিশু আইনের ধারা ৫২(৪) কি সংবিধানের সাথে অসামাঞ্জস্যপূর্ণ?

দ্বিতীয়ত: অধঃস্তন আদালত কি এটাকে “অসামঞ্জস্যতা” বিবেচনায় নিয়ে শিশু আইনের বিধান প্রতিপালন হতে বিরত থাকতে পারে?

প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে মহামান্য উচ্চাদালতই নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণে “অসামঞ্জস্যতা” বা “সাংবিধানিক সংঘর্ষের বিষয়ে” নিষ্পত্তি করবেন। মহামান্য হাইকোর্ট সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে সাংবিধানিক অসামঞ্জস্যতা বাতিল করতে পারেন। তাই শিশু আইনের ধারা ৫২(৪) কে চ্যালেঞ্জ করা হলে তখনি মহামান্য হাইকোর্ট তার সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করে অসামঞ্জস্যতার বিষয়টি নিষ্পত্তি করবেন। তার আগে কোন অবস্থাতেই এই ধারার সাংবিধানিক অসামঞ্জস্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না।

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, অধঃস্তন আদালত আইন মেনে চলেন; সংবিধান নয়। আইন মানতে গিয়ে সাংবিধানিক সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি হলেও অধঃস্তন আদালতকে আইনের ব্ল্যাক লেটারসগুলো অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেই হবে। তাই একটি আইন কিংবা আইনের কোন বিধান সংবিধানের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক বা অসামঞ্জস্যতা হলেও এই অজুহাতে আইন প্রতিপালন থেকে বিরত থাকা যাবে না। তাই শিশু আইনের ধারা ৫২(৪) সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এই ধারণা কিংবা অজুহাতে শিশু আদালত এই ধারার প্রতিপালন থেকে বিরত থাকতে পারবে না। অর্থাৎ গ্রেফতারকৃত সকল শিশু অভিযুক্তকে শিশু আদালতেই উপস্থাপন করতে হবে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নয়; শিশু আদালতই সিদ্ধান্ত নিবেন তাকে জামিনে মুক্তি দিবেন নাকি শিশু সংশোধনাগারে পাঠাবেন।

যদি ধারণা করা হয় – গ্রেফতারকৃত শিশুকে কোন আদালতে উপস্থিত করা হবে তা মূখ্য বিষয় নয় – শিশুর কল্যাণের জন্য যা করার প্রয়োজন তাই করতে হবে – এই ধারণা আইনগত ও যৌক্তিক হবে না কেননা ম্যাজিস্ট্রেট বা শিশু আদালত যেখানেই উপস্থাপন করা হোক না কেন, তা কল্যাণ বা অকল্যাণের সাথে সম্পৃক্ত নয়। তা হবে “Constitutional Extravaganza” যা Cure করার উপায় থাকবে না।

অতি সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশনের (ফৌজদারী আপীল নং ৭৫৩৩/২০১৯) একটি বেঞ্চ শিশু আইন সুনির্দিষ্ট ভাবে প্রয়োগের লক্ষ্যে সাতটি নির্দেশনা দিলেও সেখানে ধারা ৫২(৪) এর সাংঘর্ষিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচিত হয়নি। যদিও উক্ত নজীরের এক নং সিদ্ধান্ত অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেট “নিত্য নৈমিত্তিক প্রয়োজনীয় আদেশ ও নির্দেশনা প্রদান করবেন”।

তবে সাংবিধানিক অসামঞ্জস্যতা ও আইনি ব্যত্যয় এবং সর্বোপরি নজীরের এক নং সিদ্ধান্ত বিবেচনায় গ্রেফতারকৃত শিশু অভিযুক্তকে আইনের প্রাথমিক (নির্বাহী পর্যায়) বিধি বিধান অনুসরণ করার পর ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থাপন করা হলে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট তাকে মাননীয় শিশু আদালতে ফরোয়ার্ড করলেও আইনের ব্যত্যয় হবে বলে মনে হয় না।

একটি বিষয় উল্লেখ করার মত বিধি বিধান মতে একজন ম্যাজিস্ট্রেট তার স্বীয় এখতিয়ারাধীন এলাকায় ২৪ ঘন্টাই বিচার সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। ফলে যে কোন সময় গ্রেপ্তারকৃত অভিযুক্তকে তার সামনে উপস্থাপন করলে তিনি আইনানুগ আদেশ দিতে পারেন। পক্ষান্তরে বিধি বিধান মতে শিশু আদালত প্রতি কার্যদিবসে (০৯-০৫ টা) বিচারিক কাজের নিমিত্তে প্রশাসনিক ও বিচারিক কাজ সম্পন্ন করে থাকেন কিন্তু এর পরবর্তী সময় বা সরকারি বন্ধের দিনে শিশু আদালতের প্রশাসনিক ও বিচারকাজ উভয়ই মুলতবি থাকে। কিন্তু মুলতবি সময়ে অর্থাৎ কার্যদিবসে বিকাল ৫.০০ টার পর অথবা সরকারি বন্ধের দিনে মাননীয় শিশু আদালতে প্রেরণ করা হয় বা উপস্থাপন করা হয়; তাহলে কি হবে?

উত্তরটি সংবিধান বা কোন আইনে নেই; উচ্চাদালতের সিদ্ধান্তেও নিষ্পত্তি হয়নি। অথচ বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটরা সাংবিধানিক সংঘর্ষ বা আইনি ব্যত্যয় বিবেচনায় না নিয়ে শিশুর কল্যাণের স্বার্থে আইনি ঝুকি নিজ কাধে নিয়ে নিত্তনৈমিত্তিক বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করে শিশু অভিযুক্তকে শিশু সংশোধনাগারে পাঠাচ্ছেন। হয়তো কোন একদিন কোন এক সময় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট আইনি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারেন – “কোন ক্ষমতা বলে তিনি শিশু অভিযুক্ত কে শিশু সংশোধনাগারে পাঠালেন”।

পরিশেষে আইনে “সাংবিধানিক অসামঞ্জস্যতা” বা “সাংবিধানিক সংঘর্ষ” প্রশ্নটি অনিষ্পন্ন রেখে যতই শিশুর কল্যাণের পক্ষে বলা হোক না কেন, Constitutional Procedural Defect ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় Physical obstruction নিয়ে আসে। তাই যত দ্রুত সম্ভব সাংবিধানিক প্রশ্নটি সংশোধনী বা উচ্চাদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।

লেখক: জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট; চকরিয়া চৌকি আদালত, কক্সবাজার।