হাইকোর্ট ও মানবাধিকার কমিশন
হাইকোর্ট ও মানবাধিকার কমিশন

হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ: দায়িত্ব বুঝেও ঘুমাচ্ছে মানবাধিকার কমিশন

আইনের অধীনে দায়িত্ব বোঝার পরও কমিশন (জাতীয় মানবাধিকার কমিশন) ঘুমাচ্ছে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ‘একজন মানুষ যদি ঘুমিয়ে থাকে, তাহলে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা যায়। কিন্তু একজন মানুষ যদি ঘুমের ভান করে অর্থাৎ জেগে জেগে ঘুমায় তা হলে তাকে ডেকে তোলা যায় না। অথচ আইনের অধীনে দায়িত্ব বোঝার পরও কমিশন (জাতীয় মানবাধিকার কমিশন) ঘুমাচ্ছে।

মিরপুরের গৃহকর্মী খাদিজাকে নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের করা রিটের ওপর রায় ঘোষণার সময় সোমবার (১১ নভেম্বর) হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এমন পর্যবেক্ষণ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন।

আদালতে রায় ঘোষণার সময় মানবাধিকার সংগঠন চিলড্রেন চ্যারিটি অব বাংলাদেশের করা রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম। তাকে সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান।

আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলেছেন, মানবাধিকার কমিশনকে মনে রাখতে হবে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কমিশন যখন হস্তক্ষেপ করে বা শুনানি গ্রহণ করে তখন কমিশন আধা বিচারিক কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করে। তাই তাদের ন্যায়বিচার ও আইনের বিধিবিধান প্রতিপালন করতে হবে।

পর্যবেক্ষণ ছাড়াও এ মামলার রায়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতি কয়েকটি নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট।

নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে-

  • মানবাধিকার কমিশন মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অভিযোগ নিষ্পত্তির বিষয়ে যে খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে সেই বিধিমালাটি সুশীল সমাজের পরামর্শ নিয়ে যথাযথ সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।
  • কমিশনকে আইনের ১৬ ধারা অনুসারে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।  এই ১৬ ধারা অনুসারে কমিশন দেওয়ানী আদালতের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে এবং তদন্ত বা অনুসন্ধানের স্বার্থে সাক্ষী তলব করতে, নথি তলব তলব বা জামিনযোগ্য পরোয়ানাও ইস্যু করতে পারে।
  • যদি কমিশনের কোনো সুপারিশ সরকার মান্য না করে তাহলে সংশ্লিষ্ট কমিশন আইনের ১৯ ধারা এবং সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিকার চাইতে হাইকোর্টের নজরে আনতে হবে।
  • কমিশন থেকে যেসব আদেশ দেয়া হয় সেসব আদেশের সত্যায়িত অনুলিপি ৩০ দিনের মধ্যে ইস্যু করতে বলা হয়েছে।  এমন মানবাধিকার কমিশনের অভিযোগ নিষ্পত্তিতে তাদের পদ্ধতিগুলো নির্ধারণ করে নিতে হবে।
  • কমিশনে কোনো অভিযোগ আসার পর তা যেন একজন ব্যক্তির স্বাক্ষরে নিষ্পত্তি বা আদেশ দেওয়া না হয়।  কমিশন আইনের ১১(৩) বা ২৮ ধারার নিয়ম অনুসারে যথাযথ ক্ষমতা প্রয়োগ করে আদেশ প্রদানকারীদের নাম ও পরিচয় লিখতে হবে।
  • খাদিজার বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনকে ৬০ দিনের মধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ সময়ে খাদিজা ও পরিবারের বক্তব্য শুনে খাদিজার মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেলে কমিশনের ১৯ ধারা অনুসারে অন্তর্বর্তীকালীন ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারকে সুপারিশ করতে হবে।

রায় ঘোষণার পর ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম সাংবাদিকদের বলেন, রায় ঘোষণার সময় আদালত বলেছেন, এতদিনে হয়ত পুলিশ খাদিজার পরিবারকে পক্ষপাতদুষ্ট করে ফেলেছে, যেটা প্রতিবেদনে দেখা গেছে।  ওই প্রতিবেদনে খাদিজার কোনো অভিযোগ নেই এবং তার বাবা সংক্ষুব্ধ নন।  এ কারণে আদালত বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এবং হতাশা প্রকাশ করেছেন।

আদালতের বরাত দিয়ে আব্দুল হালিম আরও জানান, পাঁচ বছর পরে একজন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বসে থাকবে না। পুলিশ ইতিমধ্যে তাদের পক্ষপাতদুষ্ট করে ফেলেছে। এরপরও যেহেতু বিষয়টি মানবাধিকার কমিশনে গিয়েছে, তাই কমিশনের এখনো অনেক কিছু করণীয় আছে। তাই কমিশনকে খাদিজার অভিযোগ পর্যালোচনা করে ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারকে সুপারিশ করতে বলা হয়েছে।

এর আগে ২০১৩ সালে রাজধানীর মিরপুরে গৃহকর্মী খাদিজাকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। ওই প্রতিবেদন সংযুক্ত করে মানবাধিকার সংগঠন চিলড্রেন চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি পাঠানো হয়। এরপর পাঁচ বছর কেটে গেলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদন করা হয়।

ওই রিটের শুনানি নিয়ে গত ৯ জানুয়ারি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। এছাড়াও গৃহকর্মী খাদিজাকে নির্যাতনের ঘটনায় কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা জানাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিবকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিব, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল। যার ধারাবাহিকতায় দীর্ঘদিন পর মামলাটির রুলের ওপর শুনানি শেষে রায় ঘোষণা করলেন হাইকোর্ট।