অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

মিথ্যা ধর্ষণ মামলায় এবার এক নারীর কারাদণ্ড বনাম বাস্তবতা!

সিরাজ প্রামাণিক:

সিরাজগঞ্জে ধর্ষণের মিথ্যা মামলা করায় এক নারীর ৫ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদন্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। গত বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সিরাজগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক ফজলে খোদা মো. নাজির এ রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার সময় ওই নারী আদালতে উপস্থিত ছিলেন। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের ২৪ অক্টোবর কামারখন্দ উপজেলার এক নারী একই গ্রামের পাঁচজনের বিরুদ্ধে গণধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন। আদালতে গণধর্ষণের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। পরে তাদের একজন বাদী হয়ে ওই নারীর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭ ধারায় মামলা করলে বিচার শেষে বিচারক ওই নারীকে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, ২০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদণ্ডে দন্ডিত করেন।

ওই আইনের ১৭ ধারায় বলা আছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ আইনের অন্য কোনো ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ না জেনেও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করে বা করায় তাহলে মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারী ব্যক্তি এবং যে অভিযোগ দায়ের করিয়েছে ওই ব্যক্তি অনধিক সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে। উপধারা (২) মতে, কোনো ব্যক্তির লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল উপধারা (১)-এর অধীন সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ ও মামলার বিচার করতে পারবে।

দেশের ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনের অপরাধগুলোর কঠোর শাস্তিবিধানের জন্য ১৯৮৩ সালে প্রথম নারী নির্যাতন (নিবর্তক শাস্তি) অধ্যাদেশ নামে একটি আইন জারি করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন নামে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা হয় এবং এর মাধ্যমে ১৯৮৩ সালের অধ্যাদেশটি রহিত করা হয়। পরে মামলা পরিচালনাকালে এ আইনেরও কিছু সীমাবদ্ধতা, অসঙ্গতি ও ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হওয়ায় ২০০০ সালে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন পাস করা হয়। পাশাপাশি ১৯৯৫ সালের ‘নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন’টি বিলুপ্ত করা হয়। ২০০০ সালের আইনটিই বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের জন্য প্রচলিত আইন হিসেবে বলবৎ আছে। এরপর অবশ্য ২০০৩ সালে আইনটিতে সংশোধনী আনা হয়েছে।

কিন্তু আইনটির কঠোরতাকে পুঁজি করে প্রতিপক্ষকে হয়রানির উদ্দেশ্যে বহু মিথ্যা মামলা দায়ের হচ্ছে মর্মে অভিযোগও উঠছে দেশজুড়ে। মামলা দায়েরের পর তদন্তের জন্য প্রেরণ করা হলে আগে থেকেই শিখিয়ে-পড়িয়ে নেয়া লোকজন দিয়ে একতরফা জবানবন্দি প্রদানের মাধ্যমে মামলাটি আমলে নেয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পাদন করা হয়। এরপর ট্রাইব্যুনাল মামলাটি আমলে নিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত আসামি জানতেও পারে না যে প্রতিপক্ষ তার বিরুদ্ধে আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে এ মামলায় তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডও হতে পারে।

বাংলাদেশে পুলিশ বলছে নারী নির্যাতনের মামলার আশি শতাংশরই কোন প্রমাণ মেলেনা। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলায় জামিন পাওয়া সহজ নয় বলে অনেকে এর অপব্যবহার করছেন। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, “যারা ফ্যব্রিকেটেড মামলা দেন তাদের জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটা বড় সুবিধা হল যে এই আইনে জামিন পেতে বেগ পেতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে জামিন পাওয়া যায়। তবে মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে আসামিকে জেলে থাকতে হয়। ফলে অনেকে অনেকে পালিয়ে থাকে। খুব দ্রুততম সময় এই মামলায় হয়রানি করার একটা সুযোগ রয়েছে। মামলা করার পর প্রতিপক্ষ যে একটা চাপে থাকে, হেনস্তা হয় সে কারণে যাদের সাথে বিবাদ তারা হয়ত আপোষ করে ফেলে।”

বিবিসি’র এক জরিপ বলছে, বাংলাদেশে জমিজমা সংক্রান্ত মামলাই সবচাইতে বেশি হয়ে থাকে। জমিজমার মামলা সময় সাপেক্ষ হয়। প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবেও অনেক সময় নারী নির্যাতনের মামলা জুড়ে দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক খন্দকার ফারজানা রহমান বলছেন, এমন মিথ্যা মামলা মূলত হচ্ছে নানা জনের বুদ্ধিতে। তবে আইনজীবীরাই অনেক ক্ষেত্রে মন্ত্রণাদাতা বলেন তিনি। তিনি বলছেন, “মন্ত্রণাদাতা প্রথমত হচ্ছে পরিবারের মানুষজন। পরিবারের আত্মীয়-স্বজন। কিন্তু এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে উকিল। মানুষ যখন মামলা করে শুরুতেই কিন্তু একজন উকিলের কাছেই যায়। অনেক সময় উকিলের কথায়ও এমন মামলা হয়।”

সুতরাং, মিথ্যা মামলা বা অভিযোগের শিকার হলে বিবাদী আইনের মধ্যে থেকেই আদালতে লিখিত পিটিশন দায়ের করার মধ্য দিয়ে প্রতিকার পেতে পারে। মিথ্যা মামলা বা অভিযোগের দায়ে অপরাধীর সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। নারী নির্যাতন ঠেকাতে উল্লিখিত আইনটি যথার্থভাবে প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হোক, কোনো নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার না হোক সেটাই সবার প্রত্যাশা। ১৭ ধারার প্রতিকার কিভাবে ফলপ্রসূ করা যায় তা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email: seraj.pramanik@gmail.com