অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা যুথী

‘কর্মভেদে নারী-পুরুষ আলাদা আলাদা যোগ্যতা রাখে, এমনটা ভাবিনা’

অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা যুথী। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। বর্তমানে রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ল’ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন (রুলা) এর সভাপতির দায়িত্বে আছেন। এছাড়াও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। নেতৃত্বগুণে গুণান্বিত ও স্বাচ্ছন্দ্যে চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত এই নারী আইনজীবীর মুখোমুখি হয়েছিল ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের সম্পাদক ড. বদরুল হাসান কচি। আলোচনায় উঠে এসেছে তাঁর ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও আইন-আদালতের নানা বিষয়। ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ তুলে ধরা হল-

ইয়ার্স ক্লাব: প্রথমে আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে চাই- পড়াশুনা, পরিবার…

অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা: ব্যক্তিগত জীবন বলতে, আমার বাবা ছিলেন পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষক। পরবর্তীতে নওগাঁ কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বপালন শেষে অবসরে যান। মা ছিলেন গৃহিণী। বাবা-মা এবং দুইবোন এক ভাইয়ের পরিবার আমাদের। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছি। এখন আইন পেশায় নিয়োজিত আছি। এইতো…

ইয়ার্স ক্লাব: আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলেন নিজের ইচ্ছেতে নাকি পরিবারের?

অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা: আইন পড়েছি নিজের ইচ্ছাতেই। তবে নানার অনুপ্রেরণা ছিল। নানা খুব আদর করতেন। উনার (নানার) ব্যবসা ছিল। তিনি বলতেন, ‘তুমি ল’ইয়ার হলে এখানে বসবা, এখানে প্র্যাকটিস করবা।’ ছোটবেলা থেকেই আমি খুব চটপটে ছিলাম, কথাবার্তা একটু বেশি বলতাম (মৃদু হাসি)। আমাদের পরিবারে কেউ ল’ইয়ার ছিল না। তবে নানার ওই কথাটা আমার মাথায় ভালোভাবে গেঁথে গিয়েছিল। বাবা ভেবেছিলেন শিক্ষক হব কিন্তু আমি নানার উৎসাহে আইন পড়েছি।

ইয়ার্স ক্লাব: দলীয় প্যানেলে বারের নির্বাচন করেছেন, রাজনীতি তো নিশ্চয়ই করেন। কখন, কিভাবে জড়ালেন রাজনীতিতে?

অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা: কলেজ জীবনে রাজনীতির সুযোগ ছিলনা। রাজনীতি শুরু করেছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সময়। শুরুটা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আইন বিভাগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে। যদিও কার্যক্রম পরিচালনা করা তখন প্রায় অসম্ভব ছিল। কেননা সে সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের তাণ্ডব চলত। সে সময় শিবির সদস্যরা সাতজনকে রগ কেটে হত্যা করল, এ ঘটনায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে গেল। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আর রাজনীতিতে যুক্ত হইনি।

এরপর সুপ্রিম কোর্টে এসে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হই। ২০০১ সালে প্রথম সহ-সম্পাদক পদে নির্বাচন করি। তখন ডুয়েল ভোটিং সিস্টেম চালু ছিল। প্রথম দিনের ভোটে আমি দেড়শ ভোটে এগিয়ে থাকলেও দ্বিতীয় দিনের সিঙ্গেল ভোটে আমাকে হারানো হলো। হেরে যাওয়ার পর আমার সিনিয়ররা পরামর্শ দিলেন যারা আমাকে ভোট দিয়েছেন তাদেরকে যেন আমি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি।  আমাকে যারা ভোট দিয়েছেন তাদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে গিয়ে আমি ধন্যবাদ জানিয়েছি। এখান থেকে আমি শিক্ষা পেয়েছি পরাজিত হলেও কৃতজ্ঞ হতে হয়। এরপর পারিবারিক কারণে কিছুদিন বিদেশে ছিলাম। ফিরে এসে আবার নির্বাচন করতে আগ্রহী হই। এক-এগারোর সময় ফের সহ-সম্পাদক পদে নির্বাচন করতে চাইলেও সংগঠনের নীতি-নির্ধারকেরা আমাকে কোষাধ্যক্ষ (ট্রেজারার) পদে মনোনয়ন দিলেন এবং আমি প্রায় পৌনে চারশ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হই।

ইয়ার্স ক্লাব: এক-এগারোর রাজনৈতিক সংকটকালে বারের নেতৃত্বে ছিলেন, তখন কোন চাপ মোকাবেলা করতে হয়েছে কি?

অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা: হ্যাঁ, অনেক চাপ মোকাবেলা করতে হয়েছে, এমনকি আমার বিরুদ্ধে হয়রানীমূলক মিথ্যা ফৌজদারি মামলা হয়। কারণ এক-এগারোর সেই কলঙ্কিত সময়ে মার্শাল ল’ কে চ্যালেঞ্জ করে আমি’সহ সুপ্রিম কোর্টের তিন ট্রেজারার মামলা করেছিলাম। এছাড়া রাজপথের আন্দোলনে তো ছিলামই।

ইয়ার্স ক্লাব: ব্যস্ত ওকালতি সত্ত্বেও মাঝে কিছু সময় দেশের বাহিরে ছিলেন, আবার চলে যাবেন, নাকি এবার পাকাপোক্তভাবে থাকছেন?

অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা: হ্যাঁ, ব্যক্তিগত কারণে বেশকিছু দিন দেশের বাহিরে ছিলাম, তবে এবার আর কোথাও যাচ্ছি না, হা হা হা… (হাসি)। সাথে আরেকটু কথা যুক্ত করতে চাই, বিদেশে থাকলেও যতবার দেশে বেড়াতে এসেছি কোর্টে কিন্তু এসেছি। আমি কখনোই কোর্ট বিমুখ ছিলাম না। কোর্টের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আত্মিক। বলা যায় কোর্টের সঙ্গে আমার এই অন্তরঙ্গ সম্পর্কই আবার আমাকে দেশে ফিরিয়েছে।

ইয়ার্স ক্লাব: সমাজে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়, আপনিও কি এমন কোন বাঁধার মুখে পড়েছেন?

অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা: তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে কিছু প্রতিবন্ধকতা তো থাকেই। তবে আমার সামনে তেমন কোন বাঁধা আসেনি। অনেকেই বলেন নিম্ন আদালতে নারী আইনজীবীর জন্য কাজটা কঠিন। আমার পথচলা জজকোর্ট থেকে শুরু হয়েছে। জজ কোর্ট আমার খুবই ভালো লাগতো, সেখানে কোন সমস্যার সম্মুখীন হইনি। এরপর হাইকোর্টে এলাম। এখানেও অনেকে মনে করেন কোর্টের পরিবেশ ভালো না, কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি এমন কিছুই দেখিনি। সত্যি বলতে আমার কাছে সর্বদা মনে হয়েছে আমি সামনে এগিয়ে গেলে পথ আপনাআপনি তৈরি হবে। ‘যাই হোক না কেন এগিয়ে যেতে হবে’ এই মানসিকতা আমাকে সাহায্য করেছে।

ইয়ার্স ক্লাব: আপনি আইনজীবী বলেই কি নারী হিসেবে আপনার পথচলা সুগম হয়েছে?

অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা: দেখুন, কোর্টের বাহিরে কিন্তু আমি আইনজীবী নেমপ্লেট লাগিয়ে ঘুরছি না। মূল ব্যাপার হচ্ছে মনোবল, আত্মবিশ্বাস, সঠিক সিদ্ধান্ত এবং পরিবেশের সাথে কীভাবে চলতে হবে সে বিষয়গুলোই চলার পথে পাথেয় হিসেবে কাজ করে।

ইয়ার্স ক্লাব: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সংগঠন রুলার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন, নিশ্চয়ই এটি বড় দায়িত্ব; আমরা তার আগেও দেখেছি আপনি বারের কোষাধ্যক্ষের গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। নারী হয়েও আপনি এমন চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব কীভাবে মোকাবেলা করছেন?

অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা: কর্মভেদে নারী-পুরুষ আলাদা আলাদা যোগ্যতা রাখে আমি এমনটা ভাবিনা। আমার কাছে মনে হয় দায়িত্বগ্রহণের পর সেটা সততা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করাটা জরুরী। নারী কিংবা পুরুষ হওয়ার বিষয়টা নয়। আর যেকোন দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তো থাকবেই। সে নারী হোক কিংবা পুরুষ। তাছাড়া আমি চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করি। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কোষাধ্যক্ষ কিংবা রুলার প্রেসিডেন্ট হবার পরেই আমি জানতে পেরেছি এসব পদে এর আগে কোন নারী দায়িত্বপালন করেনি।

ইয়ার্স ক্লাব: বারের ট্রেজারার, রুলার প্রেসিডেন্ট বা নারীদের হাতে নেতৃত্ব যায়নি এ ধরনের পদে কি সুযোগের অভাব নাকি নারীরা আসতে চান না?

অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা: দেখুন কেউ কাউকে সুযোগ করে দেবে না। সুযোগ নিজেকেই সৃষ্টি করতে হয়। এসব পদে না আসার মানসিকতাই বরং নারীদের পিছিয়ে রেখেছে।

ইয়ার্স ক্লাব: ইতিপূর্বে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক পদেও কোন নারীকে দেখা যায়নি, ভবিষ্যতে বারের নেতৃত্বে আপনাকে দেখা যাবে কি?

অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা: আসলে নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য স্থির করা নেই। তবে সুযোগ আসলে আমি অবশ্যই পিছপা হবনা। এরমানে এই না যে কেউ আমাকে সুযোগ করে দেবেন আর আমি তা লুফে নেব! আমি আমার মতো করে কাজ করে যাচ্ছি। আমি বিশ্বাস করি আমার কর্মকান্ডই আমাকে সে সুযোগ এনে দেবে। সত্যি কথা বলতে বারে এখন পর্যন্ত নারী সম্পাদক হয়নি। সেজন্য এব্যাপারে আমার আগ্রহ আছে টু বি ফ্র্যাংক। কারণ এখন সময় পাল্টে গেছে। প্রধানমন্ত্রী, স্পীকারসহ রাষ্ট্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দেশের মানুষ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন মনের দিক থেকে অনেক বেশি প্রগতিশীল এবং আধুনিক।

ইয়ার্স ক্লাব: গণপরিবহণ, কর্মক্ষেত্র, পরিবারসহ নানা জায়গায় নারীরা শারীরিক না হয় মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে বলে অভিযোগের শেষ নেই, কাজের ক্ষেত্রে আইনাঙ্গন নারী জন্য কতটুকু নিরাপদ, নাকি এখানেও হতাশা, ক্ষোভ আছে?

অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা: গণপরিবহণ, কর্মক্ষেত্র, পরিবারসহ যেখানেই এ ধরণের ঘটনা ঘটে, নারীদের মধ্যে তা প্রটেস্ট করার বিষয়টা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায়না। অনেকেই লজ্জাসহ সামাজিক নানা বিষয় বিবেচনা করে চুপ থাকেন। তখনই যদি এ ধরণের কর্মকাণ্ড চ্যালেঞ্জ করা হয় তাহলে কিন্তু এমন সমস্যা ক্রমশ হ্রাস পাবে। এছাড়া এসব বিষয়ের জন্য আইনগত রেমিডি থাকা উচিৎ বলে মনে করি। আর আদালত প্রাঙ্গণে এধরণের সমস্যা আছে বলে মনে হয়না।

ইয়ার্স ক্লাব: সংসার, রাজনীতি ও পেশা কীভাবে সমন্বয় করেন?

অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা: আমি অনেক বেশি কাজ করতে পারি। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠি। বাসার সব কিছু ঠিকঠাক করে কোর্টে আসি। বাসায় যদিও কোনো পার্মানেন্ট হেল্পিং হ্যান্ড নাই। কোর্টের কাজ শেষ করে মাঝেমাঝে বাজারও করি। আমার কাছে মনে হয় সময় ব্যবস্থাপনায় সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। তাহলেও সবকিছু সমন্বয় করে চলা যায়।

ইয়ার্স ক্লাব: একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি, সম্প্রতি আপনার স্বামী শেখ ফজলে শামস পরশ বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যানের নেতৃত্ব পেয়েছেন, ঠিক এমন এক সময়ে যখন এই সংগঠনের কিছু শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে নানান বিতর্ক চলমান; এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কি?

অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা: যুবলীগের প্রতিষ্ঠা শেখ মণি সাহেবের ছেলের হাতে সংগঠনের নেতৃত্বের ভার দেওয়া হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আমার ভেতর আশা জাগ্রত হয়। আস্থা-ভরসার জায়গা তৈরি হয়। আর উনি যেহেতু আমার স্বামী সেক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে আমি উচ্ছ্বসিত। উনি কিন্তু একদমই রাজনীতিতে জড়াতে চাইতেন না। কারণ ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্টের সেই ঘটনার জন্য নিজেকে রাজনীতি থেকে দূরে রেখেছেন। চার দশক পর বাবার প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের নেতৃত্ব ছেলের হাতে এসেছে। আশাকরি উনি ভালো কিছুই দিতে পারবেন। আমার খুব ভালো লেগেছে যে তিনি নেতৃত্বে এসেছেন। ৯৯ ভাগ নয় আমি শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারি তিনি সৎ একজন মানুষ। এছাড়া কাজের প্রতি একাগ্রতা এবং চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতা তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। পথভ্রষ্ট যুবসমাজকে একটি শুদ্ধ দিক নির্দেশনা তিনি দিতে পারবেন বলে বিশ্বাস করি। প্রত্যাশা করি তাঁর হাত ধরেই যুব রাজনীতিতে পরিশুদ্ধি আসবে, রাজনীতি বিমুখ সৎ, যোগ্য, মেধাবী যুবকেরা রাজনীতিতে যুক্ত হবে।

ইয়ার্স ক্লাব: আপনার মূল্যবান সময় থেকে কিছু সময় ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।

অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা: ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকেও ধন্যবাদ।