জুনাইদ হাফিজ (ডানে)

ধর্ম অবমাননার দায়ে পাকিস্তানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের মৃত্যুদণ্ড

পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননার দায়ে এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রভাষককে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। নবী মুহাম্মদ (স.) কে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অসম্মানসূচক মন্তব্য করায় শনিবার (২১ ডিসেম্বর ) পাকিস্তানের একটি আদালত তাকে এ সাজা দিয়েছে।

পাকিস্তানে ব্লাসফেমি বা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ খুবই গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। এই আইনের অধীনে কোনো ব্যক্তিকে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন করার জন্য কখনো কখনো শুধু অভিযোগই যথেষ্ট হয়।

জানা যায়, জুনাইদ হাফিজ নামের ওই ব্যক্তি ২০১৩ সালে ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরিফ ও হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে কটূক্তি করে পোস্ট দেন। এরপর ৩৩ বছর বয়সী জুনাইদ হাফিজকে ওই বছরের মার্চে গ্রেফতার করা হয়।

জুনাইদ হাফিজের পক্ষে তার প্রথম আইনজীবী ২০১৪ সালে এই মামলার দায়িত্ব নেয়ায় সে বছরই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কারাগারেও অন্যান্য কয়েদিরা জুনাইদ হাফিজের ওপর বেশ কয়েকবার আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করলে বেশ কয়েক বছর তাকে নির্জন কারাবাস ভোগ করতে হয়।

মুলতানের যেই কারাগারে মি. হাফিজকে আটক রাখা হয়েছে, সেই কারাগারের আদালতই তাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়।

মার্কিন সাহিত্য, ফটোগ্রাফি ও থিয়েটার বিষয়ে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে মাস্টার্স করেছেন জুনাইদ হাফিজ।

পাকিস্তানে ফিরে এসে গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি মুলতানের বাহাউদ্দিন জাকারিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষকের দায়িত্বে ছিলেন। হাফিজের বর্তমান কৌঁসুলিরা মন্তব্য করেছেন যে, এই রায় ‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক’। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছেন তারা।

রায় ঘোষণা হওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা তাদের সহকর্মীদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই রায়কে ‘অত্যন্ত হাতাশাজনক ও বিস্ময়কর’ বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের অধীনে যারা ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করে তাদেরকে মৃত্যুদণ্ডসহ কঠোর শাস্তি দেয়া হয়। ধর্ম সম্পর্কিত অপরাধ আইন ১৮৬০ সালে ভারতে বৃটিশ শাসকদের দ্বারা প্রথমবার বর্ণিত হয়। পরে ১৯২৭ সালে এটিকে আরো বিস্তৃত করা হয়।

১৯৪৭ সালে ভারত থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান এই আইনগুলো গ্রহণ করে। প্রাচীন আইন অনুযায়ী, কোনো ধর্মীয় সমাবেশে গন্ডগোল করা, অন্য ধর্মের সমাধিস্থানে প্রবেশ করা, ধর্মীয় বিশ্বাস অপমান করা বা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ধর্মীয় স্থান বা বস্তু ধ্বংস বা তার ক্ষতি করায় সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া যেতো।

কিন্তু ১৯৮০ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে সেনা শাসক জিয়াউল হকের সময় এই আইনে আরো বেশ কয়েকটি ধারা সংযুক্ত করা হয়। জেনারেল জিয়াউল হক পুরনো আইনটিকে ‘ইসলামিকরণ’ করে পাকিস্তানের সুন্নি মুসলিম ও আহমদিয়া সম্প্রদায়কে আইনিভাবে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানে আহমদিয়াদের অমুসলিম হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়।

আইন সংযুক্ত নতুন ধারায় ইসলামের কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য করাকে অবৈধ হিসেবে দেখা হয়। ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ কোরান অপবিত্র করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে এবং নবী মুহম্মদকে (স.) অবমাননা করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের বিধানের বিষয়গুলো সংযুক্ত করা হয়।

ব্লাসফেমির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রায় ৪০ জনকে এরই মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কারো মৃত্যুদণ্ডই কার্যকর করা হয়নি।

ব্লাসফেমির অভিযোগে পাকিস্তানের খ্রিস্টান নারী আসিয়া বিবি আট বছর কারাভোগ করার পর গত বছর মুক্তি পেলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়।

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আসিয়া বিবির দণ্ডাদেশ পরিবর্তিত হয়। আসিয়া বিবিকে কারাগার থেকে ছাড়া হলে তা পাকিস্তানে ব্যাপক সংঘাত তৈরি করে এবং আসিয়া বিবি অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।

পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশন নামের স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠন কয়েক দশক ধরে ব্লাসফেমির মামলাগুলো সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করছে। তাদের মতে, ব্লাসফেমি আইনের কারণে ভুক্তভোগীদের সিংহভাগই মুসলিম। সংখ্যায় মুসলিমদের পরেই রয়েছে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ।

পাকিস্তানের শান্তি ও বিচার বিষয়ক জাতীয় কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৭ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ৭৭৬ জন মুসলিম, ৫০৫ জন আহমদিয়া, ২২৯ জন খ্রিস্টান এবং ৩০ জন হিন্দুকে ব্লাসফেমি আইনের আওতায় অভিযুক্ত করা হয়েছে।