কাজী শরীফ; সহকারী জজ, নোয়াখালী

একজন আইনজীবীর উত্থানের পেছনের গল্প: শেষ পর্ব

কাজী শরীফ:

প্রথম পর্বে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের নিয়েই লেখায় বিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবীরা ভাবতে পারেন আমি নবীন বলে পক্ষপাতিত্ব করছি। বাস্তবে আমার পক্ষপাত সিনিয়র আইনজীবীদের প্রতি আরো বেশি!

সমাজে প্রচলিত অর্থে আইনজীবীদের যে প্রাচুর্য নিয়ে এত কথা বলা হয় সে প্রাচুর্যের মুখ দেখতে দেখতে একজন আইনজীবী আর নবীন থাকেন না। নিদেনপক্ষে তিনি আর মধ্যবয়স্কও থাকেন না। তিনি পড়ে যান প্রৌঢ়ের কাতারে। তখন তার খেতে মানা, শুতে মানা এমনকি কথা বলায়ও বাধ সাধেন ডাক্তারবাবু! আমার পরিচিত এক সিনিয়র আইনজীবী দু:খ করে বলেছিলেন – যখন আমার অঢেল টাকা তখন আমার হাজার মানা!

আইনজীবীদের আর একটি ব্যাপার অনেকেরই ভাবনার খোরাক যোগায় না। তা হলো বিয়ের বয়স ও এ সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়া। একজন আইনজীবী তার প্রথম জীবন কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেন। কিছুটা গুছিয়ে উঠে বিয়ে করতে করতে অবধারিতভাবে দেরি হয়ে যায়। অনেক আইনজীবী তার অন্য বিভাগে পড়া বন্ধুর মেয়ের বিয়ে খেতে যান তার সদ্য জেএসসি পরীক্ষা দেয়া ছেলেকে নিয়ে!

একজন আইনজীবী একসময় উপার্জন করেন খুব। কিন্তু সে উপার্জনের অর্থ উপভোগের সময় তার হয় না! আমি বলছিনা সব আইনজীবীর গল্প একই। অনেকেই সবকিছু ঠিক বয়সে ও ঠিক সময়েই করেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা হাতে গোনা।

আইনজীবীদের অবদান আমাদের গণমাধ্যমে উপেক্ষিত থাকে অধিকাংশক্ষেত্রে। সাম্প্রতিক নুসরাত কিংবা রাজন হত্যাকান্ডের দ্রুত বিচারপ্রক্রিয়া শেষ করার পেছনে যে বিচার বিভাগের অবদান আছে তা আমাদের গণমাধ্যমের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। যে আইনজীবী রাতদিন পরিশ্রম করে ন্যায়বিচার নিশ্চিতে অবদান রেখেছেন তার নামটাও উচ্চারিত হয়না!

একজন নির্দোষ ব্যক্তি কারাগারে অন্তরীণ অবস্থা থেকে যখন আইনজীবীর বাগ্মিতা, বুদ্ধিমত্তা ও যুক্তির জোরে মুক্তি পান তখন আইনজীবী হয়ে ওঠেন সাক্ষাৎ আল্লাহর প্রতিনিধি! আবার একজনের সারাজীবনের অর্জন যে সম্পত্তি তা কেউ জোর করে দখল করলে কিংবা তার সম্পত্তি কেউ অন্যের বলে দাবি করলে অথবা ফারায়েজ মতে পিতার সম্পত্তি না পেলে তা আদায় করতে যে ভদ্রলোক অক্লান্ত পরিশ্রম করেন তিনিই আইনজীবী। আপনি বলতে পারেন আইনজীবী অর্থের বিনিময়ে কাজ করেন। তাহলে তাকে এত কৃতিত্ব কেনো দিতে হবে? যে যুক্তিতে আপনি রোগমুক্ত হলে একজন চিকিৎসককে সম্মান করেন সে একই যুক্তিতে আপনি একজন আইনজীবীকেও সম্মান করবেন।

মক্কেল একজন আইনজীবীর কাছে এসে তার জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্দশার কথা বলেন। তা শুনে বিজ্ঞ আইনজীবী ঘটনাস্থল না দেখে কিংবা ঘটনা প্রত্যক্ষ না করে যেভাবে আদালতে উপস্থাপন করেন তাতে তাকে হতে হয় জাতশিল্পী! একজন শিল্পীকে সমাজ কি যথার্থ সম্মান দেয়?

আইনজীবীদের নিয়ে সমালোচনাও কম নয়। আরজি-জবাবে মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে মোকদ্দমাকে জটিল করা, পক্ষদের মধ্যে শত্রুতা আরো বাড়িয়ে দেয়া, দ্রুত মোকদ্দমা নিষ্পত্তিতে অনীহার মত অভিযোগ উড়িয়ে দেয়া যায়না।

সম্মানিত আইনজীবীদের মনে রাখতে হবে তাদের পেশার সম্মান তাদেরই বজায় রাখতে হবে। ন্যায়পরায়ণতা, সততা ও মক্কেলবান্ধব না হলে আদতে নিজের এবং পেশারই যে ক্ষতি তা বুঝলেই এসব অভিযোগ থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব।

আইনজীবীরা মানবিক হোক। সমাজ উদারভাবে আইনজীবীদের অবদান স্মরণ করুক। একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবীর অবস্থাকে বার কাউন্সিল বিবেচনা করুক ও জেষ্ঠ্য আইনজীবীরা তাদের অধীনদের প্রতি যৌক্তিক মমতা প্রদর্শন করুক।

তবেই বদলে যাবে আইনাঙ্গন। বিজ্ঞ আইনজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা।

লেখক: সহকারী জজ, নোয়াখালী