বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ

ইতিহাসের অবিস্মরণীয় এক কিংবদন্তি বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ

আতিক হেলাল:

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ কেবল উপমহাদেশের একজন স্বনামধন্য আইনবিদই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন যথার্থ সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্ব; যিনি বিচারপতির আসনে অধিষ্ঠিত থেকে সুযোগ সীমিত থাকা সত্ত্বেও নানা ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন।

মানবতাবাদী, সমাজহিতৈষী, আইনের শাসন ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার অন্যতম রূপকার এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম সার্কের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন তিনি। আজ তার ১০৯তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল তিনি ইন্তেকাল করেন।

সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় আইন পেশায় বাঙালি মুসলমানের প্রবেশ ঘটে অনেক বিলম্বে। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে পাশ্চাত্যে শিক্ষিত মুসলমান আইনজীবীর সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। অবিভক্ত বাংলায় স্যার সৈয়দ আমীর আলী কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম মুসলমান বিচারপতি নিযুক্ত হন ১৮৯০ সালে।

এরপর তার পুত্র সৈয়দ তারক আমীর আলীসহ আরও অনেক বাঙালি মুসলমান হাইকোর্টের বিচারপতি হন। সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। তৎকালীন হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে তার এ সম্মানজনক আসন গ্রহণের মধ্য দিয়ে তখনকার সমাজে বাঙালি মুসলমানদের জন্য উচ্চ আদালতসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের রুদ্ধদ্বার উন্মোচিত হতে শুরু করে।

এ ক্ষেত্রে বিচারপতি মোরশেদ ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে তার কর্মক্ষেত্র ছিল অনেক প্রসারিত। তাই একপর্যায়ে তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শামিল হতেও দ্বিধাবোধ করেননি। বিচারপতি জীবনে তিনি অনেক জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঐতিহাসিক, সময়োপযোগী রায় দিয়ে স্বৈরশাসনের মধ্যেও আইনের শাসন সমুন্নত রাখেন।

বাংলা-ইংরেজি ছাড়াও আরও কয়েকটি ভাষায় তার দখল ও পাণ্ডিত্য ছিল। আইন ছাড়াও তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতি বিষয়ে বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। অখণ্ড পাকিস্তানে ও স্বাধীন বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি আসামান্য ভূমিকা রেখে গেছেন।

১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের জন্ম। তার পিতা সৈয়দ আবদুস সালেকও একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে তিনি যোগ দেন বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর হিসেবে তিনি বগুড়া, দিনাজপুর ইত্যাদি জেলায় নিযুক্ত ছিলেন।

মাহবুব মোরশেদের মা আফজালুন্নেসা বেগম ছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের বোন। মাতামহ কাজী ওয়াজেদ আলী ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান আইন গ্রাজুয়েট প্রখ্যাত সমাজ-সংস্কারক নবাব আবদুল লতিফের জ্ঞাতি ভাই। ১৯৩৯ সালের ১ অক্টোবর কলকাতার মেয়র একেএম জাকারিয়ার কন্যা লায়লা আরজুমান্দ বানুর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মাহবুব মোরশেদ।

শিক্ষাজীবনে মাহবুব মোরশেদ স্কুলের প্রতিটি শ্রেণিতে প্রথম হন। ১৯২৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছিলেন। প্রবেশিকা পাসের পর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৯৩১ সালে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ এবং প্রথম শ্রেণিতে এলএলবি ডিগ্রি নেন যথাক্রমে ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে। কলেজজীবনে তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায়ও সম্পৃক্ত হন। প্রেসিডেন্সি কলেজ ম্যাগাজিনের তিনি সম্পাদকও ছিলেন একবার।

একই সময়ে তিনি তুখোড় বক্তা হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন। কলেজ জীবনে তিনি ক্রীড়া ক্ষেত্রেও সুনাম অর্জন করেন। ’৩০-এর দশকে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সংগঠকের দায়িত্বও পালন করেন।

মাহবুব মোরশেদ কলকাতা হাইকোর্টে অইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন ১৯৩৪ সালে। তিনি নেতাজী সুভাষ বসুর অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু (১৮৮৯-১৯৫০) এবং খ্যাতনামা অবাঙালি আইনজীবী কেবি খাইতানের জুনিয়র হয়ে কাজ করার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেন। কিন্তু এর অল্পদিনের মধ্যেই তিনি আইনে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য যুক্তরাজ্য যান। ১৯৩৮ সালে তিনি লন্ডনের বিখ্যাত লিংকন’স ইন থেকে বার অ্যাট ল’ (ব্যারিস্টার) ডিগ্রি লাভ করেন।

দেশে ফিরে তিনি আবার আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা হাইকোর্ট বারে যোগ দেন। ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র নির্বাচন, যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা এবং শেরেবাংলার নেতৃত্বে গঠিত সেই সরকারের কেন্দ্র কর্তৃক বরখাস্ত হওয়া, রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নানামুখী নির্যাতন ইত্যাদি ঘটনার সময়টা ছিল উত্তাল।

এসব ঘটনা নিয়ে তিনিও সচেতন ছিলেন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিজেকে ইতিবাচকভাবে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। ১৯৫৫ সালে যখন মোহাম্মদ আলী (বগুড়া) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী, তখন সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে যোগ দেন।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধানসংবলিত শাসনতন্ত্র প্রণয়নে যারা সোহরাওয়ার্দীকে সাহায্য করেন, মাহবুব মোরশেদ ছিলেন তাদের একজন।

মাহবুব মোরশেদ ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন ১৯৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে। দেশে তখন হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্ট সরকার। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। ১৯৫৮-এর অক্টোবরে জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যায়। মানুষের সব মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। তখন বিচারপতির আসনে থেকে সৈয়দ মাহবুব মোরশেদকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিষ্পত্তি করতে হয়েছে।

এর মধ্যে অনেক মামলা ছিল তৎকালীন প্রতাপশালী সরকারের বিরুদ্ধে। বিচারপতি মোরশেদ প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায়ও প্রচণ্ড সাহসিকতা ও গভীর দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ঐতিহাসিক ৬ দফার খসড়া প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যে ৬ দফার কারণে শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাবরণ করতে হয়।

শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেই বিচারপতি মোরশেদ ৬ দফা প্রণয়নে সম্পৃক্ত হননি, ’৬৫-এর যুদ্ধের পরে তিনি উপলব্ধি করেন, পূর্ব বাংলার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও যথেষ্ট মজবুত ছিল না। এ বিষয়টিও গভীরভাবে তার চিন্তার মধ্যে ছিল।

১৯৬৯-এ আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকে বিচারপতি মোরশেদ ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট’ দাবি করেছিলেন। তার যুক্তি ছিল, ওয়ান ইউনিট পাকিস্তান ভেঙে দেয়ার পরে জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এ অঞ্চলের ভোটেই পাকিস্তান গঠিত হয়। এ কারণে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৯টি আসন পূর্ব বাংলার প্রাপ্য। সেই হিসেবে এ অঞ্চলে যে দল বেশি আসন পাবে, সেই দলই কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের দাবিদার।

বিচারপতি মোরশেদ একজন প্রগতিশীল ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন। তিনি কখনও কোনো সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সঙ্গে হাত মেলাননি। তিনি ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সাহসের সঙ্গে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

লেখক: কবি ও শিশুসাহিত্যিক