গ্রেফতার হওয়া ছিনতাইকারী চক্রের তিন সদস্য

রাতের ঢাকার ত্রাস ‘গামছা পার্টি’

অফিস ছুটির হলেই মাঠে নামে তারা। সিএনজি চালক সেজে ঘুরে বেড়ান শহরের নানা প্রান্তে। খুঁজতে থাকেন শিকার। কেউ হাতের ইশারা দিলেই রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে দেন। যাত্রী যত টাকা ভাড়া দিতে চান তাতেই রাজি হয়ে গাড়িতে তুলে নেন। গাড়িতে তুলেই রাস্তায় যেতে যেতেই মুখে ও গলায় গামছা পেঁচিয়ে যাত্রীর সবকিছু লুটে নেন চক্রের সদস্যরা। তারপর ওই যাত্রীকে নিয়ে ঘুরতে থাকেন রাজধানীর বিভিন্ন ফ্লাইওভারে। সুযোগ বুঝেই ফ্লাইওভারের উপরে লোকটিকে ফেলে সিএনজি নিয়ে সটকে পড়েন তারা।

৯ সদস্যের একটি গ্রুপ অনেক দিন থেকেই সিএনজি অটোরিকশায় যাত্রী তুলে তাদের জিম্মি করে সবকিছু হাতিয়ে নেয়। এতে কেউ বাধা দিলে তার গলায় গামছা প্যাঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ নির্জন এলাকায় ফেলে রাখে তারা। কোনো দেশীয়, এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে না; গামছাই তাদের ‘অস্ত্র’।

গত ৬ জানুয়ারি হাতিঝিল থানা এলাকার কারওয়ান বাজার রেলক্রসিং এলাকার ফ্লাইওভারের উপর থেকে এশিয়ান ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান মিজানের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিনতাইকারী চক্রের তিন সদস্য গ্রেফতার করে হাতিঝিল থানা পুলিশ। গ্রেফতারের পর হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলত জবানবন্দি দেন তারা। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মিজানকে হত্যা ছাড়াও আরও তিনটি হত্যার ঘটনা স্বীকার করেছে তারা। পুলিশ ও আদালত সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে পুলিশ বলছেন, এই চক্রটি আরও হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে ।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মিজানের হত্যার রহস্য উদঘাটনের তদন্ত নেমে সম্প্রতি ঢাকা ও গাজীপুরে অভিযান চালিয়ে এই চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে চক্রের সিএনজি চালক নুর ইসলাম গত শুক্রবার আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। রোববার গ্রেফতারকৃত আব্দুল্লাহ বাবু এবং জালালও স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

এ বিষয়ে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার বিল্পব বিজয় তালুকদার বলেন, একটি হত্যার ঘটনা তদন্তে নেমে ভয়ঙ্কর এক চক্রের সন্ধান পেয়েছি। ইতোমধ্যে চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে।

তিনি বলেন, এই চক্রের আরও ৬/৭ জন সদস্যর নাম পাওয়া গেছে। চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তি ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি রাজধানীতে একই কায়দায় চারটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন চক্রটি। এরমধ্যে খিলক্ষেতের কুড়িল ফ্লাইওভার উপর থেকে ৪ জানুয়ারি অজ্ঞাত দুই লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে চক্রের সদস্যরা জড়িত বলে পুলিশ ও আদালতের কাছে স্বীকার করেছে। এছাড়াও এই চক্রের হাতে খুন হওয়া আরেকটি লাশ উদ্ধার হয় রাজধানীর ভাটারা এলাকায়। এই চারজন ছাড়াও গত চারমাসে আরও পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এই চক্রের সদস্যরা সরাসরি জড়িত বলে জানিয়েছেন পুলিশ।

একের পর এক খুন করলেও এই চক্রের বিষয়ে এতোদিন অন্ধকারেই ছিল পুলিশ। নূর ইসলামের মুখে এসব খুনের বর্ণনা শুনে বিস্মিত পুলিশ কর্মকর্তারা। সিরিয়াল কিলিংয়ের এসব কাহিনী যেন পুলিশ কর্মকর্তাদের বিশ্বাসই হতে চায় না।

নূর ইসলাম বলেছে, এই চারজন ছাড়াও গত চার মাসে আরও অন্তত পাঁচটি হত্যার সঙ্গে সে সরাসরি জড়িত। এই সময়ে আরও অন্তত ১০ জনকে অজ্ঞান অবস্থায় বিভিন্ন সড়কে ফেলে গেছে তারা। পরে তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা তার জানা নেই।

মিজান হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে এই চক্রের সন্ধান পাওয়া যায় বলেও উল্লেখ করেন বিপ্লব বিজয় তালুকদার। তিনি বলেন, গত ৫ জানুয়ারি গভীর রাতে নূর ইসলামসহ চক্রের তিন সদস্য গলায় গামছা পেচিয়ে মিজানকে হত্যার পর লাশ কাওরান বাজারের রেলক্রসিং বরাবর ফ্লাইওভারের ওপরে ফেলে যায়। খুনিরা মিজানের দুটি মোবাইল ফোন ও সঙ্গে থাকা ৩০০ টাকা নিয়ে যায়। ঘটনার ১০ দিন পর মিজানের একটি মোবাইল সচল হয়। প্রযুক্তিগত তদন্তের ভিত্তিতে নূর ইসলামসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে ভয়ঙ্কর খুনি চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়।

ক্লুলেস চার হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন
তেজগাঁও বিভঅগের পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, গত ১০ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত কুড়িল ফ্লাইওভার এবং হাতিরঝিল ফ্লাইওভারে চার লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রতিটি ঘটনায় দেখা গেছে, তাদের শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। তবে ঘটনাগুলো এতোদিন ক্লুলেস ছিল। তাদের হত্যার পেছনের কারণ এবং কারা হত্যা করেছে এ বিষয়ে পুলিশ পুরোপুরি অন্ধকারে ছিল। নূর ইসলামকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে এসব হত্যার ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র মিজান হত্যার বিষয়ে খুনি নূর ইসলাম জবানবন্দিতে জানান, ৫ জানুয়ারি রাত ১২টা থেকে সোয়া ১২টার দিকে বনানীর কাকলিতে দাড়িয়ে ছিলেন মিজান। এ সময় নূর ইসলাম মিজানের কাছে গিয়ে তার গন্তব্য জানতে চান।

কুড়িল বিশ্বরোড বললে নূর ইসলাম তাকে জানান, তারাও ওইদিকে যাচ্ছেন। মিজান চাইলে অটোরিকশায় উঠতে পারেন। ওই অটোরিকশার পেছনে নূর ইসলামের দুই সহযোগীও ছিল। মিজান অটোরিকশায় উঠলে, আগে থেকেই যাত্রীবেশে থাকা দুই ছিনতাইকারীদের একজন মিজানের ঘাড়ে পিস্তলের মতো করে আঙ্গুল শক্ত করে ধরে। এ সময় অন্যজন মিজানের দুই হাত চেপে ধরে বলে, ‘আমরা খারাপ লোক। যা আছে দিয়ে দে।’

তখন মিজান পুলিশ পুলিশ বলে চিৎকার করতে চাইলে, এক ছিনতাইকারী মিজানের গলায় গামছা পেঁচিয়ে ধরে। এক সময় মিজান নিস্তেজ হয়ে পড়েন। তার সঙ্গে থাকা দুটি মোবাইল ফোন এবং ৩০০ টাকা নিয়ে নেয় তারা। তারপর চক্রের সদস্যরা রামপুরা, মৌচাক এবং মগবাজার হয়ে ফ্লাইওভারে উঠে। কারওয়ানবাজারের রেলক্রসিং বরাবর নির্জন দেখে সেখানেই মিজানের লাশ ফেলে তারা পালিয়ে যায় ওই চক্র।