অর্থ মন্ত্রণালয়

খেলাপি ঋণ আদায়ে ‘সর্বময়’ ক্ষমতা পাচ্ছে নতুন সংস্থা

খেলাপি ঋণ আদায়ে দেশে কঠোর আইন করা হচ্ছে। এ আইনে যেসব ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হবে, তা আদায়ের ভার দেওয়া হবে সরকারের প্রস্তাবিত নতুন সংস্থা ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন’কে। সরকারের বিশেষায়িত এই আর্থিক প্রতিষ্ঠান খেলাপি আদায়ে সম্ভব সব ধরনের ক্ষমতা পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রয়োজন মনে করলে ঋণখেলাপির ব্যাবসাপ্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দিতে কিংবা লিজ দিতে পারবে। ঋণখেলাপির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দখল, পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন, ঋণ পুনর্গঠনও করতে পারবে।

খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর এই প্রথম কোনো বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানকে এত ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক মিলে ‘বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন আইন, ২০২০’ নামে একটি আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এতে এ ধরনের ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

খসড়া আইনটিতে পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রাখতে করপোরেশনকে শেয়ার, বন্ড ও ডিবেঞ্চার বা মিউচুয়াল ফান্ড কিনে বিনিয়োগ করারও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তহবিল সংগ্রহে সেখান থেকে অর্থ তুলতে পারবে করপোরেশন।

এ ব্যাপারে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কম্পানি আইন গঠন সংক্রান্ত কমিটির প্রধান এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব মু. শুকুর আলী বলেন, ‘যেকোনো দেশের অর্থনীতির জন্য খেলাপি ঋণ ভালো নয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই আইন খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে। ব্যাংক যেসব খেলাপি ঋণ আদায় করতে পারবে না, সেগুলো অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কম্পানি আদায় করবে। এতে খেলাপি ঋণ অনেক কমে যাবে। এ জন্য অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশনকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। আমরা আইনটি করতে মালয়েশিয়া, কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের আইন পর্যালোচনা করেছি। ২০০২ সাল থেকে এই চার দেশ খেলাপি ঋণ আদায়ে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট আইন দিয়ে সফল হয়েছে।’

শুকুর আলী বলেন, এই আইনের মাধ্যমে যে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন গঠন করা হবে তার শেয়ার পুঁজিবাজারে ছাড়া হবে। বন্ডও ছাড়া যাবে। তাই একদিকে যেমন পুঁজিবাজারে ভালো মৌল ভিত্তি শেয়ারের সংখ্যা বাড়বে, তেমনি বাজার স্থিতিশীলতায়ও ভূমিকা রাখতে পারবে।

জানা গেছে, খেলাপি ঋণ আদায়ে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করবে। প্রতিটি ব্যাংক পৃথকভাবে করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করবে। চুক্তি অনুযায়ী, ব্যাংক যে খেলাপি ঋণগুলো আদায়ে ব্যর্থ, সেগুলো করপোরেশনের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করবে। তারপর করপোরেশন ওই ঋণ আদায়ে জোরদার তৎপরতা চালাবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী আদায়কৃত খেলাপি ঋণের অংশ পাবে করপোরেশন।

প্রায় সর্বময় ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব
খসড়া আইনের ধারা ২৪-এ করপোরেশনের ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণ আদায়ে ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কম্পানির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণসহ কর্তৃত্ব নিয়ে নিতে পারবে করপোরেশন। ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কম্পানির ব্যবসার সম্পূর্ণ বা আংশিক বিক্রি করতে বা লিজ দিতে পারবে। বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানটি চাইলে ঋণগ্রহীতার খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণ কিংবা পুনর্গঠন করতে পারবে। কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলে করপোরেশনের এক বা একাধিক এজেন্ট প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে কাজ করবেন। আর যদি কোনো ব্যক্তি ঋণখেলাপি হন, তাহলে এজেন্ট প্রশাসকের ক্ষমতা পাবেন। ঋণগ্রহীতার বকেয়া নিষ্পত্তি করার ক্ষমতাও দেওয়া হচ্ছে করপোরেশনকে। এ ছাড়া জামানতের দখল, সুরক্ষা এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে লিজ বা বিক্রির ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা পাবে সরকারি এ প্রতিষ্ঠান।

ঋণগ্রহীতার ঋণের সম্পূর্ণ বা যেকোনো অংশ শেয়ারে রূপান্তর করতে পারবে করপোরেশন। নিজে মামলা দায়েরও করতে পারবে। শুধু দেশের নয়, বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি ঋণখেলাপি হলে সে ক্ষেত্রেও ব্যবস্থা এবং মামলা করতে পারবে।

আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ক্ষমতা বা অধিকার করপোরেশন পাবে। ধারা ৩১-এ বলা হয়েছে, সরকার চাইলে করপোরেশন খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেবে। তবে করপোরেশন প্রতিবছর একটি বার্ষিক প্রতিবেদন সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে দেবে। খেলাপি আদায়ের জন্য করপোরেশন কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার স্থাপন করবে। আর এর সঙ্গে ঋণের জামানত রেজিস্ট্রি প্ল্যাটফর্মের সমন্বয় করবে।

পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করতে পারবে
খসড়া আইনের ধারা ৭ এবং ৮-এর মধ্যে অ্যাসেট ম্যানেজ করপোরেশনের শেয়ার মূলধন এবং পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে বলা হয়েছে। ধারা ৭ মোতাবেক করপোরেশনের অনুমোদিত শেয়ার মূলধন হবে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। ১০ টাকা মূল্যের প্রতিটি ৫০০ কোটি সাধারণ শেয়ারে বিভক্ত হবে। সরকার সময় সময় অনুমোদিত শেয়ার মূলধন বৃদ্ধি করবে। করপোরেশনের পরিশোধিত শেয়ার মূলধনের পরিমাণ হবে তিন হাজার কোটি টাকা। সরকার চাইলে তা আরো বাড়াতে পারবে। ধারা ৮-এ বলা হয়েছে, তহবিল সংগ্রহের জন্য করপোরেশন প্রয়োজনে পুঁজিবাজারে বন্ড ইস্যু করতে পারবে। বন্ড ও ডিবেঞ্চার, শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করতে পারবে। একই সঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে—লাভজনক যেকোনো খাতেও বিনিয়োগ করতে পারবে। তহবিল গঠন বা

বাড়াতে এক বা একাধিক, দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগকারী কিংবা ফান্ড/ফান্ড ম্যানেজারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে। করপোরেশন চাইলে এক বা একাধিক সাবসিডিয়ারি কম্পানিও গঠন করতে পারবে।

করপোরেশনের চেয়ারম্যান হবেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব
করপোরেশনের চেয়ারম্যান হবেন পদাধিকারবলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব। এর পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ হবে তিন বছর। এক-তৃতীয়াংশ সদস্য উপস্থিত হলেই এর কোরাম পূর্ণ হবে বলে আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। যদি পর্ষদের চেয়ারম্যান, পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপদেষ্টা, পরামর্শক বা কোনো কর্মচারী ধারা ১৮-তে প্রদত্ত বিশ্বস্ততার ঘোষণা ভঙ্গ করেন, তবে তিনি সর্বোচ্চ ছয় মাস কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারের পলিসি তো পরস্পরবিরোধী। একদিকে ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। আবার অন্যদিকে এ উদ্যোগ নিয়ে তাদের ধরার চেষ্টা করছে। তবে আমার শঙ্কা হলো, এ আইন পাস হলে নিঃসন্দেহে আদালতে রিট হবে এবং আইনটি স্থগিত হয়ে যাবে।’

তিনি বলেন, তবে সার্বিকভাবে খেলাপিদের শাস্তির আওতায় আনা দরকার। সরকার এর মাধ্যমে যে উদ্যোগ নিচ্ছে, এটি ভালো। তবে এর আগে রাজনৈতিক কারণে ঋণ দেওয়া-নেওয়া বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি আইন পাসের আগে অন্যান্য দেশে এ ধরনের আইনে কী বলা হয়েছে, তা দেখা উচিত। সূত্র- কালের কণ্ঠ