অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মশিউর রহমান

অগ্রক্রয় মামলা কখন, কীভাবে করবেন

অনেক সময় দেখা যায়, পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে এক ভাই তার সম্পত্তি অন্য ভাইকে না দিয়ে অপর গ্রামের বা দূরবর্তী কারো কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। আবার পাশের জমির মালিক বা সহ-শরিক ন্যায্যমূল্য দিতে রাজি হলেও দূরবর্তী কেউ বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে দলিলে কম মূল্য দেখিয়ে জমি কিনে নিচ্ছেন। সহ-শরিক বা পার্শ্ববর্তী জমির মালিকদের এসব ক্ষেত্রে উক্ত বিক্রিতব্য সম্পত্তি কেনার এক ধরনের অগ্রাধিকারমূলক অধিকার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ কখনো মারামারি পর্যন্ত গড়াতে দেখা যায়। আবার কার আগে কে জমি কিনতে পারে অথবা কার পরিমাণ কতটুকু হবে, এসব নিয়েও বিরোধ হতে দেখা যায়। এ সবই ঘটে থাকে অগ্রক্রয় সম্পর্কে ধারণার অভাবে। বলতে গেলে অগ্রক্রয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আমাদের কমই। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ মশিউর রহমান।

অগ্রক্রয় কি
অগ্রক্রয় হলো, কোনো সম্পত্তি বা তার অংশ কোনো সহ-শরিক বা একাধিক সহ-শরিক যদি উক্ত জমির কোনো শরিক ছাড়া অন্য কোনো আগন্তুকের কাছে বিক্রি করে, তাহলে অপর কোনো সহ-শরিক বা শরিকরা অথবা তাদের অনুপস্থিতিতে সংলগ্ন জমির মালিকরা উক্ত সম্পত্তির বিক্রয়মূল্য ও নির্ধারিত হারে ক্ষতিপূরণ প্রদান করে আদালতের মাধ্যমে তা পেতে পারেন। এটাই অগ্রক্রয় বা প্রিয়েমশন। কৃষি এবং অকৃষি দু’ধরনের সম্পত্তির ক্ষেত্রেই অগ্রক্রয়ের অধিকার প্রয়োগ করা যায়।

কার আগে কে
অগ্রক্রয়ের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার সূত্রে সহ-শরিকরা সবার আগে এ অধিকার পাবেন। ক্রয়সূত্রে সহ-শরিক সংলগ্ন ভূমির মালিকের ওপর এবং উত্তরাধিকার সূত্রে সহ-শরিক ক্রয়সূত্রে সহ-শরিকের ওপর অগ্রাধিকার পাবে। সংলগ্ন ভূমির মালিক যদি একাধিক হয়, তাহলে তাদের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হলো- ক। প্রত্যেক মালিকের দখলে থাকা ভূমির মোট পরিমাণ; খ। সংলগ্ন ভূমি বসতবাড়ি না অন্য কোন প্রকারের; গ। সংলগ্নতার বিস্তৃতি ও ঘ। দরখাস্তকারীর সংলগ্ন ভূমি কতখানি প্রয়োজন ইত্যাদি। তবে অগ্রক্রয় করতে হলে হস্তান্তরিত সব সম্পত্তির করতে হবে। এর কোনো অংশ বিশেষ অগ্রক্রয় করা চলবেনা।

মামলার পক্ষ কারা হবে
এক কথায়, যারা অগ্রক্রয়ের অধিকার রাখেন, তাদের যে কেউ এ মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন। তবে যেসব ব্যক্তিকে এ মামলার পক্ষ করতে হবে, তারা হলেন-

  • যদি অগ্রক্রয়ের মামলাটি একজন উত্তরাধিকার সূত্রে সহ-শরিক করে থাকেন তবে অন্য সব উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সহ-শরিকদের পক্ষ করতে হবে।
  • যদি ক্রয়সূত্রে কোনো সহ-শরিক এ মামলা করে থাকেন তাহলে সব উত্তরাধিকার সূত্রে সহ-শরিক ও ক্রয়সূত্রে অন্যান্য শরিককে পক্ষ করতে হবে।
  • যদি সংলগ্ন ভূমির মালিক এ মামলা করে থাকেন তাহলে সব ওয়ারিশসূত্রে ও খরিদসূত্রে সহ-শরিকরা এবং সংলগ্ন ভূমির অন্যান্য মালিককেও পক্ষ করতে হবে।

জেনে রাখা ভালো, কোনো অগ্রক্রয়ের মোকদ্দমা পরবর্তী সময়ে কোনো সহ-শরিক বা সংলগ্ন ভূমির মালিক বাদী বা দাবিদার হিসেবে যোগ দিতে পারেন। মোকদ্দমা দায়েরের পর অন্য কোনো সহ-শরিক যদি মনে করেন তিনিও অগ্রক্রয়ের দাবি জানাবেন, তাহলে তিনি পৃথক মোকদ্দমাও করতে পারেন অথবা আগে দায়েরকৃত মোকদ্দমায়ও বাদী হিসেবে সংযুক্ত হতে পারবেন। এক্ষেত্রে শুধু আদালতের অনুমতি নিতে হবে।

কখন অধিকার জন্মায়
অগ্রক্রয়ের অধিকার সম্পত্তির হস্তান্তর চুক্তির তারিখ থেকে কার্যকর হয় না। কবলা দলিল রেজিস্ট্রেশনের তারিখ থেকে মালিকানার মর্যাদা নির্ধারণ করা হয় বলে রেজিস্ট্রির তারিখ থেকে অগ্রক্রয় অধিকারের উদ্ভব ঘটে। হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দলিল সম্পাদনের তারিখ থেকে দলিল কার্যকর হয়। কিন্তু অগ্রক্রয়ের ক্ষেত্রে রেজিষ্ট্রেশনের তারিখ থেকে এ অধিকারের উদ্ভব ঘটে। যদি রেজিস্ট্রি করার আগেই কোনো অগ্রক্রয় দরখাস্ত আদালতে পেশ করা হয়, তাহলে তা যথাসময়ের আগে করা হয়েছে বলে বাতিল হবে না, যদি ওই দলিল অগ্রক্রয় মামলা চলাকালেই রেজিস্ট্রি হয়।

কখন অধিকার হারায়

  • প্রথমতঃ অগ্রক্রয় বা প্রিয়েমশনের অধিকার কোনো অখন্ডনীয় অধিকার নয়। তাই অগ্রক্রয়ের কার্যক্রম চালু অবস্থায় যদি কেউ সহ-শরিকের মর্যাদা হারায়, তাহলে তার অগ্রক্রয়ের অধিকার নষ্ট হয়। অগ্রক্রয়ের দাবি বলবত করার জন্য সম্পত্তির অগ্রক্রয়কারীর স্বার্থ থাকতে হবে। শুধু তাই নয় অগ্রক্রয়ের মামলা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তির সময়ও সম্পত্তিতে তার স্বার্থ বলবত থাকতে হবে।
  • দ্বিতীয়তঃ অগ্রক্রয়ের সহ-দরখাস্তকারীরা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তাদের অগ্রক্রয়ের দরখাস্ত প্রয়োগে ব্যর্থ হলেও এ অধিকার নষ্ট হয়ে যায়।
  • তৃতীয়তঃ বিক্রীত জমি যদি বিক্রেতার কাছে হস্তান্তর করা হয়, তাহলে আর অগ্রক্রয়ের অস্তিত্ব থাকেনা। যদি দরখাস্তকারীর অগ্রক্রয়ের অধিকার নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে অগ্রক্রয় কার্যক্রম অকর্মণ্য হয়ে পড়ে, এক্ষেত্রে আর এ ধরনের কোনো প্রতিকার আশা করা যায় না।

দানের ক্ষেত্রে কী হবে
অনেকে প্রশ্ন করেন, দানকৃত সম্পত্তি অগ্রক্রয় যোগ্য কি-না। উত্তর হবে- না। যে ক্ষেত্রে কোনো দান ভালোবাসা ও স্নেহের জন্য এবং একসঙ্গে টাকার বিনিময়ে করা হয়, সেক্ষেত্রে এ দানকে হেবা বিল এওয়াজ বলা হয়। এ ধরনের ক্ষেত্রে অগ্রক্রয়ের অধিকার প্রয়োগ করা যায়না। যদি একখানি কোরআন শরিফ বা একটি জায়নামাজের বিনিময়ে হেবা বিল এওয়াজ করা হয়, তাহলে এটি দানের কোনো আর্থিক মূল্যের বিনিময় নয়। কাজেই তা অগ্রক্রয় যোগ্য নয়। অর্থাৎ যারা সাধারনত অগ্রক্রয়ের অধিকার রাখেন, তাদের বাদ দিয়ে অথবা তাদের কাউকে আর্থিক প্রতিদান ছাড়া হেবা বিল এওয়াজ করে সম্পত্তি হস্তান্তর করলে সেখানে অগ্রক্রয় চলবে না।

টাকা কত লাগবে
অগ্রক্রয়ের মোকদ্দমার সঙ্গে আদালতে টাকা জমা নিয়ে কৃষি ও অকৃষি ভূমির ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। এখানে উভয় ক্ষেত্রেই ৩ ধরনের টাকা জমা দিয়ে মোকদ্দমা করতে হয়। ভূমিরমূল্য; ক্ষতিপূরণের টাকা ও উন্নয়ন বাবদ খরচকৃত ও অন্যান্য টাকা। কৃষি এবং অকৃষি উভয় ক্ষেত্রেই জমির বিক্রীত মূল্যের সমপরিমান টাকা আদালতে জমা দিতে হবে। ক্ষতিপূরণের টাকা অকৃষি জমির ক্ষেত্রে তার মূলের শতকরা বার্ষিক ১০ টাকা হারে জমা দিতে হবে। অন্যদিকে কৃষি জমির ক্ষেত্রে ক্ষতিপুরন জমা দিতে হবে শতকরা বার্ষিক ৫ টাকা হারে। অকৃষি ভূমির ক্ষেত্রে দরখাস্তকারী জমির মূল্যের সঙ্গে খাজনা বাবদ পরিশোধিত টাকা, কোনো দায় মুক্তকরণ বাবদ ব্যয়িত টাকাও সম্পত্তির উন্নয়ন বাবদ ব্যয়িত টাকা জমা দিতে হবে।

অন্যদিকে অকৃষি জমির ক্ষেত্রে হস্তান্তরের তারিখের পরের সময়ে খাজনা বাবদ পরিশোধিত টাকা, সম্পত্তি দায়মুক্ত করা বাবদ ব্যয়িত টাকা এবং হস্তান্তরের তারিখ ও অগ্রক্রয়ের দরখাস্তের নোটিশ জারির মধ্যবর্তী সময়ে কোনো দালান, ঘর, বাড়ি তৈরি বাবদ বা অন্য কোনো উন্নয়ন বাবদ পরিশোধিত টাকা এবং উক্ত পরিমাণ টাকার ওপর বার্ষিক ৬.২৫ টাকা হারে সুদ জমা দিতে হবে। যদি হস্তান্তর গ্রহীতার দেয়া মূল্যের টাকার পরিমাণ নিয়ে কোনো বিরোধ দেখা দেয়, তাহলে আদালত উক্ত বিরোধ সম্পর্কে অনুসন্ধান করবেন এবং হস্তান্তর গ্রহীতাকে বলার সুযোগ দেবেন যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে কত টাকা বিক্রেতাকে দিয়েছেন।

কোন আদালতে যাবেন
অগ্রক্রয়ের মোকদ্দমা এখতিয়ার সম্পন্ন দেওয়ানি আদালতে দায়ের করতে হবে। এখানে এখতিয়ার বলতে আঞ্চলিক ও আর্থিক দুটোকেই বোঝাবে। প্রথমতঃ যে জেলায় সম্পত্তি অবস্থিত সে জেলায় এবং আর্থিক এখতিয়ার হিসেবে যে আদালত নির্দিষ্ট হবে, সেখানে দরখাস্ত দায়ের করতে হবে। অগ্রক্রয়ের মোকদ্দমায় দলিলে লিখিত মূল্যের টাকার পরিমাণ দ্বারা আদালতের আর্থিক এখতিয়ার নির্ধারিত হবে।

লেখক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ