অ্যাডভোকেট প্রিয়াংকা মজুমদার

মেধাসম্পদ হিসেবে ঢাকাই জামদানির আইনি স্বীকৃতির নেপথ্যে

অ্যাডভোকেট প্রিয়াংকা মজুমদার:

প্রথমেই ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। সৃষ্টিশীল মানুষ নিজের বুদ্ধি ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবন করেন নতুন নতুন বিষয় যেমন সাহিত্য ও শৈল্পিক কর্ম, নতুন কোন উদ্ভাবন, ব্যাবসার প্রতীক, চিহ্ন বা নাম ইত্যাদি। মানুষের চিন্তাজাত এসব সৃষ্টিই মেধা সম্পদ বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ অর্থাৎ ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি (Intellectual Property)। কবি ও প্রাবন্ধিক মুহাম্মদ নুরুল হুদার কাছে ইন্টেলেকচুয়াল শব্দটির অর্থ ও ব্যাঞ্জনা ‘মেধা’র চেয়ে ‘মনন’ এর অধিক নিকটবর্তী মনে হয়। মেধা হোক মনন হোক আসলে এটি হচ্ছে মানুষের সৃষ্টিশীলতার প্রধান উৎস ও প্রক্রিয়া। এক কথায় মেধা সম্পদ হল মানুষের সৃজনশীল সৃষ্টি (creation of human mind)। ১৯শ শতকে এসে “মেধা সম্পদ” ধারণাটি প্রচলিত হয়। ২০ শতকের শেষে এসে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে এটি আইনগতভাবে স্বীকৃত হয়।

ধরুন, আপনার একটি বাড়ি আছে মফস্বল শহরে যা কিনা ভাড়া দিয়ে রেখেছেন অথচ ভাড়াটিয়া ভাড়াও দিচ্ছে না, বাড়ি থেকেও যাচ্ছে না আবার ধরুন আপনার শখের কেনা বাইকটিকে পার্ক করে কোথাও গেলেন এসে দেখেন বাইকটি চুরি হয়ে গেছে এমন পরিস্থিতিতে আপনাকে রক্ষা করার জন্য আইন রয়েছে, পুলিশ আছে৷যার মাধ্যমে বাড়ি ও বাইকের মত মূল্যবান সম্পদ আপনি রক্ষা করতে পারছেন। এবার আপনি একটি মিউজিক কম্পোজ করেছেন, আপনার কম্পোজ করা সুর নকল করে কেউ আরেকটি গান গাইলো এবং তুমুল জনপ্রিয় হল আর আপনি হলেন ক্ষতিগ্রস্ত। এখন এই ব্যাপারটা আপনি কার সাহায্যে বন্ধ করবেন? আপনি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় বসে “প্রিতারা” নামে একটি বুটিকশপ চালাচ্ছেন যার রয়েছে এক্সক্লুসিভ সব ডিজাইন, দেশের আর কোথাও যার কোন শাখা নেই। এখন চট্রগ্রামে বসে কেউ একজন “প্রিতারা” নামে আরেকটি বুটিকশপ খুলে বসলো নকল ডিজাইন ও নিম্নমানের কাপড়ের। এতে করে আপনার “প্রিতারা” ব্র্যান্ডের সুনাম নষ্ট হতে থাকলো আপনি কিভাবে, কোথায় সাহায্য চাইবেন?

ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি জামদানি বাংলাদেশের ঐতিহ্য এখন ভারত চাইছে সারা বিশ্ব জামদানিকে ভারতের পণ্য হিসেবে চিনুক। আমরা এটি কিভাবে বন্ধ করবো? গাড়ি, বাড়ি হলো tangible সম্পদ এগুলো খালি চোখে দেখা যায় এবং আইনের সাহায্যে রক্ষা করা যায়। যে সম্পদ চোখে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না নিজের মেধা, বুদ্ধি খরচ করে তৈরি করা হয় এবং যা নিজ ভূখণ্ডের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে জড়িত সেগুলোই হল Intellectual Property বা মেধা সম্পদ। এগুলো Intangible সম্পদ হিসেবে পরিচিত ।

মেধাসম্পদ দুই ভাগে বিভক্ত

১) শিল্প সম্পদ (Industrial Property) যেমন পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন, জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (GI)

২) কপিরাইট (Copyright)। কপিরাইটের অন্তর্ভুক্ত হলো সাহিত্য, সংগীত, কবিতা, নাটক, চলচ্চিত্র, ড্রয়িং, পেইন্টিং, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদি।

মেধাসম্পদের গুরুত্বের বিষয়টি প্রথম স্বীকৃতি পায় ১৮৮৩ সালে World Intellectual Property Organisation (WIPO) পরিচালিত Industrial Property সুরক্ষার জন্য Paris Conversation ও ১৮৮৬ সালে কপিরাইট সুরক্ষার জন্য Bern Convention এর মাধ্যমে।

জামদানীর সুরক্ষা যে কারনে দরকার
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রক্ষণাবেক্ষণ ও উদারীকরণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত World Trade Organization এর ২৩টি চুক্তির একটি হচ্ছে TRIPS (Trade Related Aspects Of Intellectual Property Rights)। এই চুক্তির ২৭.৩(খ) ধারায় পৃথিবীর সব প্রাণ-প্রকৃতি প্রক্রিয়ার উপর পেটেন্ট করার বৈধ অধিকার রাখা হয়েছে। এই চুক্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব প্রাকৃতিক ও মানুষের তৈরি এবং কৃষিজাত পণ্য দীর্ঘকাল ধরে উৎপাদিত হয়ে আসছে, তার ওপর সেই দেশের মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য ভৌগোলিক নির্দেশক আইন করে নিবন্ধন করে রাখার বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের এই আইনটি হচ্ছে GI Act, 2013 (Geological Indication) ।

Geological Indications বা ভৌগোলিক পরিচিতি কি
নাম শুনেই বুঝা যাচ্ছে ভৌগলিক পরিচিতি একটা নির্দিষ্ট Territory, area বা place কে indicate করছে। কোন একটি ভূখণ্ডের আবহাওয়া, মাটি, পানি এবং ঐ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোন একটি পণ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে তাহলে সেটিকে ঐ ভূখণ্ডের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। যেমন বগুড়া বল্লেই সবার প্রথমে মনে আসে দই, টাংগাইলের চমচম, দার্জিলিং এর চা, কাশ্মিরের শাল, সুইজারল্যান্ডের ঘড়ি ইত্যাদি। অর্থাৎ এই নির্দিষ্ট যায়গাগুলো এই বিশেষ পণ্যের জন্য বিখ্যাত। এই পণ্যগুলো অন্য যায়গায় তৈরি হলে ও ঐ বিশেষভাবে যায়গায় তৈরীকৃত পণ্যের গুনগত মানের মত হবে না।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যবাহী মেধা সম্পদে সমৃদ্ধ। আমাদের রয়েছে জামদানি, ইলিশ, নকশিকাঁথা, আম, চাল, মিষ্টির মত বিখ্যাত কিছু ঐতিহ্য। আমাদের এসব প্রাকৃতিক ও উৎপাদিত পণ্য সামগ্রীর ইতিহাস এবং ঐতিহ্য বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। এসব পণ্যের দাবিদার একমাত্র আমরাই। এগুলো আমাদের নিজস্ব সম্পদ তবে বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এসব পণ্য বিভিন্ন দেশ উৎপাদন করে মেধাস্বত্ব নেয়ার চেষ্টা করছে।

জি আই বা ভৌগোলিক নির্দেশক/পরিচিতির নিবন্ধন যেভাবে হয়
জিআই পণ্যের নিবন্ধন করতে হলে পণ্যটি কোন এলাকায় সহজে পাওয়া যায়, এর পেছনে ঐ এলাকার কি কি ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য আছে, পণ্যের বিশেষত্ব কি, উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট এলাকার জলবায়ু, মাটি ও পানি কতটা উপযোগী, ঐ এলাকার কাছাকাছি কোনো নদী বা সমুদ্র আছে কিনা, কোনো জনগোষ্ঠী পণ্যটির উপর নির্ভরশীল বা তাদের একমাত্র আয়ের উৎস কিনা, তারা কত সময় ধরে এ পণ্য থেকে কি পরিমাণ আয় করছে ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়। এসব শর্ত বিবেচনার পরে যাচাই বাছাই করে তবেই কোন পণ্যের মেধাস্বত্ব এবং মালিকানা দাবী করা যায়।

মেধাসম্পদ বা ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে জামদানির স্বীকৃতি
যে জামদানি একান্তই আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য এবং সম্পদ, তা ভারত তাদের বলে নিয়ে নিয়েছিল। অথচ চতুর্দশ শতকে মরক্কান ট্রাভেলার ইবনে বতুতা যখন বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন তিনি এখানে জামদানী তৈরি হতে দেখেন। ইংলিশ ট্রাভেলার Ralph Finch বাংলাদেশের সোনারগাঁওয়ে মসলিন এবং জামদানীর কথা উল্লেখ করেন। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি, আবহাওয়া, পুরোপুরিভাবে জামদানী উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত। তারপরেও ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ Uppada জামদানি নামে একটি নিবন্ধন নিয়ে নিয়েছে।

পরে UNESCO ঘোষণা দিয়েছে ঢাকার জামদানি Intangible heritage Of mankind. অতঃপর বাংলাদেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে জামদানি ১৭ নভেম্বর ২০১৬ সালে স্বীকৃতি পায়। দ্বিতীয় GI পণ্য হিসাবে নিবন্ধিত হয় জাতীয় মাছ ইলিশ ৬ আগস্ট ২০১৭ সালে। ক্ষীরষাপাতি আমকে বাংলাদেশের ৩য় GI পণ্য (foodstuff) হিসেবে ঘোষণা করা হয় ২৭ জানুয়ারি ২০১৯ সালে। আরো যেসব পণ্য জি আই সার্টিফিকেটের অপেক্ষায় রয়েছে তা হলো ময়মনসিংহের কালোজিরে চাল, বাগেরহাটের সুন্দরবন মধু, মেহেরপুরের সাবিত্রী রসকদম, রাজশাহীর ফজলি আম ইত্যাদি।

জি আই পণ্য নিবন্ধনেরর গুরুত্ব ও সুবিধা

১) একটি দেশ জি আই দ্বারা কিছু নির্দিষ্ট পণ্যকে নিবন্ধন করে বিধায় ওই পণ্যটি ব্র‍্যান্ডিং পায়। অন্য দেশের একই জাতীয় পণ্য থেকে আমার দেশের পণ্য আলাদাভাবে চিনতে সাহায্য করে।

২) বিশ্ববাজারে পণ্যের আলাদা একটা সুনাম সৃষ্টি হয়।

৩) উৎপাদনের জন্য উৎপাদনকারীরা ভাল দাম পান।

৪) জি আই পণ্য কোন দেশ আমদানি করতে চাইলে উৎপাদনকারী দেশকে নির্দিষ্ট হারে রয়ালিটি প্রদান করতে হবে।

৫) জি আই নিবন্ধিত পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশ লাভবান হবে। বাংলাদেশের রফতানি আয়ও বাড়বে।

৬) জিআই পণ্য হিসেবে নির্বাচনের পর এগুলোর মালিকানা স্বত্ব পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশ এসব পণ্য একই নামে বা একই জাতীয় পণ্যের নামে মালিকানা দাবি করতে পারবে না। এর ফলে দেশে-বিদেশে এসব পণ্য নিয়ে সব ধরনের ব্যবসা থেকে অর্জিত অর্থ ও সুনামের দাবিদার হবে বাংলাদেশ।

লেখক: আইনজীবী; জজ কোর্ট, ফেনী