অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

এবার ডিসি’র রোষানলে সাংবাদিক: মোবাইল কোর্ট বনাম বিচারব্যবস্থা!

সিরাজ প্রামাণিক:

‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ শিরোনামে শামসুর রাহমান এক কবিতা লিখেছিলেন। তিনি বেঁচে থাকলে আমার নিবন্ধের শিরোনাম দেখে তিনি কি লিখতেন, তা পাঠকের কাছে অনুমেয় বটে। দেশের ডিসি’রা মায়াকান্না করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ক্ষমতা নিয়ে এক ধরনের উদ্ভট এক উটের পিঠে চড়ে জনগণের ওপর লাঠি ঘোরাচ্ছে ও আইনের অপব্যবহার করছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন যে, তিনি বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে গ্রাম্য বর্বরতার হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন। এখন বাংলাদেশের এমনই অবস্থা যে, ভ্রাম্যমান আদালত বিচারব্যবস্থা ডিসি’রা উদ্ভট উটের পিঠ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে পুরো ব্যবস্থাকে বিতর্কর মধ্যে ফেলেছে।

এবার কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে অনিয়মের সংবাদ পরিবেশন করায় শুক্রবার (১৩ মার্চ) মধ্য রাতে ডিসি অফিসের দুই-তিন জন ম্যাজিস্ট্রেট ১৫-১৬ জন আনসার সদস্যকে নিয়ে দরজা ভেঙে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামকে ভ্রাম্যমান আদালতে সাজা দেন। এর পূর্বে সিভিল সার্জন, আইনজীবী শিক্ষকসহ কেউই বাদ পড়েনি এ ক্যাঙারু আদালতের হাত থেকে। জেলা প্রশাসক মোছাঃ সুলতানা পারভীন একটি পুকুর সংস্কার করে নিজের নামে নামকরণ করতে চেয়েছিলেন। আরিফুল এ বিষয়ে নিউজ করার পর থেকেই তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন ডিসি। এছাড়া, সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে রিপোর্ট করতে চেয়েছিলেন সাংবাদিক আরিফ। এ বিষয়ে জানতে পেরে জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে তাকে বেশ কয়েকবার ডেকে নিয়ে সতর্ক করা হয়। আরিফুলের স্ত্রী জানান, ‘ডিসি অফিসে রাত ২টার সময় মোবাইল কোর্ট বসানো হয়। এক বছরের কারাদণ্ড দিয়ে তাকে রাত আড়াইটার দিকে জেলখানায় পঠিয়ে দেয়।’

রাষ্ট্রের খোদ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ ঘটনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন ডিসি’রা দেশের সর্বেসর্বা নয়। আইনমন্ত্রী ও মন্ত্রীপরিষদ বিভাগও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আবেগ-উত্তাপ ও যৌক্তিক তর্ক-বিতর্ক এখনো চলছে, চায়ের দোকান থেকে পত্রিকার কলাম, টেলিভিশন টক শ’ পর্যন্ত। সন্দেহ নেই আরো কিছুকাল চলবে। চলাটাই স্বাভাবিক।

ন্যায়বিচার এমন একটি শব্দ, যার সাথে কিছু বিষয় এত নিবিড় ও গভীরভাবে জড়িত যে, এর যেকোন একটির কোন রকম ব্যত্যয় ঘটলে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। বহু বছর আগে মার্কিন মানবতাবাদী মার্টিন লুথার কিং লিখেছিলেন, ‘যে কোন জায়গায় অবিচার ঘটলে তা সমস্ত জায়গার বিচারকে হুমকির মুখে ফেলে।’ ফরাসী দার্শনিক আঁনাতোলে ফ্রান্স লিখেছিলেন, ‘আইন যদি সঠিক হয় তাহলে মানুষও ঠিক হয়ে যায় কিংবা ঠিকভাবে চলে।’ ভ্রাম্যমান আদালত বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান চরম দূরাবস্থায় উপরোক্ত দু’টি উক্তি চরমভাবে প্রণিধানযোগ্য। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো আইন মানবতা বিমুখ হয়ে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না।

পৃথিবীতে এমন কোন সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবেনা যেখানে আইনের বিকাশ হয়নি। সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে ‘আইন’ ধারনাটিরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তিত সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে আইন তার কার্যকারীতা হারায়। প্রয়োজন হয় সে আইনকে সময় উপযোগী করে তোলা। গঠনমূলক সমালোচনার মধ্যেই আইন তার অস্তিত্বের সন্ধান পায়। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, আমাদের পুরো আইনব্যবস্থায় রয়েছে বৃটিশদের শঠতার ছোঁয়া। কারণ বৃটিশ তাদের দুষ্কর্ম ঢাকতে আইন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। তৎকালীন ভারতবর্ষের গভর্ণর জেনারেল ১৭৭২ সালে আইন ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করে তিনিই সর্বপ্রথম আইন ভঙ্গ করেন। তার অধস্থন কর্মচারী জার্মান চিত্রশিল্পীর পরমা সুন্দরী স্ত্রীকে দাঁড়িপাল্লায় বসিয়ে স্বর্ণের দামে খরিদ করেছিলেন। আজকের আদালতে ব্যবহৃত ন্যায় বিচারের প্রতীক দাঁড়িপাল্লাকে তিনিই প্রথম অনৈতিক কাজে ব্যবহার করেন। মূলত বৃটিশ আইন তৈরী করেছিল শাসন শোষনের জন্য, দরিদ্র কৃষকের জমির খাজনা আদায়ের জন্য কিংবা প্রজাকে কাচারীতে ধরে নিয়ে মারধর, হাত-পা বেঁধে আঁধার কুঠুরিতে ফেলে রাখা, প্রজার স্ত্রী-কন্যাকে বন্ধক হিসেবে আটক রাখা, বিষয় সম্পত্তি ক্রোক করা এবং ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা। বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থা এখনও তার উত্তরাধিকার বহন করছে মাত্র। মোবাইল কোর্ট আইন তাদের মধ্যে অন্যতম।

আমরা সবাই জানি, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত মুখোমুখী বিজ্ঞ বিচারকের সামনে তাঁদের নিযুক্ত আইনজীবী দ্বারা মামলা প্রমাণ বা মিথ্যা প্রমানে আইনি লড়াই করে। উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমানের আলোকে বিজ্ঞ বিচারক তাঁর সুচিন্তিত এবং সুসিদ্ধান্তিত রায় প্রদান করে। অথচ মোবাইল কোর্ট আইন সেই সকল বিষয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে।

মোবাইল কোর্ট আইনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আপত্তি হলো আমাদের সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদেও গ্রেপ্তার ও আটকের ব্যাপারে পদ্ধতিগত সুরক্ষা দিয়েছে যেমন- ‘গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাশীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া পুনরায় আটক রাখা যাবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাবে না।’ আমাদের পবিত্র সংবিধানের বিধান প্রতিনিয়ত লংঘন হচ্ছে অথচ আমার সুশাসনের কথা বলছি। ফৌজদারি আইনি লড়াই করার জন্য নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবী দ্বারা তাঁর Defence Against Charge-এর যে সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার পেয়েছেন তা কোনো যুক্তিতে উপেক্ষা করা হলে সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা বা ধারণা মোবাইল কোর্ট আইনের কোথাও নেই।

মোবাইল কোর্ট আইনের বিরুদ্ধে তৃতীয় আপত্তি হলো এটি সংবিধান স্বীকৃত জনসন্মুখে বিচার অস্বীকার করে। যা সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদ এ স্পষ্ট বর্ণিত রয়েছে। অথচ মোবাইল কোর্টে বিচার ও দণ্ড প্রদানের প্রাক্কালে কোনো জনসাধরণকে উক্ত স্থানে র‌্যাব, পুলিশ এবং বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাউকেই ওই স্থানে থাকতে দেন না। মোবাইল কোর্টের এহেন আচরণ জনসন্মুখে বিচার অস্বীকার করে।

মোবাইল কোর্ট আইনের বিরুদ্ধে চতুর্থ আপত্তি হলো এটি মারাত্মকভাবে সর্বজনীন আইনের ন্যায়পর নীতিমালাকে উপেক্ষা করে। যা সংবিধানের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ অনুযায়ী ষ্পষ্ট। অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার আছে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সাক্ষ্য অবলোকন করা এবং তা খণ্ডন করা এবং উপস্থাপিত সাক্ষীদের প্রদত্ত জবানবন্দি জেরা করা। এখানে উল্লেখ্য, জেরা করা ফৌজদারি দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির মৌলিক আইনগত অধিকার। কিন্তু মোবাইল কোর্ট আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে এরূপ কোনো অধিকার প্রয়োগের সুযোগ দিয়ে কোনো বিধান রাখা হয়নি।

মোবাইল কোর্ট আইনের ১৭টি ধারা ভালভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় সার্বজনীন স্বীকৃত ও সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো বিভিন্ন স্তরে ফুটে উঠেছে। যেমন-
ক) কোন সাক্ষ্য উপস্থাপন এবং প্রদর্শনের করার বিধান রাখা হয়নি।
খ) কোনো সাক্ষীর জবানবন্দি উপস্থাপনের বিধান রাখা হয়নি।
গ) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আনীত অভিযোগের জবাবে জেরা করার বিধান রাখা হয়নি।
ঘ) অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক নিজের সাফাইয়ের জন্য সাফাই সাক্ষী উপস্থাপনের সুযোগ দেওয়া হয়নি।

অথচ উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আসামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাক্ষীর দ্বারা সমর্থিত না হলে কোনভাবেই আসামীকে দোষী সাব্যস্থ করে সাজা প্রদান করা যাবে না।

মোবাইল কোর্ট আইনের বিরুদ্ধে পঞ্চম আপত্তি হলো এ আইনের অধীন বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট একই সঙ্গে তদন্তকারী, আমল গ্রহণকারী এবং দণ্ড প্রদানকারী বিচারককে তিনটি ভিন্ন ক্ষমতা একই সঙ্গে প্রদান করা হয়। ফলে মোবাইল কোর্টের বিজ্ঞ বিচারক বাংলাদেশ সংবিধানে ৭৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত বিধান মারাত্মকভাবে ব্যহত করছে। একই ব্যক্তি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা একই সঙ্গে অর্জন করার ফলে একটা অযাচিত একনায়কতন্ত্রের- জন্ম হওয়াই স্বাভাবিক।

মোবাইল কোর্ট আইনের ষষ্ঠ আপত্তি হলো আলোচ্য আইনটি মানবাধিকার আইনের পরিপন্থী। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ এর পরিপন্থীও বটে। মোবাইল কোর্ট আইনে যেহেতু অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোনো সময় মঞ্জুরের ব্যবস্থা নেই। এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ ও বিধান দুটোই নেই, সেহেতু মোবাইল কোর্ট আইন নিঃসন্দেহে মানবাধিকার আইনের নীতিমালার সঙ্গে মারাত্মক সাংঘর্ষিক। মানবাধিকার আইনের নীতিমালা মতে, একজন অভিযুক্তকে অবশ্যই নিম্ন লিখিত সুযোগ দিতে হবে।
ক) সুস্পষ্ট অভিযোগ লিখিতভাবে আনতে হবে।
খ) অভিযোগ সমর্থনে প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে।
গ) অভিযোগ প্রমাণে সাক্ষীদের জবানবন্দি নিতে হবে।
ঘ) অভিযুক্তকে অভিযোগকারী ও তাঁর সাক্ষীদের জেরার সুযোগ দিতে হবে।
ঙ) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য প্রস্তুতির পর্যাপ্ত সুযোগ ও সময় দিতে হবে।
চ) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজ পছন্দ মোতাবেক বিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগের এবং পরামর্শ গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।
ছ) আত্মপক্ষ সমর্থনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাক্ষ্য ও সাক্ষী উপস্থাপনের সুযোগ দিতে হবে।

কিন্তু আলোচ্য আইনটি পুরোপুরি বিচার বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ওই আইন ওপরে বর্ণিত সব নীতিমালা উপেক্ষা করে সরকারের একটি বিশেষ শ্রেণীর কর্মকর্তাদের খুশি করার জন্য ঝটপট আলোচ্য আইনটি প্রণয়ন করে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না যে ইতিহাসের কোনো আইন মানবতা বিমুখ হয়ে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারি।

যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন ন্যায়পর নীতিমালা রক্ষা করতে পারে না, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, যে আইন সব স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সংহতি রক্ষা করতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক জনস্বার্থ রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই।

প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো ‘ক্ষমতার অপব্যবহারকারী ডিসি’দের কাছ থেকে মোবাইল কোর্ট আইন প্রত্যহার করে নেয়া হয়েছে।’ সেদিন আমাদের সংবিধানের শ্বাসত বাণী চিরন্তন রুপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা, গবেষক ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com