মো: আজহারুল ইসলাম

দ্বাদশ বিজেএসের ভাইভা অভিজ্ঞতা আর আমার সহকারী জজ হয়ে ওঠা

মো: আজহারুল ইসলাম:

তারিখ: ১৪ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৯।। সময়: সন্ধ্যা ৭টা।। আমার ভাইভার সিরিয়াল ১৮ জনের মধ্যে ১৫তম।

বাংলাদেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরীক্ষাময় যতগুলো চাকরি আছে তার মধ্যে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত সহকারী জজ অন্যতম। এই চাকরির সাথে অন্য চাকরির বড় পার্থক্য হলো সহকারী জজ ব্যতীত অন্য চাকরিতে লিখিত পরীক্ষায় ভালো করলে ভাইভাতে মোটামুটি পারফরমেন্স দেখিয়ে পাশ মার্ক পেলেই মিলবে চাকরি নামক সোনার হরিণ। কিন্তু সহকারী জজ চাকরির সবচেয়ে কঠিন এবং নিষ্ঠুর বাস্তবতাময় ধাপ হলো ভাইভা। নকআউটময় (প্রায় ১০০০০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রিলিতে উত্তীর্ণ মাত্র ৫৭৩ জন) প্রিলি আর লিখিত পরীক্ষায় (৫৭৩ জনে উত্তীর্ণ প্রায় ৪০০) পাশ করতে পারলেও আপনি যদি ভাইভাতে সন্তুষ্টজনক পারফরমেন্স দেখাতে না পারেন আপনার ভাগ্যে কাঁচকলা ছাড়া আর কিছুই জুটবে না যেমনটা আমার জুটেছিল ১০ম আর ১১তম বিজেএস পরীক্ষায়। যাহোক আল্লাহ্‌র অশেষ রহমত, আমার কঠোর পরিশ্রম, আমার শ্রদ্ধেয় পিতামাতা আর প্রিয় সহধর্মীণির দোয়া ও ত্যাগের মহিমায় বিভীষিকাময় ১২তম বিজেএস এর ভাইভাতে বিভীষিকাময় পারফরমেন্স দেখিয়ে সোনার হরিণ নামক সহকারী জজ/ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার সুযোগটাকে ছিনিয়ে এনেছি। বিভীষিকাময় ভাইভার উল্লেখযোগ্য অংশ চাকরি প্রত্যাশীদের জন্যে তুলে ধরলাম:

ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সালাম বিনিময় শেষে চেয়ারম্যান স্যার বসার অনুমতি দিলেন। সাথে সাথে আমি প্রশ্নবাণে জর্জরিত।

চেয়ারম্যান স্যার: আজহারুল ‍ইসলাম আপনার বাসা কোথায়? বললাম স্যার সাতক্ষীরা।

স্যার: আচ্ছা সাতক্ষীরার কয়েকজন প্রথিতযশা আইনজীবীর নাম বলেন যারা এখন কেউ বেঁচে নেই। আমি খুব কনফিডেন্সের সাথে বললাম স্যার , সরি আমার জানা নাই। স্যার বললো কোনদিন কোর্টে যাননি নাকি? কোন চাকরি বাকরি করেন নাকি? আমি বললাম জি স্যার। স্যার পরক্ষণেই কি চাকরি করি জানতে চাইলো। আমি বললাম। (ঐ সময় আমি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে আইন কর্মকর্তা পদে চাকরি করতাম।)

স্যার: আচ্ছা বলুন ১৬তম সংবিধান সংশোধনীর কয়জন বিচারপতির রায় এবং অবজারভেশন পড়েছেন? বললাম স্যার কোন বিচারপতির রায় নির্দিষ্ট করে পড়িনি। শুধু ১৬ তম সংশোধনীর সারমর্ম পড়েছি। স্যার বললো সারমর্ম তো সবাই জানে। আচ্ছা সারমর্ম কি বলুন? আমি খুব সুন্দর করে গুছিয়ে বললাম।

স্যার: আজহার সাহেব, আপনার বাসা তো সাতক্ষীরা? জি স্যার। আচ্ছা মনে করেন ভোমরা বন্দর দিয়ে একজন ১০ কেজী মসুর ডাল শুল্ক/ কর ফাঁকি দিয়ে আনার পর সাতক্ষীরা পুলিশের হাতে ধরা পড়লো। ঐ ব্যক্তি কি কোন অপরাধ করেছে? বললাম জি স্যার ঐ ব্যক্তি ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(খ)ধারার অধীন স্মাগল পণ্য পরিবহনের অপরাধ করেছে। স্যার উক্ত অপরাধের সাজার বিধান জানতে চাইলেন। বললাম স্যার মৃ্ত্যুদণ্ড, অথবা যাবজ্জীবন অথবা সশ্রম কারাদণ্ড যার মেয়াদ ১৪ বছর পর্যন্ত হতে পারে এবং সেইসাথে অর্থদণ্ড। পরক্ষণেই স্যার জানতে চাইলো উক্ত অপরাধের কোন নিন্মতম সাজা উল্লেখ আছে কি না? আমি বললাম জি স্যার। নট লেস দ্যান টু ইয়ার্স।

স্যার: ঐ আসামীর প্রতিকার কি? বললাম স্যার উক্ত আইনের ৩০ ধারার অধীন ৩০ দিনের মধ্যে হাইকোর্ট ডিভিশনে আপীল করবে। স্যার পরক্ষণেই বললো , মনে করেন ৩০ দিনের মধ্যে আসামী আপীল করতে পারলো না কোন কারনবশত। আপনি একজন এ্যাডভোকেট হয়ে কি পরামর্শ দিবেন? বললাম স্যার উক্ত আইনসহ কয়েকটি বিশেষ আইনের ক্ষেত্রে Law of Limitation প্রযোজ্য না। সুতরাং উনি ৫ ধারার condonation of delay এর সুবিধা পাবে না।

স্যার: তাহলে অপরাধী কি জেলে পচে মরবে?? না কি আর কোন প্রতিকার আছে?? আমি পাজেল হয়ে গেলাম। ইতস্তত করতে করতে বললাম স্যার, রিভিশান করা যাবে। স্যার  ‍শুনে বললেন, আমি জানতাম আপনি এই কথা বলবেন। স্যরের কথার টোন শুনে বুঝতে পারলাম আমি ভুল বলেছি। আমি ভুল স্বীকার করে বললাম স্যার অপরাধী এই পর্যায়ে প্রতিকার হিসাবে আপীলেট ডিভিশানে ক্রিমিনাল আপীল করতে পারবে কারন ক্রিমিনাল মামলায় সেকেণ্ড আপীলের বিধান আছে। এই বলে স্যারকে খুশি করলাম। পরক্ষণেই নুরুজ্জামান ননী স্যার প্রশ্ন করা শুরু করে জানতে চাইলেন রাষ্ট্রপতি কখন অধ্যাদেশ জারী করতে পারে? আমি সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে ক্ষেত্রগুলো বলার পর স্যার জানতে চাইলেন রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশে জারীর মাধ্যমে কি কি করেত পারবে না? আমি ৯৩ অনুচ্ছেদের অধীন যে ৩টা কাজ করা যাবে না সেগুলো গুছিয়ে বললাম।

আবার ভাইভা বোর্ডের সভাপতি হাছান ফয়েজ স্যার প্রশ্ন করা শুরু করলো। আচ্ছা বলেন তো আজহার সাহেব Privilege Communication কি??  কোথায় বলা আছে? Evidence Act এর এই বিষয়টা অনার্স ফাইনাল ইয়ারে আসমা সিদ্দিকা ম্যাম খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছিলেন। বিশেষ করে ঐ  Privilege Communication টার্মটা Evidence Act এর কোথাও স্পষ্ট করে উল্লেখ নেই। আমি খুব কনফিডেন্সের সাথে   বললাম স্যার এইটা Evidence Act এর ধারা ১২১-১৩২ ধারা পর্যন্ত আলোচনা করা হয়েছে। এটা মূলত পেশাগত যোগাযোগে গোপনীয়তা রক্ষা করা এবং সুযোগ সুবিধা।

স্যার: মনে করেন আপনি একজন এ্যাডভোকেট। আপনার কাছে একজন খুন করে এসে খুন করার কথা আপনার কাছে স্বীকার করে বললো আপনাকে তার মামলা লড়তে হবে। আপনাদের ভিতর যে কথাবার্তা আদান প্রদান হয়েছে এই কথা কি আপনি অন্য কারোর কাছে প্রকাশ করতে পারবেন?? আমি বললাম না প্রকাশ করতে পারবো না। স্যার বললো আমরা তো হরহামেশো দেখি এ্যাডভোকেটরা আলোচনা করে। আমি বললাম স্যার যদি করে তাহলে সেটা পেশাগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন। স্যার বললো কেন? আমি বললাম স্যার এখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধ স্বীকার করে আত্নপক্ষ সমর্থনের জন্য আমার কাছে এসেছে। আমি এটা অন্য কারোর কাছে প্রকাশ করতে পারবো না কারন ১২৬ ধারার অধীন এটা উকিলের সাথে মক্কেলের পেশাগত গোপনীয়তা রক্ষা করার বিধান।আমি তার অপরাধের কথা অন্য কারোর সাথে প্রকাশ করতে পারবো যখন সে অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য বা আমাকে আইনজীবী নিযুক্তির পর কোন অসৎ বা প্রতারনামূলক কাজ করেছে। স্যার এই প্রশ্নের উত্তর শুনে খুব খুশি হলেন।

এবার সেলিম তোহা স্যারের পালা: আচ্ছা আপনি তো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমার জানামতে আপনাদের যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, এবং ভারতের সংবিধান পড়ানো হয়েছে। জ্বী স্যার। স্যার বললো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের নাম বলেন।আমি বললাম। স্যার বললো what are the functions of these two house? আমি বললাম In a word, The function of house of commons is to make laws and take part in law making process. On the other hand the function of house of Lords is to scrutinize and criticize about the good and bad sides of the laws which have been made by the house of commons. তারপর স্যার জানতে চাইলো যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টকে সকল ক্ষমতার উৎস বলা হয় কেন? আমি বললাম স্যার যুক্তরাজ্যে parliamentary supremacy বহাল আছে তাই যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টকে সকল ক্ষমতার উৎস বলা হয় । যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট কোন বিধি বা আইনকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারে। এই জন্য যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টকে সকল ক্ষমতার উৎস বলা হয়। স্যার বললো এতটুকুই? বললাম স্যার আর মনে পড়ছে না।

স্যার: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামছুজ্জোহা হল কিসের জন্য বিখ্যাত? খুবই ক্রিটিক্যাল প্রশ্ন। সবারই উত্তর হবে, হলটি শহীদ শামছুজ্জোহার নামানুসারে এবং উনি দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী এবং শিক্ষক।এই কারনে বিখ্যাত। কিন্তু উত্তর হবে ভিন্ন। ভাইভার আগের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অয়েবসাইটে গিয়ে  সব কয়টি হল সর্ম্পকে সুন্দর ধারণা নিয়ে নিলাম। উত্তরটা হলো শহীদ শামছুজ্জোহা হলকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় পাক আর্মিরা তাদের ক্যাম্প হিসাবে ব্যবহার করতো। সমস্ত সামরিক সরঞ্জাম ঐ হলেই থাকতো। এবং হল থেকেই সকল অপারেশন পরিচালনা করতো। অতিরিক্ত তথ্য হিসাবে আমি বললাম পাক আর্মিরা নির্বিচারে মানুষ মেরে হলের অদূরে অবস্থিত বধ্যভূমিতে স্তুপাকারে ফেলে রাখতো। এই তথ্য দিতে গিয়েই বিপদে পড়লাম। স্যার আমার কাছে জানতে চাইলেন ঐ গণকবরে কয়টুকরা হাড় পাওয়া গিয়েছিল? আমি কোথায় যেন পড়েছি ১০,০০০। কিন্তু সঠিক কি না এই ভেবে বললাম সরি স্যার। স্যার বলে দিলেন ১০,০০০। আমার তো তখন আফসোসের শেষ নেই। মনে মনে বলছি কেন বললাম না ১০,০০০।

অন্য আরেকজন স্যার: মানি স্যুটের মামলার নাম শুনেছেন কখোনো? হ্যাঁসূচক উত্তর পেয়ে স্যার বললো এটা কখন করা হয়? আমি বললাম স্যার অর্থ ঝণ আদালত আইনের অধীন অর্থ আদায়ের জন্য এবং এন আই এ্যাক্টের ১৩৮ ধারার অধীন চেকের টাকা আদায়ের জন্য মানি স্যুটের মামলা করা হয়। এই উত্তর শুনে ফয়েজ স্যার একটি হাস্যকর এবং আমার উত্তর যে ভুল হয়েছে এটা ইঙ্গিত করে মন্তব্য করলো- ‘যা বলছেন বলছেন আর বলেন না। দেখা যাবে বাঁদর একমিনিটে বাঁশবেয়ে যতটুকু উঠেছে পরের মিনিটে তার চেয়ে বেশি নেমে গেছে।( আসলে উত্তরটা হবে সিপিসির অধীন সাধারণ মানি স্যুটের মামলা।)

স্যার বললো এটা ঠিক আছে যে , অর্থ আদায়ের জন্য ২০০৩ সালের আইনে মামলা হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অর্থ আদায়ের জন্য। কিন্তু সেটা তো আমি জিজ্ঞাসা করিনি। আচ্ছা বলুনতো অর্থ ঝণ আদালতে মামলা হলে মামলার শিরোণাম/টাইটেল কি হয়? যেমন মানি স্যুটের মামলা হলে টাইটেল হয় মানি স্যুট। বললাম সরি স্যার। পাশ থেকে অন্য স্যার আমাকে ইঙ্গিত করে বললো উনি পারবেন না।

স্যার: এডিআর করা কি আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক? আমি বললাম জি স্যার। এটা মামলার কোন ধাপে করতে হয়? আমি বললাম স্যার বিবাদিপক্ষ লিখিত জবাব দাখিলের পর। আমি আরও বললাম সর্বশেষ সিপিসির সংশোধনী অনুযায়ী এডিআর করার জন্য মামলাটি সংশ্লিষ্ট লিগ্যাল এইড অফিসারের কাছে পাঠাতে হবে।

এবার রহমতউল্লাহ স্যার: ম্যাগনা কার্টা কি? কতসালে পাশ হয়? আমি বললাম মানবাধিকারের প্রাথমিক দলিল। ১২১৫ সালের। স্যার বললো বিল অফ রাইটস কি? কতসালের? বললাম স্যার অর্থনৈতিক, সামাজীক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার সম্বলিত আইন। স্যার বললো নো নো এটা হলো রাজেনৈতিক অধিকারমালা। সালটা বলতে পারলাম যে এটা ১৭৯১ সালের। স্যার জিজ্ঞাসা করলো এই পলিটিক্যাল অধিকারের কথা আর কোথায় বলা আছে? আমি বললাম আসিসিপিআর এবং আইসিইএসসিআর এ বলা আছে। স্যার বললো ফুল মিনিং কি?  এবং কতসালের? আমি বললাম ২ টাই ১৯৬৬ সালের। ফুল মিনিং হলো International Covenant on Civil & Political Rights-1966 and International Covenant on Economic, Social & Cultural Rights-1966. স্যার বললো বিল অফ রাইটস এর সাথে এই কভিনেন্ট ২ টা্র কোন কোন বিষয়ের মিল আছে? আমি খুব বুদ্ধি করে আন্দাজে Civil, political, Economic, Social, & Cultural rights এর কথাগুলো উল্লেখ করলাম। পরে দেখলাম আন্দাজে ধিল মেরে খেটে গেল। (এই প্রশ্নগুলো ভাইভার আগে পড়ে যাওযা সম্ভব না। কারণ আইনের হিউজ সিলেবাস। যতটুকু পেরেছি মার্স্টাসে হিউম্যান রাইটস কোর্স খুব ভালো করে পড়ার কারণে।)

স্যার: আচ্ছা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অনুপ্রেরণামূলক জ্বালাময়ী ৩ টি গানের নাম বলুন? আমি সাথেসাথে উত্তর করলাম – মাগো ভাবনা কেন , আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্তছেলে… স্যার থামিয়ে দিয়ে বললো পরেরটা বলেন? আমি- তীর হারা ঐ ঢ়েউ এর সাগর পাড়ি দেব রে, আমরা কজন নবীন মাঝি হাল ধরেছি শক্ত করে রে..। এই গানটি বলার পর ননী স্যার পাশ থেকে বললো এই গানটাই যুদ্ধের সেরা গান। আমি খুব সাহস পেলাম। স্যার থামিয়ে দিয়ে বললো পরেরটা। আমি- সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্বরণে, আমার এ গান রেখ যেতে চাই তাদের স্মৃতির চরণে। স্যার বললো এটা তো ভাষা আণ্দোলনের গান। আমি বললাম সরি স্যার আমার আর মনে পড়ছে না। শুনে স্যার বললো জয় বাংলা বাংলার জয়- এই গানটাতো ঐ সময়ের জ্বালাময়ী গান? এই গান শুনেছেন? আমি বললাম জ্বি স্যার। স্যার বললো এই গানের সুরকার আর গীতিকারের নাম বলুন? আমি একটু সময় নিয়ে বললাম গীতিকার গাজী মাজারুল আনোয়ার। আর সুরকারের নাম ?? স্যার মনে পড়ছে না। (সুরকার আনোয়ার পারভেজ, কণ্ঠ দিয়েছেন – শাহনাজ রহমতউল্লাহ এবং আব্দুল জব্বার)

আবার ফয়েজ স্যার: সাতক্ষীরার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নাম বলেন? সাতক্ষীরার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একেবারে ঠোটস্থ করে গিয়েছিলাম। সেক্টর নাম্বার সহ (সাতক্ষীরা ৮ এবং ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল)সেক্টর কমাণ্ডার , সাব সেক্টর কমাণ্ডারদের পদবীসহ নাম এবং নামকরা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নাম বললাম। একজনের নামের পরিপূর্ণ অংশ না বলার কারণে স্যার ভুল ধরে আবার সঠিকটা বলে দিলেন। কোন ভুল বলার উপায় নেই। কারন সাতক্ষীরাতে দীর্ঘ দিন অবস্থান করার কারণে সাতক্ষীরা সম্পর্কে আমার চেয়ে হাছান ফয়েজ স্যার বেশি অবগত। এই পর্যায়ে স্যার সাতক্ষীরার একজন মুক্তিযোদ্ধার নাম বলে উনি এখনো জীবিত আছেন কি না জানতে চাইলেন। স্যাররা অত্যন্ত পজিটিভ থাকায় আমার মুখ থেকে খামখেয়ালীপনা উত্তর বেরিয়ে গেল। আমি বললাম যুদ্ধ হয়েছে ১৯৭১ সালে আর এখন ২০১৯ । স্যার এতদিনে উনার বেঁচে থাকার কথা না। বলার সাথে সাথে স্যারদের ভিতরে হাসির হিড়িক পড়ে গেল। হাসতে হাসতে বললেন আপনি তো দেখি জীবিত হলেও তাকে মৃত বানিয়ে ছাড়বেন।

স্যার: আচ্ছা আজহার আপনার সাথে একটু গল্প করি। মনে করেন আপনি জেলা জজ। আপনার বাড়িতে একদা এক মা বয়সী বৃদ্ধা মহিলা আপনার বাসার ভিতর প্রবেশ করলো। আপনি তাকে আপনার সাধ্যমত আপ্যায়ন করলেন। তারপর ঐ মহিলা বললো উনার একমাত্র ছেলে শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে ইণ্ডিয়া থেকে ভোমরা সীমান্ত দিয়ে ১০ কেজি মসুর ডাল আনার পর সাতক্ষীরা সদর পুলিশের হাতে ধরা পড়লো। পুলিশ তাকে হাজতে দিয়েছে। ঐ বৃদ্ধা মহিলা আপনাকে খুব কাকুতি মিনতি করে অনুরোধ করলো বৃদ্ধার একমাত্র সন্তানকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে জেল হাজত থেকে মুক্ত করে দেওয়ার জন্য যেহেতু ঐ সন্তান তার একমাত্র আয়ের উৎস এবং শেষ সম্বল। এমতাবস্থায় আপনি কি করবেন বা আপনার কি করনীয়?? আপনিতো একজন মানবিক সম্পন্ন জেলা জজ হয়ে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে তাকে তাড়িয়ে দিতে পারবেন না যেহেতু সে মা বয়সী বৃদ্ধা মহিলা। বুঝতে পারলাম স্যার একই সাথে আমার চারিত্র্রিক গুনাবলী এবং এহেন পরিস্থিতিতে আমার আইনি পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চেয়ে এই স্নায়ুচাপের প্রশ্ন করেছেন। আমি খুব দৃঢ়তার সাথে বললাম স্যার ঐ মহিলা যতই নিঃস্ব এবং সহায়সম্বলহীন হোক না কেন তাকে আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে উপস্থিত হয়ে আইনি প্রক্রিয়া মেনে চলতে হবে এবং আদালতে যেটা ফয়সালা হবে সেটা উনাকে মেনে নিতে হবে। আমি এভাবে আদালতের বাইরে আবেগের বশবর্তী হয়ে স্বজনপ্রীতি করে আসামীকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিলে আমার সুনাম ক্ষুন্ন হবে ফলশ্রুতিতে বিচার বিভাগের উপর থেকে জনসাধারনের আস্থা উঠে যাবে। স্যার শুনে বললো খুবই ভালো কথা। সেটা না হয় বুঝলাম আপনি স্বজনপ্রীতি বা আবেগের বশবর্তী হয়ে ঐ মহিলাকে প্রশ্রয় দিবেন না। কিন্তু আপনি করবেনটা কি?? অথ্যাৎ আপনার করণীয় কি? আমি একটু ভেবে আবারো ঐ একই ধরনের উত্তর করলাম। এই পর্যায়ে সেলিম তোহা স্যার একটু উচু স্বরে বললেন আপনি মনে হয় স্যারের কথা বুঝতে পারেননি। বললেন স্যার জানতে চাইছে আপনার করণীয় কি? আমি আর সময় না নিয়ে বলে দিলাম সরি স্যার আসলে আমার করণীয় কি আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তখন বিচারপতি হাছান ফয়েজ স্যার বলে দিল আপনি ঐ মামলাটা তখন অন্য কোন বিচারকের কাছে হস্তান্তর করে দিবেন। আমি বললাম জি স্যার।( তখনই আমার স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠলো ফৌজদারী কার্যবিধির ৫২৬(খ) ধারা, সিভিল কোর্টস এ্যাক্টের ৩৮ ধারা । যেখানে বলা আছে, নিজের স্বার্থ  জড়িত থাকলে ন্যায়বিচারের স্বার্থে  বিচারক অন্য আদালতে মামলাটি হস্তান্তর করে দিবেন।)

স্যার বললো  ঠিক আছে আজহার।আপনার সাথে অনেক গল্প হলো। এইবার আপনি আসতে পারেন। আমার মুক্তি মিললো অসম্ভব এক স্নায়ুযুদ্ধ থেকে। আমি সালাম দিয়ে মাথা নিচু করে সম্মান প্রদর্শন করে বেরিয়ে গেলাম। ততক্ষণে ৪৫ মিনিট পেরিয়ে গেছে।( সন্ধ্যা ৭.০০-৭.৪৫)যদিও আমার কাছে সময় কিভাবে গেছে বুঝতে পারিনি। বেরিয়ে অপেক্ষারত আমার পরের প্রার্থী আপু জিজ্ঞেস করলেন আপনি বেঁচে আছেন? বললাম বেঁচে আছি কিন্তু সিদ্ধ হয়ে গেছি বলে হাসি মুখে বিদায় নিলাম। রাত হওয়ায় এবং আমার পরে মাত্র ২ জন প্রার্থী থাকায় আমার আর দ্বিতীয় ভাইভার মুখোমুখি হতে হয়নি। পুরো ভাইভাজুড়ে কঠিন কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন আর স্নায়ুযুদ্ধের কবলে পড়তে হলেও আমার কনফিডেন্স সহকারে উত্তর, আমার এটিটিউড দেখে স্যাররা পজিটিভ ছিল। সবচেয়ে বড় ভালো লাগার বিষয় ছিল বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমি ঠিক যখন দরজার সামনে স্যাররা সবাই মিলে আমার সম্পর্কে একটা পজিটিভ রিমাকর্স করলো যেটার কারনে ভাইভার রেজাল্ট দেওয়া পর্যন্ত আমি খুব নির্ভার ছিলাম এবং আল্লাহুর অশেষ রহমতে বিগত ২৮ জানুয়ারী, ২০২০ সহকারী জজ হিসাবে পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে যোগদান করি।

লেখক- সহকারী জজ (শিক্ষানবীশ); জেলা ও দায়রা জজ আদালত, পিরোজপুর। ইমেইল- shohag567@gmail.com.