মঈদুল ইসলাম

বিচারকের আপন বিচার

মঈদুল ইসলাম:

“বিচারীযদ্যপি / অবিচারেরত, সেও পড়ে এই হ্রদে;”। কোন সে হ্রদ? “রৌরব এ হ্রদনাম, শুন, রঘুমনি, অগ্নিময়।” মেঘনাদবধ কাব্যে দেবী মায়ার মুখ দিয়ে মহাকবি মধুসূদন দত্ত শোনাচ্ছেন এ কথা রামচন্দ্রকে লক্ষ্য করে, যখন রামচন্দ্রকে ভাই লক্ষণের জীবন ফিরে পাবার জন্য মহাদেব শিব ও দেবী দূর্গার আদেশে মায়া দেবী নিয়ে চলেছেন যমালয়ে। যাত্রা পথে পড়ল উত্তপ্ত ফুটন্ত ঢেউয়ের নদী বৈতরণী, দেখলেন পাপীরা সাঁতরে পার হতে যন্ত্রণায় খাবি খাচ্ছে। ধর্ম পথগামীদের মত তিনি সোনার সেতু পথে পার হলেন। প্রবেশদ্বারে জ্বর, যক্ষা, কলেরা, আরও আরও বড়বড় সব রোগের পীড়ন-লক্ষণ দেখলেন। দক্ষিণ দরোজা দিয়ে ঢুকেই চুরাশি নরকের প্রথমটি এই রৌরব নরক দেখে বিচলিত হয়ে পড়লেন। এই মহাহ্রদে “জলরূপে বহিছে কল্লোলে / কালাগ্নি। ভাসিছেতাহে কোটি কোটি প্রাণী / ছটফটি হাহাকারে।” যেখানে আবার “ভীষণমুরতি / যমদূত হানে দণ্ড মস্তক-প্রদেশে; / কাটে কৃমি; বজ্রনখা, মাংসাহারী পাখী / উড়িপড়ি ছায়া দেহে ছিঁড়ে নাড়ি-ভুঁড়ি / হু হুঙ্কারে। আর্ত্তনাদে পূরে দেশ পাপী।” মায়া দেবী জানান, পরধন হরণকারী, আর যত মহাপাপীর সাথে এখানেই চিরবাস হবে অবিচারেরত সব বিচারকেরও। “অগ্নিরূপে বিধি রোষ হেথা / জ্বলেনিত্য।”

হিন্দুশাস্ত্র কথার কাব্যিক বর্ণনা এসব। ইসলামী শাস্ত্রকথাও ভিন্ন রকম নয়। বলা হচ্ছে, “আর যে বিচারক সত্য জানা সত্ত্বেও আদেশ দানের ক্ষেত্রে অন্যায়ের আশ্রয় গ্রহণ করে সে হবে জান্নামী। আর যে ব্যক্তি অজ্ঞতা অবস্থায় বিচারক কার্য সম্পন্ন করে সেও জাহান্নামী হবে। [আবু দাঊদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত: পৃষ্ঠা ৩২৪] বিচারের দায়িত্ব নিয়ে যারা অবিচার করেন তাদের স্বর্গলাভের সুসংবাদ নেই কোন শাস্ত্রেই, সে তিনি নিশীথে ভ্রাম্যমানই হোন কিম্বা দিবসে স্থিতিমানই হোন। আমাদের আইনশাস্ত্রেও তাদের প্রতিবিধান রেখে গেছে ‘বেনিয়া’ বৃটিশ। আমাদের ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধিতে (Penal Code – আদিতে ছিল Indian Penal Code, পাকিস্তান হলে ‘Indian’ বদলে হয় ‘Pakistan’ কিন্তু, বাংলাদেশ হলে কেবল ‘Pakistan’ শব্দটি মুছে দেয়া হয়, ‘Bangladesh’ বসান হয়নি, তাই এখন শুধুই ‘Penal Code’) আছে ২১৯ ও ২২০ ধারা। কোন দিন প্রয়োগ হয়েছে বলে জানা নেই। কোন বিচারক সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিস্কে বেআইনি বলে জেনেও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে বা বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে কোন বেআইনি রায়-আদেশ দিতে পারেন বা কাউকে বেআইনিভাবে জেলে পাঠাতে পারেন সে কথা এদেশের মানুষ কখনও কল্পনাও করেনি। নিজেরা কেউ কেউ কখন-সখন একে অপরের বিরুদ্ধে বদমতলবী যা কিছু করেন তা বিচারককে ফাঁকি দিয়ে, ভুল বুঝিয়ে। বিচারকের বিরুদ্ধে কখনই নয়।

এখনকি তবে জমানা বদলে যাচ্ছে! সেই রামও নেই সেই অযোধ্যাও নেই! এই ঘোর কলিকালে বিচারের ভার অনেক সময় চলে যাচ্ছে এমন অনেকের হাতে যাদের বিচারজ্ঞান দূরে থাক সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানটুকুও জন্মেছে কিনা সংশয় জাগাচ্ছে। বিবেক-বিবেচনাশূন্য, কেবল দুর্বুদ্ধিতে পাকা হলে তার কাছ থেকে অবিচারই তো ফলবে। বিচারক আইন জানবেন, বুঝবেন এবং কেবল আইনসম্মত ন্যায়বিচার করবেন, এটাই তো প্রত্যাশা। সে তিনি উচ্চ বা নিম্ন, গ্রাম্য বা বিশ্ব যে আদালতেই বসুন না কেন, ভ্রাম্যমান বা স্থিতিমান যাই হোন না কেন। বিচারে আবাল-বৃদ্ধবনিতার যাকে যতটুকু সুবিধা আইনে দেয়া তাকে তা দিয়েই বিচার করা বিচারকের আইনি দায়িত্ব। কেউ সেসব সুবিধা না পাওয়াটাই অবিচার। দুনিয়া যখন করোনা ভাইরাসের কভিড-১৯ মহামারীতে মহাপ্রলয়ের মুখে, কে বাঁচে কে মরে তাই নিয়ে সবাই যখন ঈশ্বরজপতে পাগলপারা, তখন যদি ব্যক্তিগত বিদ্বেষের তাড়নায় নিশীথের গভীর অন্ধকারে দরোজা ভেঙে সত্যিই কোন বিচারক হাজির হয়ে আগে প্রহার পরে প্রহসন করে সাজা দেন (যা প্রকাশ পাচ্ছে খবরে) তবে রৌরব নরকের চেয়েও ছটফটি হাহাকার লাগে। মৃত্যুপথযাত্রি দুর্বুদ্ধিখাটাতে পারেনা বলে ধারণায় মৃত্যুকালীন জবানবন্দীর যে মূল্য দেয়া হয় বিচারে সে তত্ত্বও তো তাহলে ঝুঁকির মুখে। যে-সব অভিযোগ উঠে কেবল কিছু বাহিনীর কিছু অসৎ লোকের বিরুদ্ধে সে রকম দোষের লোক যদি এখন বিচারের দণ্ড হাতে ঘুরে তাহলে তো দুর্ভাগ্যের শেষ নাই। তবে কি প্রলয় সত্যিই সমুৎপস্থিত! ঈশ্বর ডাকা ছাড়া আমাদের আর গতি নাই। ঈশ্বর রক্ষতু!

কোন বিচারকের (ভ্রাম্যমান-স্থিতিমান নির্বিশেষে) অবিচারি কর্মের কথা শুনলে বিচার কর্মের নগণ্য সাবেক কর্মী হিসেবে বড় ব্যাথা পাই, যেন মাথা কাটা যায়। বিচারের ঊর্ধে কেউই নন বলে জেনে, বুঝে, চলে এসেছি। দণ্ডবিধির সেই দুটি ধারাও পেছনে খাড়া ছিল। যারা ভুলে আছেন তারা আরেকবার মন দিয়ে পাঠ করে দেখতে পারেন –

“219. Public servant in judicial proceeding corruptly making report, etc., contrary to law.  Whoever, being a public servant, corruptly or maliciously makes or pronounces in any stage of a Judicial proceeding, any report, order, verdict, or decision which he knows to be contrary to law, shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to seven years, or with fine, or with both.” (যদি কোন সরকারি কর্মচারী আইনের পরিপন্থি হচ্ছে জেনেও কোন বিচারিক কার্যক্রমের কোন পর্যায়ে দুর্নীতি পরায়নভাবে বা বিদ্বেষ পরায়নভাবে তেমন কোন প্রতিবেদন, আদেশ, রায় বা সিদ্ধান্ত দেন তাহলে তিনি সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে বা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডণীয় হবেন।)

“220. Commitment for trial or confinement by person having authority who knows that he is acting contrary to law.  Whoever, being in any office which gives him legal authority to commit persons for trial or to confinement, or to keep persons in confinement, corruptly or maliciously commits any person for trial or confinement, or keeps any person in confinement, in the exercise of that authority, knowing that in so doing he is acting contrary to law, shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to seven years, or with fine, or with both.” (কাউকে বিচারে সোপর্দ করার বা কারাগারে পাঠাবার বা কারাগারে আটক রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্ষমতাধর কেউ যদি আইনের পরিপন্থি হচ্ছে জেনেও দুর্নীতি পরায়নভাবে বা বিদ্বেষ পরায়নভাবে কাউকে তেমন কোন বিচারে সোপর্দ করেন বা কারাগারে পাঠান বা কারাগারে রাখেন তাহলে তিনি সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডণীয় হবেন।)

নিশীথে ভ্রাম্যমান বা দিবসে স্থিতিমান, উচ্চ বা নিম্ন, গ্রাম্য বা বিশ্ব কোন আদালতের কোন বিচারকের বিরুদ্ধেই যেন এমন জঘন্য প্রকৃতির মামলা না আসে তাই একান্ত কামনা। অগ্নিরূপ বিধি রোষ থেকে সবার রক্ষা হোক। বিচারের ভার যাঁদের হাতে, বিচারক নির্ধারণের ভার এবং তাঁদের বিচারের ভার যাঁদের হাতে তাঁরা নিশ্চয়ই ভাববেন। অবিচারি কারও হাতে বিচারের ভার রাখা কতখানি বিচারি! কেবল কিছুদিন কোয়ারেন্টাইনে রাখলেই তারা চিকিৎস্য! নাকি একেবারেই দুষ্চিকিৎস্য! বাকিদের সংক্রমণ রোধে যাদের অপসারণ অনিবার্য তাদের তা করে সুচিকিৎসা করুন। নইলে এও মহামারী ছড়াবে, প্রলয় ঘটাবে বিচার জগতে। রৌরব নরক বা জাহান্নাম কোনটাতেই যেন গতি না হয় আমাদের।

লেখক: সাবেক সিনিয়র জেলা জজ দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল); ই-মেইল: moyeedislam@yahoo.com