মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল গালিব

করোনাকালে দেশে জরুরী অবস্থা নাকি প্রচলিত আইনের প্রয়োগ

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ্ আল-গালিব:

কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস বর্তমানে একটি বৈশ্বিক সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন আক্রান্ত রোগীর তালিকা যেমন দীর্ঘ হচ্ছে সাথে সাথে বেড়ে চলেছে মৃত্যুর হারও। ইতালি,স্পেন, ইরান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে। আশার সংবাদ হচ্ছে এই নোভেল ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীন তাদের সংকট কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বলেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে। হংকং,সিঙ্গাপুর, সাউথ কোরিয়া বেশ আগ্রাসী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সংক্রামক নিয়ন্ত্রনে সফলতা দেখিয়েছি।
বাংলাদেশও এই ভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পরার ঝুকিতে আছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বাংলাদেশ সরকার প্রয়োজনীয় সকল ব্যাবস্থা গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যেই মাদারীপুরের শিবচর “লক ডাউন” করা হয়েছে। গোটা দেশে জরুরী সেবা প্রদান এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান ছাড়া সব বন্ধ ঘোষনা করা পাশাপাশি গণপরিবহনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
অনেকে বলছেন, দেশে জরুরী অবস্থা জারী করার সময় এসে গেছে। তবে আমরা যদি বাংলাদেশের সংবিধানের দিকে তাকাই দেখতে পারবো, ১৪১ক অনুচ্ছেদ অনুসারে “রাষ্ট্রপতির নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এমন জরুরী-অবস্থা বিদ্যমান রহিয়াছে, যাহাতে যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের দ্বারা বাংলাদেশ বা উহার যে কোন অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ১২০ দিনের জন্য জরুরী-অবস্থা ঘোষণা করিতে পারিবে।”
অর্থাৎ যুদ্ধ, বহিরাক্রমন বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের জন্য জরুরী অবস্থা জারী করার কথা বলা হয়েছে। মহামারী রোগ প্রতিরোধে বর্তমান সংবিধান অনুসারে জরুরী অবস্থা জারী করা সম্ভব নয়। এর জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই রকম ব্যবস্থা রয়েছে।
আরও একটা বিষয় উল্লেখ্য যে,  মাহমুদুল ইসলাম তাঁর Constitutional Law of Bangladesh” বইয়ে জরুরী অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, জরুরী অবস্থা বলবৎকালে আপনা-আপনি সংবিধানের ছয়টি অনুচ্ছেদ (৩৬ থেকে ৪১) স্থগিত হয়। যেখানে রয়েছে, চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা।
বর্তমানে এই সকল মৌলিক অধিকার স্থগিত করার মত অবস্থা রয়েছে বলে মনে হয় না। তাহলে অনেকের মনে প্রশ্ন হচ্ছে মাঠে সেনাবাহিনী কি কারণে কাজ করছে? আমরা যদি ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ১৪৪ ধারার দিকে দেখি তাহলে দেখবো, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ জনগনের নিরাপত্তা এবং জীবন ও স্বাস্থ্য ঝুকি এড়াতে জরুরী অবস্থা জারী করতে পারেন। আর মেট্রোপলিটন এলাকাতে পুলিশ কমিশনার এই আদেশ দিতে পারেন। সেনাবাহিনীর সদস্যগণ প্রচলিত আইন অনুসারে মূলত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গনকে সহায়তা এবং আশু পদক্ষেপ নিতে কাজ করবেন। উদাহরনস্বরুপ বলা যায়, দেখা গেল হঠাৎ করে কোন উপজেলা পর্যায়ে অস্থায়ীভাবে একটি হাসপাতাল দরকার। সেনাবাহিনী ৩ ঘন্টার মাঝেই এ রকম হাসপাতাল তৈরী করতে পারে।
আসুন দেখি প্রচলিত আইনে এই রকম সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে কি বলেছে। সংক্রামক রোগ (প্রতিরোগ,নিয়ন্ত্রন ও নিমূর্ল) আইন ২০১৮ এর ১১ ধারা অনুসারে সরকার সংক্রামিত এলাকায় কোন ব্যক্তির প্রবেশ নিয়ন্ত্রন এবং নিষিদ্ধ করতে পারেন। উপধারা (২) অনুসারে প্রয়োজনীয় যেকোন ব্যাবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। এছাড়াও উল্লেখিত আইনের ১৪ ধারা অনুসারে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলাদা রাখতে পারবে। এই আইনের ২৪ ধারা মতে, সংক্রামক রোগের বিস্তার এবং তথ্য গোপন করলে ৬ মাসের কারাদন্ড বা ১ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডে দন্ডিত করা যাবে। ২৬ ধারায় বলা হয়েছে কেউ যদি সংক্রামক রোগ সম্পর্কে কোন মিথ্যা বা ভুল তথ্য প্রদান করে তবে ২ মাসের কারাদন্ড বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবে।
আমরা যদি দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ২৭১ ধারা অনুসারে কোন ব্যক্তি যদি কোয়ারেন্টিন (সঙ্গরোধ) এর আদেশ অমান্য করে তবে তাকে ৬ মাস পর্যন্ত কারাদন্ড বা জরিমানা বা উভয়দন্ডে দন্ডিত করা যাবে। এছাড়াও এই আইনের ২৬৯ এবং ২৭০ অনুসারে জীবন বিপন্নকারী মারাত্মক রোগের সংক্রামন বিস্তার করতে পারে এরুপ অবহেলাপূর্ণ কাজ করা অথবা বিদ্বেষমমূলক কোন কাজ যদি কোন ব্যক্তি করে তাহলে, ৬ মাস পর্যন্ত কারাদন্ড এবং বিদ্বেষমূলক কাজের ক্ষেত্রে ২ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড প্রদান করা যাবে। উভয় ক্ষেত্রেই কারাদন্ডের পাশাপাশি অর্থদন্ড বা উভয়দন্ড প্রদান করা যাবে।
সর্বোপরি আইন মেনে চলুন, নিজে নিরাপদে থাকুন এবং পরিবার তথা সমাজ এবং দেশের মানুষের জন্য নিরাপদ থাকা নিশ্চিত করুন। আপনার এই সঙ্গরোধ হতে পারে হাজার হাজার মানুষের রক্ষাকবচ।
সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সরকারের প্রতি বিশ্বাস রাখুন, নাগরিক হিসেবে আমাদের উচিৎ সংকারকে সহায়তা করা এবং আমাদের সকলের সম্মেলিত প্রচেষ্টা পারে এই দুর্যোগকে রুখে দিতে।
 লেখক- শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।