মনিরা নাজমী জাহান

মহামারীর সংক্রমন বনাম গুজবের আক্রমন

মনিরা নাজমী জাহান

সামাজিক মনোবিজ্ঞানী গর্ডন অলপোর্ট এবং লিও পোস্টম্যান যথার্থই বলেছেন যে ‘প্রতিটি গুজবেরই শ্রোতা থাকে।’একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, ঐতিহাসিকভাবে প্রতিটি মহামারীর সময় এই গুজব এবং ষড়যন্ত্র তত্ব ব্যপক ভাবে বিস্তার লাভ করেছে। একটু সুক্ষভাবে লক্ষ্য করলে আমরা দেখবো, একটি কুচক্রী মহল ইচ্ছাকৃত ভাবে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে একটি প্রতিষ্ঠান কিংবা  একটি দেশে অথবা সমগ্র বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ এবং ধ্বংস করার নিমিত্তে গুজব এবং ষড়যন্ত্র তত্ব গুলো সমাজে ছড়িয়ে থাকে।

সর্ব প্রথম যে বিষয়টি জানা প্রয়োজন তা হল গুজব কি ? কোন বিষয়টিকে আমরা গুজব নামে অভিহিত করবো ? গর্ডন অলপোর্ট এবং লিও পোস্টম্যানের মতে গুজব বলতে সেই সমস্ত বিশ্বাস কে বোঝায় যে সমস্ত বিশ্বাস কোন প্রমান না থাকা সত্ত্বেও তা মানুষের কথার মাধ্যমে সমাজে বিস্তার লাভ করে। তবে যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই  গুজব বিস্তারের  মাধ্যমেও এসেছে পরিবর্তন। এখন মানুষের মুখে মুখে ছড়ানোর পরিবর্তে গুজবের মাধ্যম হিসেবে ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া।

এরপরে যে বিষয়গুলো আমাদের জানা প্রয়োজন তা হল এই গুজব বিষয়টি  কোন বৈশিষ্ট্যের কারনে সমাজে এমন ভয়ানক ধ্বংসলীলা চালাতে পারে ? কি উদ্দেশ্য নিয়ে এই গুজব ছড়ানো হয় ?এই  প্রশ্নের উত্তর খুজতে হলে আমাদেরকে আলোকপাত করতে হবে পৃথিবীতে  বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী কর্তৃক প্রণীত গবেষণাগুলোর দিকে।

মনোবিজ্ঞানী যমুনা প্রসাদ যিনি কিনা উত্তর ভারতে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়ার গুজবের বিষয়বস্তু নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। সেই গবেষণা শেষে মনোবিজ্ঞানী যমুনা প্রসাদ  গুজবের উৎপত্তি  ও সংক্রমণের বিষয়ে  সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার একটি তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন। সেই তত্ত্বে তিনি গুজবের ৫ টি বৈশিষ্ট্য কথা বলেছেন যে বৈশিষ্ট্য গুলো সমাজ কে নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করে। তিনি এই ৫টি বৈশিষ্ট্যর কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন ১)গুজবটি অবশ্যই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করবে। ২)গুজবটি একেবারেই অপরিচত ঘটনা দ্বারা সৃষ্ট হবে। ৩) গুজবে যে ব্যক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত দেখানো হবে তার অনেক বিষয় অজানা রাখা হবে ৪)এমন কিছু বিষয়ের অবতারনা করা হবে যা যাচাই যোগ্য নয়।৫) কোন বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধারের জন্য গুজবটি সমাজে ছড়ানো হবে। আমরা যদি সাম্প্রতিক সময়ে করোনা ভাইরাসের কারনে সৃষ্ট পরিস্থিতির দিকে তাকাই তাহলে দেখবো এই করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে যেসব গুজব ছড়ানো হয়েছে সেই গুজব গুলোর মধ্যেও উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য গুলো বিদ্যমান।

মনোবিজ্ঞানী রবার্ট এইচ ন্যাপ তার “সাইকোলজি অফ রিউমার” নামক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে গুজবকে কেন ছড়ানো হয় অথবা গুজব ছড়ানোর উদ্দেশ্য কি? তিনি ভ্রান্ত আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছড়ানো গুজবকে ৩টি ভাগে ভাগ করেছেন।  প্রথমটি হচ্ছে “পাইপ ড্রিম রিউমার” অর্থাৎ যে শ্রেণীর গুজব মুলত ছড়ানো হয় ভালো কোন উদ্দেশ্য নিয়ে। এই শ্রেণীর গুজবে গুজব ছড়ানো ব্যক্তিটি চান যেন গুজবটি যেন সত্যি হয়। কারন এই ধরনের গুজব ছড়ানোর পিছনে থাকে ভালো কোন উদেশ্য । উদাহরণস্বরূপ বলা যায় , বর্তমান সময়ে গুজব ছড়ানো হয়েছে যে থানকুনি পাতা খেলে করোনা ভাইরাস মারা যায় । দ্বিতীয়টি  হচ্ছে “বুগি রিউমার” যেটা ছড়ান হয় সমাজে আতংক ছড়ানোর উদ্দেশ্যে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাস নিয়ে অডিও ক্লিপের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই প্রকারের  গুজব ছড়ানোর দায়ে  ইফতেখার মোহাম্মদ আদনানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সর্বশেষ প্রকার হচ্ছে “ওয়েজ ড্রাইভিং এগ্রেশন রিউমার”। মূলত  এই প্রকার গুজব ছড়ান হয় প্রতিপক্ষকে ক্ষতি বা ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নিয়ে  । সাম্প্রতিক সময়ে করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে একটি বিভিন্ন ধর্মের গোত্রের মানুষ একে অপরকে দোষারোপ করছে।

একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রতিটি মহামারী এবং বিপর্যয়ের সময় এই ধরনের গুজব ছড়ানো হয় এবং  প্রতিটি মহামারিতে ছড়ানো গুজবের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য প্রায় একই ধরনের। যে সমস্ত কারনে মহামারীর সময়ে গুজব ছড়ানো হয় তার মধ্যে রয়েছে  নিজেকে জাহির করার মানসিকতা অর্থাৎ যে বা যিনি গুজব ছড়ানো তার উদ্দেশ্য থাকে সমাজের কাছে জাহির করা যে তার এমন তথ্য আছে যার নাগাল চাইলেও কেউ পেতে পারবে না । উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সাম্প্রতিক সময়ে ইউটিউবার ডানা অ্যাশলি তার পোষ্ট করা ভিডিও মাধ্যমে এই গুজব ছড়ান যে  চীনা উহান শহরে  5G মোবাইল প্রযুক্তি চালুর কারনে করোনা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল । আরেকটি গুরুত্ব পূর্ণ উদ্দেশ্য লক্ষ্য করা যায় যে সমস্ত গুজবে আতংক ছড়ানো হয় সেই সব গুজবের ক্ষেত্রে, অনেক সময় দেখা যায় গুজব ছড়ানো ব্যক্তিটি আসন্নও বিপর্যয় সম্পর্কে সতর্ক  করতে গিয়ে গুজব টি সমাজে ছড়িয়ে দেয়। সর্বশেষ যে বিষয়টি দেখা যায় তা হল গুজব ছড়ানো ব্যক্তিটি নিজেই আসন্ন বিপদ সম্পর্কে  আতংকিত হয়ে  গুজবটি ছড়িয়ে ফেলে।

শুধু যে মহামারীর সময় যে গুজব ছড়ানো হয় তা কিন্তু নয় বরং কখনো কখনো একটি সংক্রামক ব্যধি গুজব হবার পিছনে গুজব বিশেষ ভুমিকা পালন করে। প্রফেসর  চার্লেস রোজেনবার্গ  তার গবেষণায় দেখিয়েছেন একটি সংক্রামক ব্যধি মাহামারি হবার পেছনে গুজব কিভাবে কাজ করে।তিনি দেখিয়েছেন তিনটি ধাপে মুলত এই কাজটি হয় । প্রথম ধাপে দেখা যায় মহামারী কে কেন্দ্র করে এক ধরনের উদাসীনতা সৃষ্টি করা হয় বা বিষয়টিকে হালকা করে দেখার প্রবনতা সৃষ্টি করা হয় । যেমনটি করা হয়েছে আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে প্রথমে ছড়ানো হয়েছে যে বিষয়টি চীনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে যেহেতু আমাদের দেশ থেকে চীনের দূরত্ব অনেক তাই আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা নেই ।

যেহেতু একটি মহামারী খুব স্বাভাবিকভাবেই পুরো সমাজের উপর এক ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি করে তাই দ্বিতীয় ধাপে বুঝানো হয় যে এই মহামারীর বিষয়টি দৈব বিষয় এবং এর সমাধান ও দৈব সুত্রে পাওয়া যাবে। করোনা মহামারীর সময় আমরা দেখেছি স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ, মুত্র পান ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে  প্রতারণা ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয় ধাপে আরেকটি বিষয় ঘটে তা হল ধর্ম বর্ন জীবনযাত্রার ধরনকে কেন্দ্র করে পরস্পরকে দোষারোপ।১৪শ শতকে যখন প্লেগ ইউরোপ মহামারী আকার ধারন তখন হঠাৎ ইহুদীদের দোষারোপ করা হয় যে তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার এই প্লেগ ছরিয়েছে ।সাম্প্রতিক সময়ে করোনাকে কেন্দ্র করে আমরা দেখেছি কখন বলা হচ্ছে বিশেষ ধর্ম আক্রান্ত হবে না , কখন ও বলা হচ্ছে বিশেষ কারো খাদ্যাভ্যাসের কারনে হচ্ছে ইত্যাদি।এমনকি এখন আমেরিকা করোনা ভাইরাসের জন্য চীনেকে দোষারোপ করছে

এই ধাপে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ঘটে তা হল অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে। এই ধাপে কিছু ব্যবসায়ীরা মিথ্যা প্রচারনা চাইলে বা অযথা মজুদ করে  বিশেষ কোন দ্রব্যের দাম বাড়ানোর কূট চক্রান্তে লিপ্ত হয়। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু যখন মহামারী আকার ধারন করে তখন নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ কে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি করোনা ভাইরাসের সময় মাস্ক, স্যানিটাইজার কে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা ঘটতে।

সর্বশেষ ধাপে যেটি ঘটে তা হল সরকার দ্বারা আরোপিত স্বাস্থ্য বিষয়ক নিয়মনীতিতে জনগনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। যেমন বিদেশীদের প্রবেশের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি অনেকেই বিভিন্ন কারণে স্বাস্থ্য বিষয়ক নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা করেন নি । এমনকি অনেক দেশে যখন লকডাউন বা কারফিউ দেয়া হয়েছে তখন দেখা গেছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। এই ধরনের প্রতিক্রিয়া মহামারীর সময়ে সমাজের জন্য ভীষণ ক্ষতির কারন হয়ে দাড়ায়।

সর্বোপরি বলা যায় ইতিহাসের প্রাচীনকাল থেকেই গুজবের সাথে মহামারীর নিবিড় সম্পর্ক।  একটি সংক্রামক ব্যধি মহামারীতে পরিনত হবার বিষয়ে গুজব গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। তাই মহামারীর সময় আতংকিত না হলে সচেতনতার সাথে কাজ করতে হবে এবং মহামারী সংক্রান্ত যে কোন খবর প্রচারের আগে চরম দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।অবশ্যম্ভাবী ভাবে সত্য  যে সরকার বা কোন নির্দিষ্ট বাহিনীর পক্ষে মহামারী নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না বরং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের দায়িত্বশীল আচরণ পারে মহামারীর ভয়াবহতা কে রুখে দিতে ।

(লেখকঃ শিক্ষক , আইন বিভাগ , ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়)