ফাঁসি (প্রতীকী ছবি)

মৃত্যুূদন্ড ও আইনী ধাপ সমূহ

মোঃ জিয়াউর রহমান :

শাস্তির ৪ টি মতবাদ (theory) আছে- ১. অন্যকে ভয় পাইয়ে দেওয়া যে অপরাধ করলে কি পরিনাম হতে পারে (Deterrent Theory), ২. অপরাধীকে আটকে রেখে নতুন করে অপরাধ ঠেকানো (Preventive/ Incapacitation Theory), ৩. যতটুকো অপরাধ, বিনিময়ে ততটুকো ফেরৎ দেওয়া বা প্রতিশোধ নেওয়া (Retributive Theory) , ৪. ভাল হওয়ার জন্য সুযোগ দেওয়া (Reformative Theory)। মৃত্যুদন্ড (Death Penalty) প্রতিশোধমূলক (Retributive) শাস্তি ব্যবস্থার একটি উদাহরণ। মৃত্যুদন্ড নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতানৈক্য আছে। Amnesty International এর রিপোর্ট অনুযায়ী পৃথিবীতে ১৪২ টি দেশে মৃত্যদন্ড নেই, অপরাধ যত বড়ই হোক, তারা কাউকে মৃত্যুদন্ড দিবে না। ৫৬ টা দেশ তাদের আইনে মৃত্যুূদন্ডের বিধান রেখে দিয়েছে। এই ৫৬ টির মধ্যে ২৩ টি দেশ মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে এবং এগুলোর মধ্যে ১ নম্বর চায়না, ২ নম্বর ইরান, ৩ নম্বর সৌদি আরব। বাংলাদেশ মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা ৫৬ টা দেশের মধ্যে একটি হলেও মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার হার খুব বেশী নয়। আমাদের দেশে মোট ১৭ টি আইনে মৃত্যুদন্ডের বিধান আছে এবং সবমিলিয়ে ৬০ টি অপরাধ মৃত্যুদন্ডযোগ্য।

কেউ কেউ দাবী করে, মৃত্যুদন্ড অপরাধকে কমাতে পারে না। আমাদের সর্বোচ্চ আদালত Appellate Division সমাজ ব্যস্তবতায় মৃত্যুদন্ড বহাল রাখাকে সমর্থন করেছেন। BLAST and others Vs State মামলায় আমাদের এপেক্স কোর্ট (AD) বলছেন “Our social conditions, social and cultural values are completely different from those of western countries. The European Union has abolished death penalty in the context of their social conditions and values, but we cannot totally abolish a sentence of death in our country because the killing of woman for dowry, abduction of woman for prostitution, the abduction of Children for trafficking are so rampant which are totally foreign to those developed countries.” 68 DLR [2016] (AD)1.

মৃত্যদন্ডযোগ্য কোন অপরাধ হলে তো আর সাথে সাথে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় না। এটা একটা দীর্ঘ আইনী প্রক্রিয়া। প্রথমে পুলিশ তদন্ত করে আদালতে রিপোর্ট (চার্জসিট) দেয়। তারপর চার্জ/ অভিযোগ গঠন হয় (কার বিরুদ্ধে কি অপরাধের অভিযোগ)। এরপর সাক্ষী শুরু হয়- রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী ঘটনা বলে, আসামী পক্ষ জেরা করে। কোন আসামী পলাতক থাকলে বা আদালতে উপস্থিত না হলে পদ্ধতিগত ভাবে পলাতক ঘোষণা (Section 339B, CrPC) করতে হয়। অতঃপর LR Manual এর বিধান মতে পলাতক এর জন্য রাষ্ট্র সরকারী খরচে আইনজীবী নিয়োগ করে যাকে State Defence বলা হয়। পলাতক আসামী বিচার পরবর্তী সময়ে আটক হলে সে আর কোন আইনী প্রতিকার লাভে হকদার হয় না, কেননা সে পলাতক হয়ে (fugitive) আইনী প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করেছে। উপরন্ত তার পক্ষে সরকারি খরচায় নিযুক্ত আইনজীবী আইনী লড়াই চালিয়েছে।

রাষ্ট্র পক্ষের সাক্ষ্য শেষ হলে আসামীকে দোষীসাব্যস্ত করা যায়- সাক্ষ্যের এমন অংশ আবার পড়ে শুনিয়ে বলতে হয় (CrPC এর ৩৪২ ধারায় পরীক্ষা), এ বিষয়ে আপনার কোন ব্যাখ্যা আছে কিনা, আপনি দোষী কি না এবং নিজের পক্ষে কোন সাক্ষী দিবেন কিনা। সাধারণত আসামীপক্ষ কোন সাক্ষী দেয় না, কেননা প্রমানের ভার সম্পূর্ণ রাষ্ট্রপক্ষের। এরপর শুরু হয় যুক্তিতর্ক (Sec. 265J, CrPC)। রাষ্ট্রপক্ষ বলে, কেন শাস্তি হবে, আসামীপক্ষ বলে, কেন খালাস পাবে। তারপর আদালত সাক্ষ্য, প্রমাণ সব বিবেচনায় নিয়ে রায় দেয় (Sec. 265K, CrPC)। মৃত্যুদন্ডযোগ্য অপরাধে আসামীর দোষ প্রমাণ হলে মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়- তবে কোনটা হবে তা নির্ভর করে, অপরাধের মাত্রা ও তা সংঘটনের প্রক্রিয়ার উপর। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ৬ টি অপরাধ আছে যার একমাত্র শাস্তিই হলো মৃত্যুদন্ড (Mandatory Death Sentence) [১. সংবিধান স্থগিত বা বিলোপ করা, ২. যাবজ্জীবন দন্ডে দন্ডিত আসামী কর্তৃক হত্যাকান্ড, ৩. যাবজ্জীবন দন্ডে দন্ডিত আসামী কর্তৃক হত্যাচেষ্টা, ৪. যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে হত্যা, ৫. বিমান বাহিনী আইনে বিদ্রোহ, ৬. নৌ বাহিনী আইনে বিদ্রোহ]। অপরাধের দন্ড মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন- যাই দিক- বিচারক কেন এমন শাস্তি দিলো রায়ে তার কারণ উল্লেখ থাকবে [Sec. 367(5), CrPC]। মৃত্যুদন্ডের আদেশে লেখতে হয়, ‘মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হোক’ (Sec. 368, CrPC)।

জেলা পর্যায়ে সেসন কোর্টে মৃত্যুদন্ড হলেই সবশেষ- তা নয় ববং আইনী লড়াই এর শুরু বলা যায়। মৃত্যুদন্ড হলে আসামীপক্ষকে ৭ দিনের মধ্যে মাননীয় হাইকোর্টে আপীল করতে হয় (Sec. 371 CrPC)। রায় ঘোষণার ৩ দিনের মধ্যে (Rule 118 Cr.R.R.O) সমস্ত কাগজপত্র Confirmation এর জন্য (Sec. 374 CrPC) হাইকোর্টে পাঠাতে হয়। আসামী আপীল না করলেও হাইকোর্ট স্বয়ং সবকিছু পর্যালোচনা করে রায় দিবে। হাইকোর্টও মৃৃত্যুদন্ড বহাল রাখলে মাননীয় আপীল বিভাগে আপীল হবে। আগে স্বয়ংক্রিয় ভাবে আপীল বিভাগে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। পরে সংবিধান সংশোধন করে বলা হয়েছে আপীল বিভাগের অনুমোদন ছাড়া কোন মৃত্যুদন্ড কার্যকর হবে না (Article 103, Constition)।  একজন মানুষের জীবন যেন কোন ভুল বিচারের শিকার না হয়, এ জন্য এতগুলো স্তর রাখা হয়েছে। যা হোক, আপীল বিভাগও মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রাখলে রিভিউ করা যাবে। রিভিউ হলো একই বিষয়ে পুনরায় বিবেচনা করার অাবেদন। ৯৯% ক্ষেত্রেই Review মঞ্জুর হয় না।

সর্বশেষ আইনী পদক্ষেপ হিসেবে আপীল বিভাগের আদেশ প্রাপ্তির পর ২১ দিন হতে ২৮ দিনের মধ্যে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় (Sec.991 VI, Jail Code)। আইনগত লড়াই এ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার পর দন্ডিত মহামান্য রাষ্টপতির নিকট ক্ষমা ভিক্ষা (clemency) করার সুযোগ পাবে [ Art 49, Constitution & Sec. 991, Jail Code। মৃত্যুদন্ড কার্যকরের দিনক্ষণ ঠিক করার পর আত্নীয়স্বজনকে শেষ দেখা করার জন্য খবর দেয়া হয় (Sec. 999 Jail Code)। মৃত্যুদন্ড রাতের যে কোন সময় কার্যকর করা হয় (Sec. 1001 Jail Code)। এ সময় ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, ডাক্তার উপস্থিত থাকেন (Sec.1003 Jail Code)। সবকিছু প্রস্তুতের পর ফাঁঁসির দড়ি দন্ডিতের গলায় লাগানোর পর জেল সুপারের ইশারায় সহকারী (hangman) লিভার টেনে ফাঁসি কার্যকর করে। ২৫.৪ ডায়ামিটারের ম্যানিলা দড়িতে ৩০ মিনিট ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার নিয়ম (sec.1006, Jail Code), তবে সাধারণত ৫/১০ মিনিট রাখাই মৃত্যু নিশ্চিতের জন্য যথেষ্ট হয়। তারপর পোস্টমর্টেম করে লাশ নিহত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন এর নিকট বুঝিয়ে দেয়া হয় (Sec.1007, Jail Code)

মোঃ জিয়াউর রহমান

লেখকচীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মাগুরা
judgezia@gmail.com