স্যার ব্যারিস্টার কিয়ার স্টারমার

যুক্তরাজ্য লেবার পার্টির নেতা ব্যারিস্টার স্টারমার এবং ইতিহাসখ্যাত ‘ম্যাক-লাইবেল’ মামলা

মুহাম্মদ তাজ উদ্দিন:

স্যার ব্যারিস্টার কিয়ার স্টারমারকে তাদের নতুন নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছে যুক্তরাজ্যের প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টি। গতকাল ৪ মে তাকে লেবার দলের নতুন নেতা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ সরকারের বিপক্ষে সংসদে এখন থেকে জেরিমি করবিনের পরিবর্তে দেখা যাবে ব্যারিস্টার কিয়ার রনডি স্টারমারকে।

ঈর্ষণীয় ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী কিয়ার স্টারমার একজন আইনজীবী হিসেবে যেমন সফল, তেমনি বৃটেনের রাজনীতিতেও ধুমকেতুর মত তার আবির্ভাব। মাত্র ২০১৫ সালে মধ্য লন্ডনের হলবর্ণ ও সেন্ট প্যানক্রিয়াস আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। অক্সফোর্ডের এই ল’ গ্র্যাজুয়েট এর আগে কিউসি (কুইন্স কাউন্সেল) মনোনীত হন। তিনি ডিরেক্টর অব পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে বা এটর্নী জেনারেল হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এটর্নী জেনারেল পদে দায়িত্ব পালনকালেই তিনি নাইটহুড খেতাব পান।

তবে, রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও ডিফেন্স ল’ইয়ার হিসেবে গোটা ইউরোপ জুড়ে পরিচিতি পেয়েছিলেন স্যার স্টারমার। ‘ম্যাক লাইবেল কেইস’ নামে খ্যাত বৃটেনের ইতিহাসের দীর্ঘ সময় ধরে চলা মানহানির মামলায় দুই মানবাধিকার আইনজীবীর পক্ষে লড়ে জয় পেয়েছিলেন স্টারমার।

বিশ্বখ্যাত ফাস্ট ফুট কোম্পানী ম্যাকডোনাল্ডস এই মামলা করেছিল লন্ডন গ্রীণপিসের দুই কর্মী হেলেন স্টিল ও ডেভিড মরিসের বিরুদ্ধে। স্টিল ও মরিস দুজনে ২০০৫ সালে ম্যাকডোনাল্ডস-এর বিরুদ্ধে ৬ পৃষ্ঠার একটি লিফলেট বিতরণ করেছিলেন লন্ডনে। ঐ লিফলেটে তারা অভিযোগ করেছিলেন, ম্যাকডোনাল্ডস তার কর্মীদের অভার টাইম দেয়না, তারা চিকেন ও অন্যান্য মাংস তাদের ফাস্টফুডে ব্যবহার করে, যে সব তারা পশুদের প্রতি অমানবিকভাবে ব্যবহার করে এবং ম্যাকডোনাল্ডস-এর খাবার দীর্ঘমেয়াদে খেলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ে। এই প্রচারণায় প্রতিষ্ঠানের মানহানি হয়েছে- এমন অভিযোগ এনে আদালতে যায় ম্যাকডোনাল্ডস। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর  নিন্ম আদালতে এই মামলা চলে। তারা স্টিল ও মরিসসহ লন্ডন গ্রীণ পিসের ৫ কর্মীকে মানহানির মামলায় অভিযুক্ত করে। এ সময় বার বার আদালতের পক্ষ থেকে মানবাধিকার কর্মী স্টিল ও মরিসকে বিষয়টি আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু, স্টিল ও মরিস আইনী লড়াই চালিয়ে যাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তাদের অন্য ৩ সহকর্মী ম্যাকডোনাল্ডের সাথে আপোস করেন। কিন্তু স্টিল ও মরিস অনড় থাকেন।

ম্যাকডোনাল্ডস্ তাদের পক্ষে দাঁড় করায় বৃটেনের সব বাঘা বাঘা আইনজীবীকে। অন্যদিকে, স্টিল ও মরিস তাদের সীমিত সাধ্য নিয়ে আইনী লড়াই চালিয়ে যান। এমনকি, তারা সরকারের কাছ থেকেও আইনী সহায়তা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ফলাফল যা হবার তা হয়। নিন্ম আদালত স্টিল ও মরিসকে দোষী সাব্যস্ত কওে ৬০ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দেয়। নিন্ম আদালতের এই আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করেন স্টিল ও মরিস। সেখানেও এই রায় বহাল থাকে।

এ সময় নির্যাতিত মানবাধিকার কর্মী স্টিল ও মরিসের পক্ষে আইনী সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন স্যার কিয়ার স্টারমার। তিনি স্টিল ও মরিসের পক্ষে ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিসে আপীল দায়ের করেন। সেখানে শুনানীকালে বাক স্বাধীনতার পক্ষে যুগান্তকারী বক্তব্য রাখেন ব্যরিস্টার কিয়ার স্টারমার। ইউরোপীয়না কোর্ট অব জাস্টিস ফাস্ট ট্র্যাক মামলা হিসেবে প্রতিদিন শুনেন স্টিল ও মরিসের আইনজীবী স্টারমারের বক্তব্য। এরপর আদালত ২০০৫ সালে ২০০৫ সালের ১৫ ফ্রেব্রুয়ারী যুগান্তকারী রায় প্রদান করেন। রায়ে স্টিল ও মরিসকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয় এবং তাদেরকে ৫৭ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য বৃটেন সরকারকে নির্দেশ প্রদান করেন।

বৃটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা মানহানির এই ‘মামলা ম্যাক-লাইবেল’ মামলা হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেয়। বৃটেনের চ্যানেল ফোর, বিবিসিসহ বিশ্বের প্রায় সকল আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যম এই মামলার উপর ডকুমেন্টারী তৈরী করেন। আইন অধ্যয়নের ইতিহাসে এই মামলার রায় ও ফাইন্ডিংসগুলো বিশ্বের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়।

প্রায় ডুবন্ত এক মামলায় মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে ও জয়লাভ করে গোটা ইউরোপ জুড়ে তারকা আইনজীবীর খ্যাতি পেয়ে যান স্যার কিয়ার স্টারমার।

২০০৫ সালে তিনি এমপি পদে দাঁড়ালে বিপুল ভোটে জয় পান। তবে, ছাত্রজীবন থেকেই লেবার দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন স্টারমার। তার বাবা মা দুজনে লেবার দলের প্রতি এতই অনুরক্ত ছিলেন যে, তার জন্মের সময়কালীন লেবার দলীয় লিডারের নামেই তার নাম রাখেন স্টারমার।

খ্যাতিমান এই আইনজীবী বৃটেনের একজন বিপুল জনপ্রিয় নেতা জেরিমি করবিনের স্থলাভিষিক্ত হলেন। জেরিমি করবিন বিশ্ব জুড়ে যুদ্ধ বিরোধী নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অসাধারণ বাগ্মী জেরিমির ইরাক যুদ্ধ বিরোধী ভাষণটি কয়েক কোটি মানুষ ইউটিউবে দেখেছেন। লেবার পার্টির ইতিহাসে সবয়েচে ক্যারিশমাটিক নেতাদের তালিকাতেও উচ্চারিত হয় জেরিমি করবিনের নাম। কিন্তু, গত নির্বাচনে বরিস জনসনের বিরুদ্ধে লেবার পার্টিকে জয়ী করতে ব্যর্থ হন করবিন। এই ব্যর্থতার দায় নিয়ে বিরোধী দলীয় নেতা ও দলীয় প্রধানের পদ ছাড়ে করবিন। এরপর দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে লেবার পার্টির কর্মীদের প্রত্যক্ষ ভোটে লেবার পার্টির প্রধানের পদে নির্বাচিত হন স্যার কিয়ার স্টারমার। গত ৪ এপ্রিল তাকে সংসদে প্রধান বিরোধী দলীয় নেতার আসনে বসিয়েছে লেবার পার্টি। পুরো বৃটেনে জুড়ে চরম ভাবে কোনটাসা হয়ে থাকা লেবার পার্টিকে কতটা উজ্জীবিত করতে সক্ষম হন স্টারমার- সেই গতিধারাতেই এখন চোখ রাখবে বৃটেনের জনগণ।

মুহাম্মদ তাজ উদ্দিন

লেখক- সাংবাদিক ও আইনজীবী; যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিশ্লেষক।