কাজী শরীফ, সহকারী জজ, নোয়াখালী

পুলিশ : অপ্রতুল সুবিধাপ্রাপ্ত বাহিনীর ভাবমূর্তি উদ্ধারের এ যাত্রা অব্যাহত থাকুক

কাজী শরীফ:

২০০৪ সালে আমি চট্টগ্রাম ক্যান্ট পাবলিক কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ি। তখনই মূলত তার্কিক হিসেবে ভালোভাবে আত্নপ্রকাশ। একটা বিতর্কের বিষয়ের সাথে কোনভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংযোগ ছিল। দু:খিত এ মুহুর্তে বিষয়টা আমার পুরোপুরি মনে নেই। এ বিষয়ে পড়াশুনা করার জন্য চট্টগ্রাম গণগ্রন্থাগারে যাই। আমার তখন পড়াশুনার অন্যতম জায়গা ছিল চট্টগ্রাম শহিদ মিনারের বিপরীতে অবস্থিত গণগ্রন্থাগার। কিছু পত্রিকাও পড়ছিলাম।

স্পষ্টত মনে পড়ে পুলিশদের নিয়ে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় শিরোনাম ছিল “চার হাজার চারশত টাকা বেতনের মানবেতর জীবন।” আমার বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বলে পুরো রিপোর্ট পড়লাম। পরদিন মঞ্চ কাঁপিয়ে বলেছিলাম ৪৪০০ টাকা মাসিক বেতন মানে একজন কন্সটেবলের প্রতিদিনের আয় ১৪৭ টাকা। ১৪৭ টাকা দিয়ে অন্তত চারজনের সংসারের পাঁচটা মৌলিক চাহিদা পূরণ সম্ভব কিনা? চারজন সদস্য বলেছিলাম কারণ ছেলে হোক আর মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট রাষ্ট্রের এ স্লোগান মানলেও স্বামী স্ত্রী মিলে একটা সংসারে চারজন হয়ে যায়। মা বাবা বেঁচে থাকলে সংখ্যাটা স্বাভাবিকভাবেই আরো বেশি হয়ে যায়। সুতরাং পুলিশের জীবন ২০০৪ সালের পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী অমানবিক ছিল এটা নি:সন্দেহ। এরকম আরো চার পাঁচটা বাস্তব ঘটনা যুক্তি দিয়ে বলে দলগতভাবে জয়লাভ করে ও নিজে শ্রেষ্ঠ বক্তা হয়ে পুলিশের জীবন নিয়ে আর ভাবিনি। এদেশের অধিকাংশ মানুষ আমার মতই। যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণ অনুভব করলেও প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে তার ভবলীলা সাঙ্গ হওয়ার আগ পর্যন্ত এটা নিয়ে ভাবেনা!

সম্ভবত এর বছর পাঁচেক পর প্রথম আলোর আরেকটা প্রথম পাতার প্রতিবেদন আবার আমাকে ভাবিয়ে তোলে। সেখানে একটা ছবিতে আমার চোখ আটকে যায়। ছবিতে দেখা যায় অন্তত বিশজন পুলিশ সদস্য খালি গায়ে পিঠ সিলিং ফ্যানের নিচে উন্মুক্ত রেখে নিজের শরীরকে নামাজে রুকুতে গেলে আমরা যেভাবে থাকি সেভাবে করে রেখেছে। সম্ভবত রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ছবি এটি। এতবছর পর ঠিক মনে নেই। পুলিশের কোন একটি ব্যারাকের ছবিও হতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয় হলরুমের মত একটি রুমে পুলিশ থাকে শতাধিক। ফ্যান আছে মোটে তিনটি। চাকুরির সুবাদে আমার জেলখানার ভেতরে ঢোকার ও কয়েদিদের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। জেলখানার কয়েদিরা খুব কষ্টে থাকলেও তাদের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষে ফ্যানের সংখ্যা আরও বেশি দেখেছিলাম!

বছর তিনেক আগে সময় টেলিভিশনে পুলিশ কন্সটেবলদের মানবেতর জীবন নিয়ে প্রতিবেদন করেছিল। আমার তাও দেখার সুযোগ হয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয় পুলিশ কন্সটেবলদের ব্যারাকে হাসপাতালের বেডের মত একটা বেডে দুই তিনজন থাকতে হয়।স্বাভাবিকভাবেই জায়গা হয়না। তাই পালাক্রমে একজন নিচে থাকে। একজন ডিউটি দিয়ে আসলে অন্যজন বিছানায় ঘুমায়। সে সহকর্মী ডিউটি থেকে একটু আগে চলে আসলেও ঘুমানোর জায়গা পাননা! দিনের বেলায়ও ঘুটঘুটে অন্ধকার ও স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে সেসব কক্ষ।

গতকাল নিউজ টুয়েন্টি ফোরের রিপোর্টে দেখলাম ঢাকায় করোনাকালীন দায়িত্বপালন করা কন্সটেবলরা থাকছে ঢাকার অব্যবহৃত পনেরোটি হোটেলে। সেগুলোতে থাকার পরিবেশ, টয়লেটের অবস্থা ভাষায় বর্ণনাতীত। সারাদিন রাস্তায় ডিউটি করে নিজে খাওয়ার ব্যবস্থা করা সত্যিই অমানবিক। ইতোমধ্যে পাঁচ শতাধিক পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন পাঁচজন!

আমি সাধারণ মানুষ। আমার বক্তব্য আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে না হওয়া অযৌক্তিক নয় তাই গণমাধ্যমের বরাত দিয়েই ব্যাখ্যা করলাম। এতক্ষণ যা লিখলাম সবই বাস্তবতা। এটাকে কল্পকাহিনি ভাববেন না। এরাই আমাদের নিরাপত্তা রক্ষায় জীবন বাজি রেখে কাজ করে চলেছে।

স্বাভাবিক সময়ে পৃথিবীর বায়ুদূষণের দিক থেকে একদম উপরের দিকের শহর ঢাকায় যে পুলিশ সদস্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করেন তার বুকে কত দূষিত পদার্থ জমা হচ্ছে, উচ্চশব্দে তিনি কত দ্রুত শ্রুতিশক্তি হারাচ্ছেন তার পরিসংখ্যান এখানে নেই!

এভাবেই দিনের পর দিন কাজ করে চলছে আঠারো কোটি মানুষের দেশের পুলিশ। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের ফিরিস্তিও খুব নাতিদীর্ঘ নয়!

আমার বিশ্বাস পুলিশবাহিনী নিজেও বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেনা তাদের বিরুদ্ধে জনগণ ও গণমাধ্যমের আনিত অভিযোগ সর্বৈভ মিথ্যা! রাস্তায় টেম্পু, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান যারা চালায় তাদের ট্রাফিকপুলিশ বিষয়ক অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়। কোরবানের ইদে গরুর গাড়ি এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে রাজনৈতিক কর্মীদের মত পুলিশও চাঁদা আদায় করে বলে গণমাধ্যমেই বহু রিপোর্টে এসেছে!

থানা হেফাজতে মৃত্যু থেকে থানায় বসে বিচারকাজ চালানোর অভিযোগও অস্বীকার করার উপায় নেই। যদিও বেতনের অজুহাতে দুর্নীতি করাকে সমর্থন করার উপায় নেই তথাপি সরকারি চাকুরিজীবীদের বেতন ইতোমধ্যে দ্বিগুণ করা হয়েছে। সৎভাবে জীবনযাপন করার মানসিকতা থাকলে এ বেতনে দেশের অন্যান্য সরকারি চাকুরিজীবী জীবনযাপন করতে পারলে পুলিশেরও চলা উচিত।

পুলিশের অর্জন কম নয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে পুলিশ তার ভূমিকা রেখেছে। পুলিশের বিরুদ্ধে অবশ্য রাজনৈতিক মদদপুষ্ট হয়ে ভূমিকা রাখার অভিযোগও মেলে। আমার বিশ্বাস পুলিশ নিজেও এ অভিযোগ অস্বীকার করবেনা। আমি এক্ষেত্রে পুলিশের নয় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা প্রধান বলে মনে করি। যারা যখনই ক্ষমতায় আসেন তারাই পুলিশকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার অভিযোগ আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণগত পরিবর্তন পুলিশের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ থেকে তাদের মুক্তি দিতে পারে।

পুলিশের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে দুর্নীতির যে অভিযোগ আছে তা আমি বিশ্বাস করিনা। আমার বিশ্বাস পুলিশবিভাগেও সৎ সদস্য আছেন। যারা দুর্নীতিবাজ তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে সৎ অফিসারদেরই। কারো দুর্নীতির জন্য পুরো বিভাগ প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার সুযোগ দেয়া যেমন অনুচিত তেমনি বুদ্ধিদীপ্তও নয়!

দেশের করোনা পরিস্থিতিতে পুলিশবাহিনী যে অবদান রাখছেন তাদের প্রশংসার জন্য কোন উপমাই যথেষ্ট নয়। জনগণকে সতর্ক করা থেকে বাজার করে দেয়া, করোনা আক্রান্ত কেউ মারা গেলে তার কবর খোঁড়া ও কবর দেয়া পর্যন্ত সবকিছুতেই পুলিশকে পাওয়া যাচ্ছে সত্যিকার বন্ধুর মত। পুলিশের নেই আত্নপ্রচারের সামান্যতম চেষ্টা! অন্য অনেকের মত সরকারি সাহায্যকে নিজেদের সাহায্য বলে চালিয়ে দেয়ার মিথ্যা প্রচারেও পুলিশকে দেখা যাচ্ছেনা। নিজেদের বেতনের টাকা দিয়েও মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়ার কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ।

আমরা এমন পুলিশই দেখতে চাই। যার উর্দির নিচে মস্ত বড় হৃদয় আছে, সে হৃদয়ে সততা আছে। যে সততা, কর্মনিষ্ঠা ও মানবিক মূল্যবোধের ফলে বদলে যাবে এদেশে আইনশৃঙ্খলার চিত্র। গরীব, সুবিধাবঞ্চিত, ন্যায়বিচারপ্রত্যাশী মানুষের বন্ধু হবে পুলিশ। ফৌজদারি মামলায় নিরপেক্ষ ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে রিপোর্ট প্রদান করে পুলিশ রাখবে ন্যায়বিচারে ভূমিকা।

ইতোমধ্যে আদালত পুলিশের উপর আস্থা রাখছে। উদ্ধারকৃত ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের জন্য অন্য বিভাগের চেয়ে পুলিশের প্রতি আদালত আস্থা রাখছে।

বিলুপ্তপ্রায় ভাবমূর্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে পুলিশের। করোনার এ সময়ে পুলিশ পেয়েছে নিজেকে ভিন্নভাবে জনগণের কাছে উপস্থাপনের সুযোগ। সে সুযোগকে তারা কাজেও লাগাচ্ছে। জুতো সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ সব করছে পুলিশ। আমার মতে সম্মানিত ডাক্তাররা হাসপাতালে জীবন বাজি রেখে লড়ছেন আর পুলিশেরা সতর্ক করা, ত্রাণ দেয়া, মৃতের জানাযা ও কবরের ব্যবস্থা করছে।

মহান আল্লাহ তায়ালা পুলিশকে তাঁর ভাবমূর্তি উদ্ধারের যে সুযোগ দিয়েছেন তা এখন যেভাবে কাজে লাগাচ্ছে পুলিশ অদূর ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকুক। সারাবছর পুলিশের মানবিক ও আইনগত আচরণের প্রত্যাশা করছি। করোনাক্রান্ত পুলিশ সদস্যরা সুস্থ হোক। যারা মারা গেছেন তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা থাকলো। রাষ্ট্র পুলিশের প্রতি আরও মানবিক হোক। পুলিশ তার উদ্ধারকৃত ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখুক। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে যে রক্ষা করা কঠিন এটা পুলিশবাহিনী বিবেচনায় রাখুক।

লেখক- সহকারী জজ, নোয়াখালী।