রায়হান কাওসার, আইনজীবী

সুপ্রীম কোর্ট বারের ঋণ: নবীন আইনজীবীদের দেখে রাখার দায়িত্ব সিনিয়রদেরই

রায়হান কাওসার:

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ছাড়পত্র’ কবিতার কয়েকটি লাইন মনে পড়ে গেল-

‘এসেছে নতুনশিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;

জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ- পিঠে

চলে যেতে হবে আমাদের।

চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণ পণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’

আইন পেশায় নবীন আইনজীবীরা নবজাতকের মতই। নবীনরা শুরুতেই অনেক অনেক টাকা আয় করতে পারেন না। আইন পেশা একটি প্র্যাকটিক্যাল পেশা।শুধুমাত্র তত্ত্বীয় বিদ্যা দিয়ে রাতারাতিএ পেশায় ভাল করার সম্ভব নয়।এ পেশায় ভাল করতে হলে সিনিয়রদের সাথে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে দক্ষতা অর্জন করতে হয় প্রথমে।ফলে আইন পেশার শুরুর দিকে তরূণদের বেশ কষ্ট করতে হয়। অনেক সিনিয়র আইনজীবীবৃন্দ অবসরে যখন তাঁদের আইন পেশার শুরুর দিনগুলির কথাস্মৃতিচারণ করেন- নবীনরা সেটি মনোযোগ দিয়ে শুনে এবং আশায় বুক বাঁধে। ভাবে, তাদের দুর্দিনও কেটে যাবে একদিন সিনিয়রদের মতই।

আইন পেশার প্রাথমিক বছরগুলো শেখার সময়, পরিচিত হবার সময়। এ সময় এত তাড়াহুড়ো করলে চলে না। অবশ্য, ঠিক সেভাবেই কেটে যাচ্ছিল নবীন আইনজীবীদের দিনগুলো। কিন্তু অপ্রত্যাশিত বৈশ্বিক করোনা ক্রাইসিস সেটিতে বিচ্ছেদ ঘটাল। দীর্ঘদীন দেশের অফিস আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় দেশের সকল পেশাতেইকরোনা মহামারীর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, আইনজীবীরাও এর বাইরে নয়।আইনজীবীদের প্রিয় প্রাঙ্গণ ও জীবিকাস্থল আদালতসমূহও বন্ধ। ফলে, আইনজীবী মহলের উপরেও এর প্রভাব পড়েছে সরাসরি, বিশেষ করে তরুণ আইনজীবীদের উপর।

আইন পেশা আত্মমর্যাদাশীল একটি পেশা, সিনিয়র-নির্ভর একটি পেশা। টেকনিক্যাল ও স্বাধীন পেশা হওয়ায় চাকুরীজীবীদের মত মাস অন্তর নির্দিষ্ট কোন বেতনের ব্যবস্থা নেই আইনজীবীদের জন্য। ফলে, তরুণ আইনজীবীদেরকে সিনিয়রদের উপরই নির্ভর করতে হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। এছাড়া, সকল পেশাতেই অগ্রগামী প্রজন্ম হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মকে দেখে রাখার দায়িত্ব নেন সিনিয়ররাই, আইন পেশাতেও তাই। আবার, মানুষ খুব প্রয়োজন বা সমস্যায় না পড়লে আইনজীবীদের কাছে আসতে চায় না। ফলে, আইনজীবীদের আপনজন আইনজীবীরাই। তাই এ পেশায় সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক অন্যান্য পেশার চেয়ে অনেক শ্রদ্ধার এবং দায়িত্বের।

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বারের মাননীয় সম্পাদক মহোদয় কর্তৃক গত ০৩/০৫/২০২০ ইং তারিখে স্বাক্ষরিত একটি নোটিশ মারফত জানতে পারলাম যে, যে সকল বিজ্ঞ আইনজীবীগণ ২০২০ সালের আগে বারের সদস্য হয়েছেন তাঁরা কয়েকটি ক্যাটাগরিতে বার থেকে ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন। তবে, শুধুমাত্র একটি ব্যাচ যারা ২০২০ সালে সদস্যভুক্তির জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছেন, তারাই কেবল উক্ত ঋণ সুবিধাটি পাচ্ছেন না।

পৃথিবীর সকল সংগঠন ও জাতিসত্ত্বাই তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি সংবেদনশীল থাক। নবীদের কথা তারা বিশেষভাবে চিন্তা করেন। নিজেদের অবর্তমানে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম যাতে তাঁদের উত্তরাধিকারভালভাবে টিকিয়ে রাখতে পারে- সেজন্য তারা তাদের নবীনদের যথাযথভাবে গড়ে তোলেন। নবীনদের সুযোগ-সুবিধার কথাই আগে চিন্তা করেন, যাতে কোন কিছুর অভাবের কারণে নবীনদের যথাযথ বিকাশ ব্যাহত না হয়। সুতরাং, সুপ্রীম কোর্ট বারেযারা আইনজীবী হিসেবে নবীনতম, তাদেরকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হিসেবেই চিন্তা করা উচিত, তাদের সুযোগ-সুবিধার কথাই আগে ভাবা উচিত।

বর্তমান সুপ্রীম কোর্ট বার কমিটিতে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের দু’জন নির্বাচিত ও জনপ্রিয় আইনজীবী নেতা রয়েছেন। জনপ্রিয় এবং জুনিয়র-বান্ধব আইনজীবী নেতা হিসেবে যাদের সুপরিচিতি রয়েছে,তাঁদের উচিত হবে অগ্রগামী প্রজন্ম হিসেবে নবীনদের অর্থাৎ ২০২০ সালে যারা সদস্য হিসেবে চূড়ান্তভাবে মনোনিত হয়েছেন, তাদের ঋণসুবিধার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা। কেননা, নবীন বয়সেই আইনজীবীদের সহযোগিতা বেশি প্রয়োজন। সুপ্রীম কোর্ট বারের সকল সদস্যগণই বারের ঋণ সুবিধার আওতায় রয়েছেন। শুধুমাত্র ২০২০ সালে যাদের সদস্যপদ চূড়ান্ত হয়েছে- তারাই কেবল করোনাকালীন এই কঠিন সময়ে বারের সহযোগিতা পাচ্ছেন না। তাই, সুকান্তের বিখ্যাত ‘ছাড়পত্র’ কবিতাটি পড়ে হলেও বর্তমান বার নেতৃবৃন্দদেরকে উজ্জীবীত হওয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি যাতে ২০২০ সালে সদস্য হিসেবে মনোনীত হওয়া তরুণ আইনজীবীরাও বারের উক্ত ঋণ সুবিধা পেয়ে উপকৃত হন এবং এই কঠিন সময় কাটিয়ে উঠতে পারেন।

লেখক- আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।

ইমেইলঃ raihankawsardu@gmail.com