অ্যাডভোকেট রাশিদা চৌধুরী নীলু

বলার স্বাধীনতায়, বলতে হবে হিসেব করে

রাশিদা চৌধুরী নীলু:

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হচ্ছে – বক্তব্য, লেখার এবং যোগাযোগের অন্যান্য ধরণের মাধ্যমে নিজের ধারণা ও মতামতকে নির্দ্বিধায় প্রকাশ করার অধিকার কিন্তু মিথ্যা বা বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যের চরিত্র এবং /অথবা খ্যাতির ক্ষতি করা যাবে না।

একটু পেছনে ফেরা যাক। আশির দশকে সামরিক স্বৈরাচার সামরিক আইন তুলে নেওয়ার পরও গণমাধ্যমের ওপর খবরদারি চালিয়ে যায়। তারা মূলত বিশেষ ক্ষমতা আইনের আলোকেই এমনটা করতে পারত। তথ্য অধিদপ্তর থেকে টাইপ করা নির্দেশনামা রাতে পত্রিকায় আসত। বলা হতো, কোন ছবি কত কলাম হবে, কোন সংবাদ কোন পৃষ্ঠায় কত কলামে যাবে এবং কোন কোন সংবাদ প্রকাশ করা যাবে না। নির্দেশনামার নিচে একজন উপপ্রধান তথ্য কর্মকর্তার স্বাক্ষরবিহীন নাম থাকত। প্রতিটি পত্রিকা এসব নির্দেশ পালন করেছে। এভাবে সেই সময়ের সংবাদপত্র পাঠকের বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়।

তাই ১৯৮৩ সালের ছাত্র আন্দোলনের সময় মুখে মুখে ‘গুজব’ ছড়াত। আর আনসেন্সরড সংবাদ জানতে বাংলাদেশের মানুষ অপেক্ষা করত বিদেশি রেডিওর বাংলা সংবাদ শোনার জন্য। মতামত প্রকাশের অধিকার গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কারণ এটি জনগণকে তথ্য ও ধারণার অবাধ প্রবাহের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিতে সক্ষম করে।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যক্তিগত বিকাশের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এটি আমাদের মতবিরোধের অধিকার এবং শোনার অধিকার দেয়। বিভিন্ন চিন্তাভাবনা এবং মতামত প্রকাশের দ্বারা আমরা আমাদের মৌলিক বিশ্বাস সম্পর্কে নিজস্ব পছন্দগুলো করতে পারি।

আন্তর্জাতিক ও জাতীয় আইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অপরিহার্য হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, স্বাধীনতা প্রকাশের অধিকার বিলের প্রথম সংশোধনী দ্বারা সুরক্ষিত। গণতান্ত্রিক সমাজকে অহিংসতার সাথে শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যাগুলি সমাধান করার এবং একজন ব্যক্তির অধিকারের সম্মান করার জন্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রয়োজনীয়।

মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ১৯ এ বলা হয়েছে: মতামত ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে; এই অধিকারের মধ্যে হস্তক্ষেপ ছাড়াই মতামত রাখা এবং কোনও গণমাধ্যমের মাধ্যমে এবং সীমান্ত নির্বিশেষে তথ্য এবং ধারণাগুলি সন্ধান, গ্রহণ এবং প্রদানের স্বাধীনতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিআর) ১৯ অনুচ্ছেদে মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে একই শর্ত রয়েছে। সনদে ১ম ধারা অন্তর্ভুক্ত করে প্রমাণিত হয় যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, যা একটি মৌলিক অধিকার, যখন এর অনুশীলন জনস্বার্থ বা অন্যের অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্থ করে তখন সীমিত হতে পারে।

ইউরোপীয় কনভেনশন অফ হিউম্যান রাইটস (ইসিএইচআর) এর ১০ অনুচ্ছেদ, মানবাধিকার বিষয়ক আমেরিকান কনভেনশন এর ১৩ অনুচ্ছেদ এবং হিউম্যান অ্যান্ড পিপলস রাইটস সম্পর্কিত আফ্রিকান সনদের ৯ অনুচ্ছেদেও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে কানাডা তার নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে বাধ্য কানাডার অধিকার ও স্বাধীনতা সনদের ধারা ২(খ) অনুসারে “সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং যোগাযোগের অন্যান্য মিডিয়া সহ চিন্তাভাবনা, বিশ্বাস, মতামত এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা” রক্ষা করে। বাকস্বাধীনতাকে কানাডার বিল অফ রাইটস, ধারা ১ (ডি) এবং (এফ) -তে মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতা হিসাবেও আখ্যা দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের আইনের তালিকায় যুক্ত হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন,২০১৮। ১০ই মার্চ থেকে ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত ছয়জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কমপক্ষে তিনটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের হয়। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশন এই আইনের ২৫ ও ৩১ ধারা কেন অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন। এই আইনের ২৫ ধারায় বলা আছে-

“২৫। (১) যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে,- (ক) ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যাহা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করিবার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন, বা

(খ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ণু করিবার, বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার, বা তদুদ্দেশ্যে, অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, বা প্রচার করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।

(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৩ (তিন) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ৩ (তিন) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

(৩) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয় বার বা পুনঃপুন সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ ২৫ ধারায় যেসব অপরাধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন- ভীতিকর, অসত্য, বিরক্তিকর কিংবা আক্রমনাত্নক -এই শব্দগুলোর কোন সু-স্পষ্ঠ সংজ্ঞা নেই।

এই আইনেরই ৩১ ধারায় আছে, “৩১। (১) যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যাহা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটিবার উপক্রম হয়, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ। (২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৭ (সাত) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। (৩) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয় বার বা পুনঃপুন সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ১০ (দশ) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।“ ধারা ৩১ এ উল্লেখিত ‘আইন শৃংখলার অবনতি” কিংবা ‘অস্থিরতা তৈরী” শব্দগুলোর অর্থ সংক্রান্ত কোন সুস্পষ্ঠ ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা আইনটিতে নেই। ফলে আইনের অপব্যবহারের সুযোগ থেকেই যায়।

যাকে মার্কিন যুক্তরাষ্টের সুপ্রীম কোর্ট Void of Vagueness বলে আখ্যা দিয়েছেন। যদি কোন অপরাধের জন্য সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান থাকে, তাহলে কৃত অপরাধটিরও সুস্পষ্ট সংজ্ঞা বা ধারণা আইনে থাকতে হবে ।

কোন ব্যক্তিকে তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান বাকস্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। এই সংবিধানের অধ্যায় -৩ এর ৩৯ (১, ২) অনুচ্ছেদে এ সর্ম্পকে বলা হয়েছে:

৩৯(১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হলো। ৩৯(২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার, নিশ্চয়তা দান করা হলো। এই অনুচ্ছেদে প্রাপ্ত কিছু যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ হলো- (ক) রাজ্যের সুরক্ষার স্বার্থের বিরুদ্ধে (খ) বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিরুদ্ধে (গ) পাবলিক অর্ডার লঙ্ঘন (ঘ) ভদ্রতা বা নৈতিকতা লঙ্ঘন (ঙ) আদালত অবমাননার সাথে সম্পর্কিত যে কোনও কিছুই (চ) কোনও অপরাধে মানহানি বা উস্কানি এছাড়াও, আইসিসিপিআরের ২০(২) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রগুলিকে “জাতীয়, বর্ণ বা ধর্মীয় বিদ্বেষের পক্ষে ওঠা নিষিদ্ধ করা উচিত যা বৈষম্য, বৈরিতা বা সহিংসতার প্ররোচিত করে”। সুতরাং, কানাডা সহ অনেকগুলি দেশ আইন প্রয়োগ করেছে যা সহিংসতা এবং ঘৃণা প্ররোচিত বক্তৃতা সহ নির্দিষ্ট ধরণের অভিব্যক্তিকে সীমাবদ্ধ করে।

ইউকনের মানবাধিকার আইন ব্যতীত কানাডার প্রতিটি মানবাধিকার আইনে এমন বিধান রয়েছে যা কিছু নিষেধাজ্ঞার ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক আচরণের উদ্দেশ্যে বা অন্যকে বৈষম্যমূলক করতে প্ররোচিত করে এমন কিছু বিধি নিষেধ করে। সনদের দ্বারা সুরক্ষিত কোন অধিকার বা স্বাধীনতার অর্থ তার স্বার্থরক্ষার জন্য যে স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছিল তার আলোকে অবশ্যই বুঝতে হবে। শব্দগুলি যখন অন্যদের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে করে, তখন স্পষ্টতই ঘৃণামূলক বক্তব্য সনদের উদ্দেশ্যমূলক মনোভাবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এই আইনগুলি ইঙ্গিত দেয় যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ হতে পারে না — এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও যেখানে বাকস্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত। আবার সেই মতামত এবং চিন্তাভাবনা আইন দ্বারা-ই পরিচালিত হয় সেই বাক স্বাধীনতা।

লেখক- অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।