চন্দন কান্তি নাথ, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা

আইনজীবীর অধিকার ও দায়িত্ব এবং আইনজীবী মক্কেলের যেরূপ সম্পর্ক আইনগত

চন্দন কান্তি নাথ:

বিজ্ঞ আইনজীবীর সাথে মক্কেলের নিয়মিত বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদান হয়। তাঁকে আদালতে মক্কেলের পক্ষে বলতে হয়। কাগজ জমা দিতে হয়। আইনগত ভাবে তিনি কতটুকু বলতে বাধ্য এবং না বললে আইন গত ভাবে তিনি কতটুকু দায়ী। প্রসঙ্গত যদি আইনজীবী কে বলতে হয় তিনি তাঁর বক্তব্যে ও কাগজ পত্র এর জন্যে আইনগত ভাবে দায়ী থাকবেন। তিনি কিভাবে দায়ী থাকবেন। ডিজিটাল মাধ্যমে আবেদনে যদি আইনজীবী বলেন- ‘আমি এই মর্মে প্রত্যয়ন করছি যে, আবেদনের সাথে দেয়া সকল তথ্য সঠিক ও সংযুক্তি সঠিক। অসত্য প্রমাণিত হলে আইনগত ভাবে আমি দায়ী বদ্ধ থাকবো’ তাহলে আইনত আইনজীবীকে কতটুকু দায়ী করা যাবে। আইনজীবীর অধিকারই বা কোথায়?

আইন কি বলে? এক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইনের ধারা ১২৬, ১২৭ এবং.. প্রাসঙ্গিক। ধারা ১২৬ এ পেশা সম্পর্কিত বার্তা শিরোনামে আছে- ‘ব্যারিস্টার, এটর্নি বা উকিল মক্কেলের ব্যারিস্টার, এটর্নি বা উকিল হিসাবে কাজ করিবার সময় এবং উদ্দেশ্যে উক্ত মক্কেল কর্তৃক বা মক্কেলের পক্ষ হইতে তাহার নিকট প্রদত্ত কোন বার্তার বিষয় (to disclose any communication made to him in the course) মক্কেলের অনুমতি ব্যতীত প্রকাশ করিতে অনুমতি পাইবেন না। অথবা বৃত্তিগত কার্য সম্পাদানকালে এবং প্রসঙ্গে মক্কেলের যেই সকল দলিলের সহিত তিনি পরিচিত হইয়াছিলেন, ( to state the contents or condition of any document with which he has become acquainted in the course) সেইগুলির বিষয়বস্তু বা অবস্থার কোন বিবৃতি দিতে পারিবেন না অথবা তাহার কার্যকালে ও উদ্দেশ্যে মক্কেলকে তিনি যে পরামর্শ দিয়াছেন, তাহা প্রকাশ করিতে পারিবেন না।

তবে শর্ত থাকে যে, নিম্নলিখিত বিষয়গুলি প্রকাশ হইতে এই ধারার কিছু অব্যাহিত দিবেন না।

(১) বেআইনী উদ্দেশ্যে সাধনকল্পে যে সংবাদ আদান-প্রদান করা হইয়াছে (any such communication made in furtherance of any illegal purpose)

(২) ব্যরিস্টার, এটর্নি বা উকিল পেশাগত কার্যে নিযুক্ত থাকিবার সময় তৎকর্তৃক লক্ষিত বিষয় যা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তাহার নিযুক্তির পরে কোন অপরাধ বা প্রতারণা সংঘটিত হইয়াছে (any crime of fraud has been committed since the commencement of his employment) অনুরূপ ঘটনার প্রতি উক্ত ব্যারিস্টার, এটর্নি বা উকিল মনোযোগ তাহার মক্কেল কর্তৃক বা মক্কেলের পক্ষ হইতে আকৃষ্ট করা হইয়াছিল কিনা তাহা গুরুত্বপূর্ণ নহে (was or was not directed to such fact by or on behalf of his client)।

ব্যাখ্যা- এই ধারার বর্ণিত বাধ্যবাধকতা নিযুক্তির অবসান ঘটিবার পরও অব্যাহত থাকে। উদাহরণ-

(ক) মক্কেল ক এ্যাডভোকেট খ-কে জানায় ‘আমি জালিয়াতী করিয়াছি এবং আমি চাই যে, আপনি আমার পক্ষে মামলা পরিচালনা করুন।’

ব্যক্তিকে দোষী জানিয়াও তাহাকে প্রতিরক্ষা করা যেহেতু অপরাধমূলক কার্য নহে, সেহেতু উপরোক্ত সংবাদ প্রদানের গোপনীয়তা সংরক্ষিত।

(খ) মক্কেল ক এ্যাডভোকেট খ-কে জানায় ‘আমি একটি জাল দলিল ব্যবহার করিয়া সম্পত্তি দখল লইতে চাই এবং আমার পক্ষে এ বিষয়ে একটি দেওয়ানী মামলা দায়ের করিবার জন্য আপনাকে অনুরোধ করিতেছি।’

অপরাধমূলক উদ্দেশ্যে সাধনকল্পে এই সংবাদ প্রদান করা হইয়াছে বলিয়া ইহার প্রকাশ নিষিদ্ধ নহে।

(গ) তহবিল তছরূপের দায়ে অভিযুক্ত ক তাহার পক্ষে মামলা পরিচালনা করিবার জন্য এ্যাডভোকেট খ-কে নিযুক্ত করিলেন। মামলা চলাকালে খ লক্ষ্য করিলেন যে, তছরূপকৃত পরিমাণ অর্থ ক-এর নিকট হইতে আদায় দেখাইয়া হিসাব খাতায় একটি হিসাব লেখা হইয়াছে, যাহা তাহার নিযুক্তির আরম্ভতে লেখা ছিল না।

যেহেতু ইহা এমন একটি ব্যাপার খ তাহার কার্যকালে লক্ষ্য করিয়াছেন এবং ইহা দ্বারা মামলা চলিতে থাকাকালে প্রতারণা করা প্রতীয়মান হইয়াছে, সেহেতু ইহার প্রকাশ নিষিদ্ধ নহে।’

আবার উকিলদের কেরানীর জন্যে ও একই আইন প্রযোজ্য হবে, উক্ত আইনের ধারা ১২৭ এ আছে,

‘দোভাষী এবং ব্যারিস্টার, উকিল ও এটর্নিগণের কেরানী বা কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও ১২৬ ধারার বিধানসমূহ প্রযোজ্য হইবে।’

একই রূপ ধারা ১২৯ এ ‘আইন উপদেষ্টার সহিত গোপন বার্তার আদান প্রদান’ শিরোনামে আছে- ‘কোন ব্যক্তি ও তাহার পেশাদার আইন উপদেষ্টার মধ্যে গোপনীয় বার্তার আদান-প্রদান হইয়া থাকিলে, সেই ব্যক্তি যদি মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ না করেন, তবে সেই গোপনীয় আদান-প্রদানের বিষয় আদালতে প্রকাশ করিতে তাহাকে বাধ্য করা যাইবে না। যদি তিনি সাক্ষ্য প্রদান করেন, তবে তাহার দেওয়া সাক্ষ্যের ব্যাখ্যার জন্য উক্ত গোপনীয় বার্তা আদান-প্রদানের বিষয় আদালতের জানা প্রয়োজন হইলেই কেবল তাহাকে উহা প্রকাশ করিতে বাধ্য করা যাইবে। অন্য কিছু নহে।’

দেওয়ানি কার্যবিধি আইনের ধারা ২ (১৫)  তে আছে, ‘উকিল বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝায় যিনি অপরের পক্ষে আদালতে হাজির হওয়ার ও যুক্তিতর্ক পেশ করার অধিকারী’ অনুরূপ ফৌজদারি কার্যবিধি এর ৪ ধারাতে আছে-

“advocate”, used with reference to any proceeding in any Court, means an advocate or a mukhtar authorised under any law for the time being in force to practise in any such Court and includes any other person appointed with the permission of the Court to act in such proceeding;

আমাদের সংবিধান এর অনুচ্ছেদ ৩৩ (১) এ আইনজীবীদের উপস্থিতি স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। সেখানে আছে, “….. এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের….. অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।”

আবার সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪০ এ আইনজীবীর পেশার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তাতে আছে- “আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে কোন পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের কিংবা কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার জন্য আইনের দ্বারা কোন যোগ্যতা নির্ধারিত হইয়া থাকিলে অনুরূপ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন আইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের এবং যে কোন আইনসঙ্গত কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার অধিকার থাকিবে।”

কিন্তু অনুচ্ছেদ ৪০ কিংবা ৩৯ এ আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে পেশা গ্রহণ কিংবা চিন্তার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩৯ এ আছে, “….. কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং…. নিশ্চয়তা দান করা হইল।”

আবার জাতিসংঘ মূলনীতিতে (ইউএন বেসিক প্রিন্সিপাল অন রোল অফ ল ইয়ার) পেশাগত জীবনে আইনজীবীর প্রাপ্য অধিকারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক নীতিগুলোর সারসংক্ষেপ রয়েছে। ১৯৯০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর কিউবার রাজধানী হাভানায় অনুষ্ঠিত ‘অপরাধ প্রতিরোধ ও অপরাধীর চিকিৎসাবিষয়ক জাতিসংঘ কংগ্রেস’-এর ৮ম অধিবেশনে এই মূলনীতি সর্বোসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

আবার অনুচ্ছেদ ৩১ এ আছে,  “আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।”

আর অনুচ্ছেদ ৭ এ আছে, “জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে৷”

তাই আদালতে আইনজীবীদের অধিকার যেমন আছে তেমনি দায় দায়িত্ব আছে। Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Order, 1972 যেমন এর ১৯ (১)  ধারা তে আছে-

(1) Save as otherwise provided in this Order, no person shall be entitled to practise the profession of law unless he is an advocate.

(2) Subject to the provisions of this Order, the rules made there under and any other law for the time being in force, an advocate shall be entitled as of right to practise throughout Bangladesh, and to appear, act and plead before any court, tribunal or revenue authority in Bangladesh.

“any other law for the time being in force” দিয়ে বুঝা যায় আইন আইনজীবী  আইন সঙ্গত বিধি নিষেধ সাপেক্ষে আদালত এ প্র্যাক্টিস  পারবেন। আবার সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে আছে, সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিকদায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য৷

গত ২৭. ১২. ২০১৯ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেন- “এ পেশায় শুধু আইনের ওপরই দখল থাকলে চলবে না। পেশাগত আচরণ সুন্দর হতে হবে। সর্বোপরি অবশ্যই তাকে সৎ হতে হবে, এবং উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে হবে। কোনো বিচার নিষ্পত্তির সঙ্গে এর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আর এ কারণে ব্যক্তিগত স্বার্থের চাইতে আদালতের প্রতি কর্তব্য ও মক্কেলের প্রতি সেবার বিষয়টি সবার আগে বিবেচনা করতে হবে।”

আবার দি বাংলাদেশ লিগেল প্র্যাকটিশনারস এন্ড বার কাউন্সিল অর্ডার এন্ড রুলস, ১৯৭২ এবং ক্যাননস অব প্রফেশনাল কনডাক্ট এন্ড এটিকেট’ নামের বইটিতে প্রকাশিত এডভোকেটদের জন্য অবশ্যই অনুসরণীয় আচরণবিধির অধ্যায়-১ এ আইনজীবীদের প্রতি আচরণ ১-১১ দফা, অধ্যায়-২ এ  মক্কেলের প্রতি আচরণ ১-১৪ দফা, অধ্যায়-৩  এ আদালতের প্রতি কর্তব্য ১-৯ দফা ও অধ্যায়-৪ এ জনগণের প্রতি আচরণ ১-৮ দফা বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।

তাই আইনজীবী আইনগতভাবে তত টুকু দায়ী থাকবেন যতটুকু আইন তাকে করেছেন। এর বাইরে কোনো আদালত তাকে বেশী দায়ী করতে পারবেন না। আইনজীবীরা অধিকার ও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবেন এটাই সবাই আশা করেন।

লেখক- সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।