ড. মো. রাশেদ হোসাইন, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট

ভার্চুয়াল বিচার ব্যবস্থা ও আমার কিছু কথা

ড. মো. রাশেদ হোসাইন:

করোনা পরিস্থিতি কতদিন চলবে এটা কেউ হলফ করে বলতে পারবেন না। এমন অবস্থায় ভার্চুয়াল কোর্ট চালু করা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ মাননীয় আইনমন্ত্রী ইতোমধ্যে তাঁদের বক্তব্যে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের জনগণও এটি অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে বলা যায়।

ভার্চুয়াল বিচার ব্যবস্থার অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে যা আলোচনার দাবী রাখে। তবে প্রত্যেকটি ভালো বিষয়েরই কিছু নেতিবাচক দিক থাকবে সেটিই অস্বীকার করা যায় না। সেই নেতিবাচক দিকগুলো বাস্তবতা নিরিখে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা মোটেও অসম্ভব কিছু নয়। ময়মনসিংহ জেলার কথা যদি বলি, ময়মনসিংহ সদর থেকে হালুয়াঘাট থানার দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার, ধোবাউড়া ৫০-৬০ কি. মি., পাগলা, গফরগাঁও, ভালুকা প্রায় ৫০-৬০ কি.মি., ফুলবাড়ীয়া, ত্রিশাল থানা ৩০-৪০ কি.মি.। বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায়ও এরকম দূরত্বের থানা রয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ থাকায় এসব দূরবর্তী থানা এলাকার বিচার প্রার্থীদের সদরে এসে বিচার চাওয়াটা মরার উপর খারার ঘা ছাড়া আর কিছুই না। কেউ বলবেন এতোদিন তাহলে কিভাবে হয়েছে? এই প্রশ্ন যিনি করবেন তার কাছেই উত্তর রয়েছে মনে করি।

যাহোক, ভার্চুয়াল কোর্টে একজন বিচারপ্রার্থীকে বা তার পক্ষে বিজ্ঞ আইনজীবীকে আদালতে আসতে হচ্ছে না। আমি মনে করি একটা জেলার প্রায় সব এলাকাতেই আইনজীবী রয়েছে। একজন বিচারপ্রার্থীকে একটু কষ্ট করে বিজ্ঞ আইনজীবীর চেম্বারে বা বাসায় যেতে পারলেই শুধু একটা মেইলের মাধ্যমে একজন হাজতীর জামিন পাওয়া খুবই সম্ভব। তাহলে সময়, শ্রম, অর্থ, হয়রানি, মানসিক, শারীরিক ক্ষতি থেকে বিচারপ্রার্থী সহ বিজ্ঞ আইনজীবী রক্ষা পেলেন। তাহলে এই ব্যবস্থা সমস্যা কোথায়? কেনই বা এই ভালো ব্যবস্থার বিরোধিতা করা হচ্ছে? যারা ভার্চুয়াল কোর্ট ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন তারা এই লেখা পছন্দ নাও করতে পারেন। কিন্তু আমি বলতে চাই আপনারা বিষয়টি ভালোভাবে না জেনেই বিরোধিতা করছেন।

ভাবা যায়, একটা জড় বস্তু সৃষ্টির সেরা জীবের তুলনায় স্মার্ট বেশি!! বর্তমানে স্মার্ট ফোন প্রায় সবাই ব্যবহার করেন। আর ফেসবুক আইডি এখন অনেক সিনিয়র স্মার্ট আইনজীবীদেরও রয়েছে। শুধুমাত্র একটা স্মার্টফোন হলেই কিন্তু মোটামুটি যথেষ্ট। অনেকে বলবেন এক্ষেত্রে শুধু স্মার্ট ফোন দিয়ে হবে না; ল্যাপটপ/ডেস্কটপ কম্পিউটার, প্রিন্টার, স্ক্যানার মেশিন এসব অবশ্যই লাগবে। আমি বলবো এগুলো ছাড়াও আপনি সুন্দরভাবে ভার্চুয়াল কোর্টে জামিন আবেদন করতে পারবেন। সেটি কিভাবে? ধরুন আপনার নেট সংযোগসহ একটা স্মার্ট ফোন আছে। আপনি যেহেতু ফেসবুক চালান সেহেতু আপনার একটি ই-মেইল আইডিও আছে। যদি না থাকে একজন জুনিয়রকে দিয়ে একটি ই-মেইল আইডি খুলে নিবেন। তাহলেই কেল্লা ফতে। আপনি গুগল প্লে-স্টোর থেকে Microsoft teams বা Zoom cloud meetings অ্যাপস ডাউনলোড দিয়ে ইন্সটল করে নিন। সাথে camscanner বা top scanner প্লে-স্টোর থেকে নামিয়ে ইন্সটল করে নিন। আর কী লাগে!

আপনি জামিনের দরখাস্ত, এজাহার বা অন্যান্য কাগজপত্র স্ক্যান করে ভার্টুয়াল কোর্টের ই-মেইল এড্রেসে পাঠিয়ে দিন। আদালত শুনানির তারিখ ও সময় ফিরতি মেইল করে আপনাকে জানিয়ে দিবেন। আপনি বাসা বা চেম্বারে বসে Zoom cloud meetings বা Microsoft teams অ্যাপসে লগ ইন করে আদালত প্রদত্ত নির্দিষ্ট তারিখ ও সময়ে ভিডিও কলের মাধ্যমে শুনানি করবেন। জামিন মন্জুর হলে আপনার কাছে থাকা বেইলবন্ড ও রিলিজ আদেশের কপি একইভাবে স্ক্যান করে আদালতের সেই আগের মেইল এড্রেসে পাঠিয়ে দিন। আপনার কাজ শেষ।

আপনার মক্কেল জেল থেকে এমনিতে বের হয়ে যাবে। কারণ রিলিজ আদেশ আদালত থেকেই জেল সুপারের ই-মেইল এড্রেসে পাঠানো হবে। আর জেল সুপার রিলিজ অর্ডার পেয়ে হাজতিকে মুক্তি দিবেন। কত সুন্দর একটা পদ্ধতি। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি হাজতি গত দেড় মাস ধরে জেলহাজতে কষ্টে আছে। তাদের খাওয়াতে আপনার আমার কষ্টের টাকা খরচ হচ্ছে। আপনারা জানেন একজন আসামি জামিন পাওয়ার পর তার তদ্বীরকারক/ আত্মীয়কে কোথায় কোথায় খরচ করতে হয়! এই রিলিজ আদেশ জেলখানা পর্যন্ত পৌঁছাতে কোন্ কোন্ সুবিধাভোগী ফুলে ফেঁপে ওঠে আপনারা ভালো করেই জানেন। তাহলে এ পদ্ধতি চালু করে লাভ কার হলো? সবাই এক বাক্যে বলবেন অবশ্যই বিচারপ্রার্থীর। আর জেলা লেভেলে বিচার চাইতে কারা যান? গ্রামের গরীব অসহায় ব্যক্তিই বেশি। তাহলে কী দাড়াচ্ছে আমরা এমন পদ্ধতি চাই না।

আদালতের অসাধু স্টাফ, অসাধু পুলিশ, টাউট/দালাল, অসাধু মোহরার, জেল খানার অসাধু স্টাফ দের হয়রানি থেকে বিচারপ্রার্থী বেঁচে যাক, আমরা তা চাই না!! অনেকে বলবেন ওকালতনামা, বেইলবন্ড, কোর্ট ফি, রিলিজ আদেশ, রিকল, স্ট্যাম্প পেপার এবং বিভিন্ন কাগজপত্র নেওয়ার জন্য তো আদালতে যেতেই হবে, তাহলে ভার্চুয়াল ব্যবস্থা করে লাভ কি? তাদের জন্য সহজ সমাধান হলো একবার কষ্ট করে গিয়ে ২ মাসের জন্য যা যা প্রয়োজন তা নিয়ে এসে বাসায় বা চেম্বারে রাখুন। যখন যেটা প্রয়োজন পড়বে সেটি পূরণ করে স্ক্যান করে স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে ঘরে বসেই বিচারপ্রার্থীকে বিচার প্রাপ্তিতে সহযোগিতা করতে পারবেন। বর্তমানে ৪জি নেটের স্পিড অনেক ভালো। মোবাইলে আগেই ফুল চার্জ দিয়ে নিলেই শুনানির সময় বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। এতো সুন্দর একটা ব্যবস্থা অকার্যকর করার জন্য আন্দোলন করার কোনো মানে হয়!

সিনিয়র আইনজীবীরা স্মার্ট জুনিয়রদের ব্যবহার করতে পারেন। এক্ষেত্রে জুনিয়রদের একটু কদর বাড়লে সমস্যা কোথায়? আর এই ব্যবস্থাতো সাময়িক, শুধু হাজতি আসামিদের জামিন শুনানির জন্য। এমন না যে সমসময় এই ব্যবস্থা থাকবে। এই ব্যবস্থায় অভ্যস্থ হতে সর্বোচ্চ ১ সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। তারপর দেখবেন এটি কত সহজ একটা ব্যবস্থা। একটু ঝামেলা মনে হচ্ছে বা পারবো না, আমাকে দিয়ে হবে না, ভয় করছেন; আসলে এগুলো কিছুই না, ঝেড়ে বিদায় করতে হবে। তবে হ্যাঁ ছোটখাটো যেসব সমস্যা রয়েছে তা অবশ্যই সমাধানযোগ্য।

একটা ব্যবস্থা চালু হতে না হতেই এতো বিরোধিতা কেন? যারা আদালতে ইমেজ ব্যবহার করে জামিনে সুবিধা নিতে পটু বা ইতিপূর্বে এমন সুবিধা মনে করেন পেয়ে এসেছেন তাদের জন্য বলবো এটি মোটেও ভালো ব্যবস্থা নয়। আবার এই ব্যবস্থা এতো ঝামেলা মনে করে যারা গর্জন বর্জন করে দূরে থাকলেন, এদিকে সরকার/সুপ্রিম কোর্ট বলে দিলেন করোনা পরিস্থিতির কারণে হাজতবাস বিবেচনায় প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আসামিদের এমনিতেই জামিনে মুক্তি দেওয়া হোক। যদিও ইতোমধ্যে সরকার নির্বাহী আদেশে কিছু কয়েদিকে মুক্তি দিয়েছেন। তখন মনে হবে নাই মামার চেয়ে কানা মামায় ভালো ছিল।

সবশেষে ভার্চুয়াল বিচার ব্যবস্থার সফলতা কামনা করি এবং এমন যুগান্তকারী ব্যবস্থা চালু করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় আইনমন্ত্রীসহ মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে ধন্যবাদ জানাই। এই লেখার গঠনমূলক সমালোচনাকে অবশ্যই স্বাগত জানাই।

লেখক- ড. মো. রাশেদ হোসাইন, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, ময়মনসিংহ।