ব্যারিস্টার আশরাফুল ইসলাম আশরাফ

পরধর্ম, সৎকর্ম ও আল কোরআনের মর্মবানী

ব্যারিস্টার এম. আশরাফুল ইসলাম:

গত কয়েকদিন আগে বিদ্যানন্দ ও তার প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার এবং দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা সর্ম্পকে লিখেছিলাম, যার অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছি। যারা আমার প্রশংসা করেছেন তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা, আর যারা ধর্মান্ধ শব্দটি ব্যবহার করায় আঘাত পেয়েছেন (যদিও সংখ্যায় খুব কম) তারপরও তাদের প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসা। তাদের কারণেই আজকের এই লেখাটি লিখতে পেরেছি ।

এই লেখাটি আপনাদের সামনে উপস্থাপন করার জন্য আমি আন্তরিকভাবে অনেক পরিশ্রম করেছি। আমার এই লেখাটি শেষ অব্দি না পড়ে কেউ দয়া করে লাইক/কমেন্ট/শেয়ার করবেন না।

“ধর্মান্ধ” শব্দটির আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় নিজ ধর্মে অন্ধ বিশ্বাস এবং পরধর্মকে ঘৃনা করা, আমি মনে করি যা ধার্মিকতার সম্পন্ন বিপরীত, ধার্মিকতা যেখানে আমাদের শিক্ষা দেয় সহনশীলতা, ধর্মীয় বিধি নিষেধ সুচারু ভাবে পালন করা এবং মানুষে মানুষে বিচ্ছেদ সৃষ্টি না করে দুনিয়ায় শান্তিতে বসবাস করা। অন্যথায় ধর্মান্ধতা জন্ম দেয় দাম্ভিকতা, অহংকার, সমাজে ধর্মের নামে বিশৃঙ্খলাতা সৃষ্ঠি করা, নিরীহ মানুষকে হত্যা করা এবং সর্বপোরী মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতিকে বাধাগ্রস্ত করা।

আমরা যারা ইসলাম ধর্মানুসারী আমাদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র হচ্ছে কোরআন শরিফ। এর বাহিরে যাবার আমাদের কোন সাধ্য নাই, তাই পবিত্র কোরআন শরিফের মর্মবানীর উদ্বৃতিসমূহ উল্লেখ করেই ধর্মান্বতার বিপক্ষে এই লিখাটি আপনাদের জন্য লিখেছি।

পবিত্র কোরআনের সুরা- ‘আনআম’ আয়াত-১৪০ এ অজ্ঞতার ব্যাপারে বলা হয়েছে- “অজ্ঞ, অবিদ্যা-আক্রান্ত ও দূর্বলমনা হওয়ার কারণে যারা তাদের সন্তান কে হত্যা করে এবং আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা নিজের জন্য হারাম করে, প্রতিপালকের নামে মিথ্যারোপ করে, তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্থ। তারা বিপথগামী, সৎপথ থেকে বঞ্চিত।” প্রায় একই রুপ বলা হয়েছে সুরা বনি ইসরাইল, আয়ত-৮৯ “—- কিন্তু হায়! অধিকাংশ মানুষই (অবিদ্যা সংস্কারে বৃত্তে আটকে থেকে) সত্য অস্বীকার করতে চায়।”

সুরা বাকারা, আয়াত-২০৪ এর মর্মবাণী-“(মনে রেখো) এমন মানুষ আছে, পার্থিব জীবন সম্পর্কে যার আলাপচারিতা তোমাকে মোহিত করবে আর তার অন্তরের সততা প্রমাণের জন্য বারবার সে আল্লাহকে সাক্ষী মানবে। আসলে সে বিতর্কে পটু (প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করতে, বিভ্রান্তকর যুক্তি প্রয়োগে সিদ্ধহস্ত)।”

সুরা বাকারা, আয়াত -২০৫ – “কিন্তু যখনই সে ক্ষমতা ও সুযোগ পায় তখনই জমিনে অশান্তি ও ত্রাস সৃষ্টি করে শস্য ও প্রাণিকুল ধ্বংস করে। আসলে আল্লাহ অশান্তি ও ত্রাস সৃষ্টিকারীদের অপছন্দ করেন।” বস্তুত পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন জায়গায় বলা আছে ধর্মের ব্যাপারে জবরদস্তি না করার জন্য; যেমন সুরা-বাকার, আয়াত -২৬৫, সুরা নিসা আয়াত – ১৭১।

সুরা বাকারা আয়াত -৬২ ও সরা মায়েদা আয়াত- ৬৯ এ আরও বলা আছে ” নিশ্চয়ই মুসলমান, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও সাবেয়ীদের মধ্যে যারাই আল্লাহ ও মহাবিচার দিবসে বিশ্বাস করে এবং সৎকর্ম কর, তাদের সবার জন্যই প্রতিপালকের কাছে পুরস্কার রয়েছ। তাদের কোন ভয় নেই ও তারা দুঃখিতও হবে না।”

সুরা বাকারা, আয়াত- ২৭২ এ বলা হয়েছে- “(হে নবী!) মানুষকে সত্যপথ গ্রহন করানোর দায়িত্ব তোমাকে দেয়া হয় নি। যে ইচ্ছে করে, আল্লাহ তাকে সৎপথে পরিচালিত করেন।—”

সুরা মায়দা, আয়াত-৪৮ এ বলা আছে, “—আল্লাহ ইচ্ছা করলে তোমাদের এক উম্মাহ বা জাতিতে পরিণত করতে পারতেন। (কিন্তু তিনি তা করেন নি) কারন তিনি তোমাদের যে পথনির্দেশ ও বিধান দিয়েছেন, তার আলোকেই তোমাদের পরীক্ষা করতে চান। অতএব তোমরা সৎকর্মে (নিজের সাথে) প্রাণপণ প্রতিযোগিতা করো। শেষ পর্যন্ত তোমরা আল্লাহর দিকেই ফিরে যাবে। তখন তোমাদের মতভেদের বিষয়সমূহের ব্যাপারে আল্লাহ আসল সত্য প্রকাশ করবেন।” এছাড়া এরুপ কথা সুরা আন-নহল, আয়াত-৯৩, সুরা ইউনুস, আয়াত-৯৯-১০০ ও বলেছেন।

সুরা-বাকারা,আয়াত-১৪৮ এ বলেছেন, “প্রত্যকেরই একটি লক্ষ্য আছে; যা তার কর্মধারাকে পরিচালনা করে। অতএব তোমারা সৎকর্মে (নিজের সাথ) প্রতিযোগিতা করো। তোমরা যেখানই থাকো না কেন, আল্লাহ তোমাদের সকলকে সমাবেত করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।”

তাহলে কি দাঁড়াল নিজ ধর্মে যারা বিশ্বাসী তারা কি অন্য ধর্ম, ভালো কর্মকে ঘৃণা করতে পারে? যদি কেউ করে তারা কি ধর্মের মর্মবানী জানে? নেহাত তারা এগুলো ব্যক্তি স্বার্থ ও দাম্ভিকতার জন্য করে। যে ব্যপারে আল্লাহ সুরা আলে ইমরান, আয়াত- ৯৪ বলেছেন ” এরপরও যারা নিজেদের মনগড়া কথা আল্লাহর কথা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করবে, তারাই দুরাচারী।”

কোরআন হচ্ছে মানবতার শান্তির জন্য পৃথিবীতে এ যাবৎকালের সবচেয়ে মূল্যবান এবং সবচেয়ে পবিত্র গ্রন্থ। যে কথাটা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে, তা হলো রমজান মাসে এক বিধর্মীর কাছ থেকে কেন ১ টাকায় খাবার গ্রহণ করবো, এতে আমাদের ধর্মীয় পবিত্রতা নষ্ট হবে। তাদের প্রসংগে পবিত্র কোরআনের মর্মবানীর উদ্ধৃতি টানার আগে নিম্নোক্ত বাস্তবিক চিত্র তুলে ধরতে চাই-

১. যারা ১ টাকায় খাবার গ্রহণ করে তারা সত্যিই অসহায় এবং অভাবী। তাদের কাছে বেঁচে থাকা থাকাটাই বড় প্রশ্ন;

২. একজন ডাক্তার যখন রোগীর পালস চেক করেন, তখন সে কি সে ভাবার সুযোগ পান সে কোন ধর্মের অনুসারী;

৩. যখন কেউ অতি প্রয়োজনে রক্ত গ্রহন করেন তখন কি তার সুযোগ থাকে ধর্মের পরিচয় জানার?

৪. কিশোর কুমারের জন্য যাদের বিদ্যানন্দ নাম ও কামের প্রতি অশ্রদ্ধা তারা যখন ঔষধ সেবন করেন (বিশেষ করে বিদেশি ঔষধ, যা দেশে তৈরি হয় না), তারা একবারও কি ভেবে দেখেছেন এগুলো কোন ধর্মের লোক তৈরী করেছেন?

৫. বিদেশি সাহায্য সংস্থা যেমন সেফ দ্যা চিলড্রেন, কেয়ার, ইউ এস এইডস, ইত্যাদি সবই তো অন্য ধর্মের মানুষের দেওয়া সাহায্য!

আরও সহজ ভাবে যদি বলি, কুমুদিনী সহ আরও অন্যান্য হাসপাতাল যা অমুসলিমরা পরিচালনা করেন, সেসব হাসপাতালে ভর্তিকৃত লোকেরা কি কখনই হাসপাতালের পথ্য, খাবার, ঔষধ, চিকিৎসা নিয়ে প্রশ্ন করেন? শুধু টাংগাইলের কুমুদিনী হাসপাতাল শত শত অহসহায় মায়ের সন্তান জন্মদানের ব্যবস্তা করছেন এবং করে যাচ্ছেন, এখন সেই সকল মা ও তাদের সন্তানেরা কি দানবীর রনদা প্রসাদ সাহাকে শুধু হিন্দু হওয়ার কারনে ঘৃনা করবেন এবং ঘৃনা করতে শিখাবেন?

এই কারণেই হয়তো পবিত্র কোরআনে হারাম-হালাল সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা দেওয়া আছে। যেমন সুরা বাকারা, আয়াত-১৭৩ এ বলা হয়েছে- “আল্লাহ তো তোমাদের জন্য শুধু মৃত পশু, রক্ত, শূকরের মাংস হারাম করেছেন। অবশ্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নাম নিয়ে জবাই করা হয়েছে এমন সব প্রাণীর মাংস তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে। কিন্তু একান্ত নিরুপায় অবস্থায় বিধান লংঘন করার কোনোরকম অভিপ্রায় ছাড়া শুধুমাত্র ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য তা খেলে কোন দোষ নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল ও পরমদয়ালু।” সুরা মায়েদা, আয়াত-৩ আরো বলা হয়েছে- আল্লাহ মূর্তিপূজার বেদীতে বলি দেয়া পশুর মাংস হারাম করেছেন। কিন্তু ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হয়ে কোন হারাম বস্তু থেকে কিছু খেয়ে ফেলে, তখন আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরমদয়ালু।

বিদ্যানন্দ বাঙালির সুন্দর, অর্থবহ নাম। যেখানে কতিপয় হিন্দু ও মুসলমান মিলে সৎকর্ম করার প্রতিযোগীতায় অবতীর্ণ হয়ে মানবতার পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু আমরা কিছু সংখ্যক মুসলমান যাদের মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞান খুবই কম, তারা মানুষের মধ্যে বিভ্রান্ত সৃষ্টির চেষ্টা করছি, যা আল্লাহর পবিত্র বাণী অস্বীকার করার সামিল। সুরা মায়েদার আয়াত-৪ এ আল্লাহ স্পষ্টতই বলেছেন, ” মানুষ জিজ্ঞেস করবে, তাদের জন্য কী কী হালাল করা হয়েছে? হে নবী! বলো, জীবনের জন্য ভালো ও কল্যাণকর সবকিছুই তোমাদের জন্য হালাল—-।”

সুরা আন-নহল, আয়াত- ১১৬-১১৭, “আর তোমরা কখনো নিজেদের মিথ্যা ধারণাকে আল্লাহর নামে চালিয়ে দিয়ে বোলো না যে, ‘এটা হালাল আর ওটা হারাম।’ মনে রেখো, যারা আল্লাহর নাম দিয়ে মিথ্যা কথা চালাতে চেষ্টা করে তারা কখনো সফলকাম হবে না। (দুনিয়ায়) তারা সাময়িক আনন্দ পেতে পারে কিন্তু (আখেরাতে) তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।”

সুরা নিসার ৯৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে , “—-তোমাদেরকে সালাম করলে (অর্থ্যাৎ শান্তির হাত বাড়িয়ে দিলে) পার্থিব ধনসম্পত্তির লোভে সহসাই তাকে বলে ফেলো না, ‘তুমি তো মুসলমান নও’।—-”

যাই হোক, পরিশেষে পবিত্র কোরআনের আয়াতগুলো আপনাদের সামনে উপস্থাপনের মাধ্যমে এই বলতে চাই, আল্লাহর অগোচরে গাছের একটি পাতাও পড়ে না। (সুরা আনআম, আয়াত- ৫৯ আয়াত)। অতএব আমরা মানুষ যে ধর্মেই বিশ্বাস করি না কেন, মহাবিচার দিবসে আল্লাহ বিশ্বাসী, ইহুদি, খ্রিষ্ঠান, সাবেয়ী, অগ্নি-উপাসক ও শরিককারীদের ধ্যানধারনার ব্যাপারে চুড়ান্ত ফায়সালা করবেন (সুরা হজ, আয়াত-১৭)। তাই, যদি মানবতার কল্যাণে কেউ কিছু করে, তা হয়ত সৃষ্টিকর্তার নির্দেশেই করে থাকে, আমাদের সে বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা আর আল্লাহর বানীকে অস্বীকার করা সমান। সর্বশেষ এই বলতে চাই, সুরা রাদ, আয়াত- ১১ তে বলেছেন নিজের ভেতর থেকে না বদলালে ( অর্থাৎ দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে) আল্লাহ কোন জাতির (বা মানুষের) অবস্থা বদলান না।

মহান আল্লাহ আমাকে বাংলা মায়ের গর্ভে জন্ম দিয়ে একজন বাঙালি করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন, যদি বসবাস করার কারনে, পৃথিবীর অন্য দেশের নাগরিকতা গ্রহন করি, তখনও কিন্তু জাতি হিসাবে বাঙালিই থাকবো, নিজের নাম পরিবর্তন করা যায়, কিন্ত বাবার নাম পরিবর্তন করা যায় না, তাই দেশ পরিবর্তন হতে পারে বাঙালি করে যে আল্লাহ আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তা পরিবর্তন সম্ভব নয়, এর চেয়ে বড় সত্য আর কি আছ? তাই আমার পবিত্র দায়িত্ব হলো, ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনেই নিজ জন্মভূমি বাংলাদেশেের জন্য এবং বাঙালি জাতির জন্য জনকল্যাণকর কিছু করে যাওয়া।

আমরা যদি আমাদের সন্তানদের ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে পৃথিবীর অন্যদেশে জ্ঞান আহরণ করতে পাঠাই, আর তারা যদি মানুষে মানুষে পার্থক্য করে, যাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিবে তাদেরকে ছোট ভাবে, নিজেদের বড় ভাবে তাহলে কিভাবে শিক্ষা গ্রহন করবে? আমাদের অনেক দূর যেতে হবে তাই মানুষে মানুষে পার্থক্য করলে, আমরা সারাজীবন অন্যের মুখাপেক্ষী জাতি হিসাবে থাকতে হব, কখনই সবাই মিলে সুখী, সুন্দর জীবনযাপন করতে পারব না। আমাদের আছে পবিত্র কোরআন, আসুন আমরা শুধু মোল্লা, মুসল্লী ও হুজুরদের দোষারোপ না করে নিজেরাও ধর্মীয় জ্ঞান আহরণে সচেষ্ট হই। তাহলে আমাদের মধ্য থেকে অজ্ঞতা চিরদিনের জন্য দূর হবে। আমরা হতে পারবো সুখী ও সমৃদ্ধ জাতি।

লেখক- আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।

আরও পড়ুন- রণদা প্রসাদ সাহা, বিদ্যানন্দ’র কিশোর কুমার ও দেশপ্রেম: বিক্ষপ্ত ভাবনা