অ্যাডভোকেট মোকাররামুছ সাকলান

আদালতের ছুটিতে হাইকোর্টের ভার্চুয়াল বেঞ্চে দেওয়ানী মামলা করার পথ ও এখতিয়ার

মোকাররামুছ সাকলান:

বেশ কয়েকদিন ধরে দেশে ভার্চুয়াল কোর্টে মামলার শুনানী হচ্ছে। জেলা আদালত গুলোতে শুধু মাত্র হাজতি আসামীর জামিনের দরখাস্ত শুনানী হচ্ছে। অন্যদিকে হাইকোর্ট বিভাগে দেওয়ানি, ফৌজদারী, রিট এবং কোম্পানী ও প্রবেট সংক্রান্ত মামলার অতি জরুরী বিষয় শুনানীর জন্য হাইকোর্টে কয়েকটি বেঞ্চ গঠন করা হয়েছে। আজেকের আলোচনায় মুলত ভার্চুয়াল কোর্টে দেওয়ানী মামলা কিভাবে করা যাবে এবং এক্ষেত্রে হাইকোর্টের এখতিয়ার সমূহ কিভাবে ব্যবহার করা যাবে তার বিবরন থাকবে ।

এখন পর্যন্ত সুপ্রীম কোর্ট থেকে ভার্চুয়াল আদালতে মামলা করার জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালত, চীফ জুডিশিয়াল আদালতের সমুহের জন্য শুধু হাজতি মামলার আসামীর জামিনের দরখাস্ত গ্রহন করার বিধান করা হয়। যারা সাধারনত ফৌজদারী মামলা করেন তাদের মক্কেলদের জন্য বিষয়টি করোনা পরিস্থিতিতে একটু স্বস্তিদায়ক হলেও যেসব আইনজীবী দেওয়ানী মামলা করেন তাদের মক্কেলেদের জন্য খবরটা কিছুটা ভোগান্তিকর মনে হতে পারে। বিগত প্রায় দুই মাস ধরেই দেওয়ানী আদালতের কোন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে না। ফলে বিচারের জন্য এবং অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার জন্য কোন আবেদন শুনানী করা যাচ্ছে না। এতে করে একশ্রেনীর স্বার্থান্বেষী মহল সাধারন মানুষের মূল্যবান জমি-জমা সম্পত্তি কেড়ে নেয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে এবং পেশী শক্তিতে বলিয়ান পক্ষ আদালতের কার্যক্রম না থাকার সুযোগে কোন কোন ক্ষেত্রে অন্য পক্ষকে তাদের জমি জমা থেকে উচ্ছেদ করে দিচ্ছে।

অনেকেই বলছেন এমন পরিস্থিতে শুধু জামিনের আসামীদের যেমন অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে একই সাথে দেওয়ানী মামলায় ভুক্তভোগীদের যন্ত্রনাও বাড়ছে। দেওয়ানী মামলায় ভুক্তভোগীদের জন্য আজকের আলোচনায় দুটি ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম ভাগে হচ্ছে যারা ইতিমধ্যে দেওয়ানী মামলা দায়ের করেছেন আর দ্বিতীয় ভাগে থাকবে যারা এখনো আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকার কারনে কোন মামলা দায়েরই করতে পারে নাই।

প্রথম ভাগের যারা ইতিমধ্যে দেওয়ানী মামলা দায়ের করেছেন তাদের কে বিশ্লেষন করলে দেখা যায় তাদের মধ্যে অনেকেই নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত আদালতে জমা দিয়ে শুনানী করেছেন এবং আবেদন নামঞ্জুর হবার কারনে জেলা জজ আদালতে বা হাইকোর্টে আপীল করতে পারেন নাই। আবার এখানে আরেকটি পক্ষ আছে যারা নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত আদালতে জমা দিয়েছেন কিংবা আপীল দায়ের করেছেন কিন্তু আদালতের কার্যক্রম না চলার কারনে সেই দরখাস্ত কিংবা আপীল শুনানী করতে পারেন নাই।

উপরে যাদের নিষেধাজ্ঞার আবেদন না মঞ্জুর হয়েছে তারা চাইলে আপীল করার পরিবর্তে হাইকোর্টের ভার্চুয়াল বেঞ্চ যেখানে দেওয়ানী মামলার মোশন শুনানী করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেখানে দেওয়ানী কার্যবিধি আইনের ধারা ১১৫ তে সিভিল রিভিশন দায়ের করতে পারেন। প্রশ্ন আসতে পারে যেখানে আপীলের সুনির্দিষ্ট বিধান আছে সেখানে রিভিশন চলবে কিনা। উত্তর হ্যাঁ; বর্তমান পরিস্থিতে এটা চলবে। এ বিষয়ে 42 DLR (HD) 220 এর সিদ্ধান্ত প্রনিধান যোগ্য। হাইকোর্টের সিদ্ধান্তে বলা হচ্ছে  “So during this vacation there was no forum for the petitioners to file an appeal against the impugned order before the District Judge. On consideration of the facts and circumstances of the case and the decisions noted above, I am of the opinion that a revision under section 115 of the Code of Civil Procedure filed by the petitioners before this Court is not barred merely because the impugned order is appealable to the Court of District Judge.”

এছাড়া 4 MLR (HD) 346 হাইকোর্ট বলেছেন  “Before parting I am inclined to record an observation that the forum of appeal, i.e. the Court of District Judge if remains closed during Civil Court Vacation, the aggrieved party can invoke High Court Division Revisional Jurisdiction under section 115 of the Code even though the order under challenge becomes an appealable order as because the party aggrieved will have no other remedy and the peculiar facts and circumstances are to be kept in view.”

অর্থাৎ এই দুটো মামলার সিদ্ধান্তের আলোকে বলা যায় যে যখন নিম্ন আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে তখন জরুরী পরিস্থিতে আপীলের বিধান থাকা স্বত্বেও হাইকোর্টে আপীলের পরিবর্তে সিভিল রিভিশন দায়ের করা যাবে। জেলা জজ আদালতের কার্যক্রম বন্ধের এই সময়টা কে জেলা জজ আদালতের অবকাশ হিসাবে ধরে নিতে হবে সে ক্ষেত্রে।

এবার দেখা যাক যে পক্ষ নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত আদালতে জমা দিয়েছেন কিংবা নিষেধাজ্ঞার আদেশে (পক্ষে বিপক্ষে যাই হোক না কেন) তার বিরুদ্ধে আপীল দায়ের করেছেন কিন্তু আদালতের কার্যক্রম না চলার কারনে সেই নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত কিংবা আপীল বিবেচনাধীন অবস্থায় নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত শুনানী করতে পারেন নাই কিন্তু তাদের জরুরী নিষেধাজ্ঞার আদেশ দরকার তাদের কি হবে? এক্ষেত্রে সরাসরি উচ্চ আদালতের কোন সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় না যে জেলা জজ আদালতে নিষেধজ্ঞার আপীল বা এর নিম্নের আদালত সমুহে নিষেধজ্ঞার দরখাস্ত চলমান থাকাকালে হাইকোর্ট কোন নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত শুনতে পারবে কিনা?

হাইকোর্ট বিধিমালায় এর জন্য একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। হাইকোর্টে যে বেঞ্চে দেওয়ানী মামলার ক্ষমতা দেওয়া আছে সেখানে বলা আছে “অতীব জরুরী সকল প্রকার রীট ও দেওয়ানী মোশন এবং তৎসংক্রান্ত আবেদনপত্র।“ অর্থাৎ হাইকোর্ট দেওয়ানী মোশন মামলা শুনতে পারবে। হাইকোর্ট বিধিমালায় মোশন এর ব্যাখ্যায় অধ্যায় IVA বিধি ১ এ বলা আছে “In this Chapter, the term motion means presenting/moving before a Bench an application/petition which does not fall in the category of an appeal and which, before its registration as a case, requires a judicial order for the purpose of its acceptance and registration thereof” ।

অর্থাৎ আপীল ছাড়া যেকোন দরখাস্ত বা পিটিশন কেই এখানে মোশন হিসাবে অ্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হল দরখাস্তকারী আইনের ঠিক কোন ধারা বলে এই দরখাস্ত দায়ের করবে? এক্ষেত্রে সরাসরি কোন মামলার সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় না। তবে 25 DLR(HD) 335 এর সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৯ হল Judicial এবং administrative প্রকৃতির। দেওয়ানী কার্যবিধি আইনের ১১৫ ধারা ২০০৩ সালে সংশোধন করা হলেও সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৯ অনুবলে ১১৫ ধারায় আদালতের Suo Moto ক্ষমতা থেকেই যায়। এখানে উল্লেখ্য যে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৯ আমাদের সংবিধানের একটি Basic Feature। যার ফলে বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় (করোনা ভাইরাস জনিত দেওয়ানী আদালতের কার্যক্রমের অচলবস্থা) যেকোন জেলা জজ বা তার নিন্ম আদালতে যেসব নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত শুনানী করা যায় নাই তা হাইকোর্টের Suo Moto ক্ষমতায় শুনানী করার আবেদন করা যেতে পারে। এধরনের আবেদন হাইকোর্টের ভার্চুয়াল শুনানীতে Judicial Order এ মোশন হিসাবে রেজিস্ট্রিভুক্ত হতে পারে। তবে আপীল যদি হাইকোর্টে ফাইল করা হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞার দরখাস্তে আদেশ দেবার সুযোগ রয়েছে।

এছাড়া আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যেকোন দেওয়ানী আদালতের দেওয়ানী কার্যবিধি ১৫১ ধারা অনুযায়ী আদালতের কার্যধারার অপব্যবহার রোধ কল্পে (to prevent abuse of process) হাইকোর্টের ভার্চুয়াল শুনানীর দেওয়ানী বেঞ্চ বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনা করে তার সহজাত ক্ষমতায় নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত শুনানীর করতে পারে। যেহেতু শুনানীর অপেক্ষায় থাকা নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত সমূহ কিভাবে শুনানী হতে পারে তার কোন সুস্পষ্ট বিধান দেওয়ানী কার্যবিধিতে নাই। এপ্রসঙ্গে U Anug V. Government, AIR 1940 Rang 162 এবং Sharbati v. Kali. AIR 1942 Lah 119 এর সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে “ ‘Ends of justice’ and ‘abuse of process of the court’ have to be interpreted with due regard to the other Provisions of the Code and that the section is intended to prevent the court from being rendered impotent by any omission in the Code’. “No act done or proceeding taken as of right in due course of law is an abuse of the process of the court, simply because such proceeding is likely to embarrass the other party. “

অতএব, উপরোক্ত আলোচনা থেকে উপসংহারে বলা যায় হাইকোর্টের দেওয়ানী মোশন মামলা শুনানী সংক্রান্ত ভার্চুয়াল বেঞ্চে আদালতের কার্যধারার অপব্যবহার রোধ কল্পে এবং ন্যায় বিচারের স্বার্থে নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত শুনতে পারে।

এবার দ্বিতীয় ভাগে সেইসব বিষয়ে দেখি যারা এখনো আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকার কারনে কোন নিষেধাজ্ঞার মামলা দায়েরই করতে পারে নাই। কিংবা স্বত্ব ঘোষনার মামলাও করতে পারেন নাই এবং তৎসংক্রান্তে কোন নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত জমাও দিতে পারেন নাই কিন্তু পেশী শক্তির চাপে নিজের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হতে চলেছেন। এই অবস্থায় হাইকোর্টের ভার্চুয়াল বেঞ্চে সরাসরি মামলা করে কোন নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেবার কোন সুযোগ নাই। উদাহরন হিসাবে 2 MLR (AD) 149 উল্লিখিত সিদ্ধান্তটি অনুসরনযোগ্য। এই মামলাটিতে দেখা যায় ১৯৯৪ সালে দেওয়ানী আদালতের অবকাশের সময় দেওয়ানী আদালত না থাকার কারনে একটি নিষেধাজ্ঞার মামলা দায়ের হয়েছিল সরাসরি হাইকোর্টে। সেখানে হাইকোর্ট দেওয়ানী কার্যবিধি ১৫১ ব্যবহার করে প্রথমে নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু পরবর্তিতে আপীল বিভাগ তা খারিজ করে দেন এই মর্মে যে সাধারন দেওয়ানী মামলা দায়ের এর জন্য হাইকোর্টের কোন এখতিয়ার নেই। আপীল বিভাগ বলেন যে  “The impugned order was passed in the same manner as a Vacation Bench of the High Court Division which passes such orders for during the vacation; but such orders are passed only in matters over which the High Court Division has jurisdiction. The same could not be done in an application under section 151 CPC where no suit had yet been filed.”

অর্থাৎ যে মামলা এখনও নিম্ন আদালতে দায়ের করা হয় নাই তা সংক্রান্ত কোন নিষেধাজ্ঞার আদেশ হাইকোর্ট আদালত দিতে পারে না।

তবে এক্ষেত্রে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২(১) এর যথাযথ ব্যবহার হতে পারে। যেহেতু সম্পত্তির অধিকার আমাদের মৌলিক অধিকার তাই মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য যেকোন ব্যক্তি সরাসরি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২(১) এর আশ্রয় গ্রহন করে যথাযথ আদেশ গ্রহন করতে পারে। তবে এই অনুচ্ছেদের ব্যবহার করোনা ভাইরাসের বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনা করেই হতে হবে বলে মনে করি।

উপরোক্ত আইনি আলোচনা একজন আইনজীবী হিসাবে লেখকের আইনি মত মাত্র। আইনের ব্যাখ্যায় আদালতের রায় চুড়ান্ত।    

লেখক- অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।