বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান (অবঃ)

কোভিড-১৯ এর দাবী : পরিছন্নতা সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন

বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান:

করোনা ভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন এখোনো আবিষ্কার হয়নি। এটা প্রমানিত হয়েছে যে এ মুহূর্তে করোনা প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক হলো ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সংরক্ষনের মাধ্যমে জীবানুমুক্ত থাকা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা ও আশেপাশের পরিবেশ দুষনমুক্ত রাখা সংক্রামক ব্যাধি করোনাসহ সব ধরনের জীবানুবাহী রোগ-ব্যাধি থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারে।

ধর্ম বিশ্বাসে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে পরিছন্নতা সংরক্ষনের গুরুত্ব অপরিসীম। অপরিছন্ন পারিপার্শ্বিকতা সকল প্রকার রোগ বালাইয়ের আকর। এ কারনে ইসলাম পরিচ্ছন্নতা কে ইমানের অঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করে থাকে।

জাতি হিসাবে আমরা পরিছন্নতাকে মোটেই গুরুত্ব দেইনা। এর প্রমাণ ঢাকা শহরে ভুরি ভুরি বিদ্যমান। উন্নত বিশ্বকে আলোচনার বাইরে রেখে শুধু যদি আমরা দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলির পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিকে নমুনা হিসাবে উপস্থাপন করি, তবে আমরা পদে পদে লজ্জা পাব। আমরা সামাজিক জীবনে পরিচ্ছন্ন থাকা ও পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখাকে যে মোটেই আমলে নেইনা তার দৃস্টান্ত হচ্ছে;

১. ঢাকা শহরের দুটি বহুতল দালানের মধ্যবর্তী স্থানটি আমরা ‘ভাগার’ হিসাবে বিবেচনা করি এবং বহুতল দালানের সব তলা থেকেই এই মধ্যবর্তী স্থানে প্রতিদিন ময়লা ও রান্না-ঘরের বর্জ্য ফেলি।

২. রাস্তা ও পাড়া মহল্লার আনাচে কানাচে ঢাউস আকৃতির বর্জ্য কন্টেনার গুলোর উপচে পড়া নোংরা বর্জ্যে রাস্তা সয়লাব করে রাখি।

৩. রাস্তায়, কি পায়ে হেঁটে কি গাড়ীতে, চলতে চলতে হাতের আবর্জনা ও বর্জ্যটি অবলীলায় রাস্তায় ফেলে দিই-যেন রাস্তাটি এক বিরাট ডাস্টবিন।

৪. ডাব, পানি ও ড্রিংসের প্লাস্টিক বোতল, কাগজের কার্টন এবং হেন জিনিষ নেই যা আমরা রাস্তার পাশের ড্রেন, সুয়্যারেজ ম্যানহোলে ফেলি না।

৫ সকল কারখানার বর্জ্য, নোংরা পানি, নদীর পাশে বসবাসকারী বাড়ীর সূয়্যারেজের মলমূত্রাদি আমরা নদীতে ফেলার স্থায়ী ব্যবস্থা করি।

৬. দেশব্যাপী সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা গুলোতে পরিছন্নতা ডিপার্টমেন্ট সমূহ যেনতেনভাবে শহরের বর্জ্য নিস্কাষন কার্যটি করে থাকে।

৭. গ্রামীন সমাজ জীবনে, কি উপজেলা পরিষদ, কি ইউনিয়ন পরিষদ গ্রামের বর্জ্য নিষ্কাশন কাকে বলে সেটা মোটেই জানেনা।

৮. শিশু কিশোরদের পরিচ্ছনতা শেখানোর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা সিলেবাসে এ বিষয়ে কিছুই অন্তর্ভুক্ত নেই।

আমাদের এই ব্যর্থতার ফলশ্রুতিতে আমরা দেখি করোনা বিস্তারের উর্ধমূখী পরিস্থিতিতেও সকল মিডিয়ায় ঘন ঘন পরিচ্ছন্ন থাকার ছবক প্রচার করেও আমরা কোভিড-১৯ কে প্রতিহত করতে পারিনি। এই ব্যর্থতায় এ পর্যন্ত কয়েকশত অমূল্য প্রাণ ঝরে গেছে এ মরন ব্যাধিতে এবং আরও কতো যে যাবে তার ইয়ত্তা নেই। আমরা ইতোমধ্যে হারিয়েছি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে, এস আলম গ্রুপের সর্ব জ্যৈষ্ঠ সদস্যকে এবং এরূপ আরো কতো মূল্যবান ব্যক্তিত্বকে।

অতএব কোভিড-১৯ আমাদের কিছু শেখালো কি?

হ্যাঁ। একটি চরম সত্য আমাদের শিখিয়ে গেল- পরিচ্ছন্ন থাকাই নিরাপদে থাকা।

কিন্তু দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আমাদেরকে জানান দেয় কঠোরতা ব্যতিত কোনো সুবচনে আমরা পরিচ্ছন্নতা সংরক্ষনকে আমদের জীবনের অনুষঙ্গ বানাবো না। অথচ কি আশ্চর্য্য যে এই আমি যখন বিদেশে থাকি, সেটি চাকরী উপলক্ষে দীর্ঘকালীন হোক কিংবা টুরিস্ট হিসাবে স্বল্পকালীন হোক, কি পরম সভ্য হিসাবে হাতের বর্জ্যটি পকেটে রেখে দিয়ে ডাস্টবিন খুঁজে পেয়ে তবে তাতে সে বর্জ্যটি ফেলি। বিদেশের এই অভিজ্ঞতা অর্জন শেষে আবার যে মুহুর্তে দেশে ফিরে আসি সে মুহুর্তেই আমি আবার বাংলাদেশি হয়ে যাই এবং যথারীতি হাতের বর্জ্য রাস্তায় ছুড়ে ফেলি, ঘরের বর্জ্য জানালা দিয়ে দুই বহুতল দালানের মধ্যস্থানে অবলীলায় ফেলে দিই। সত্যি সেলুকাস…কি বিচিত্র এই দেশ।

মুজিববর্ষে পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ উপহার দেয়ার কথা উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছিলেন, ২০২০ সালের এই মুজিববর্ষ কে সামনে রেখে আমরা পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ উপহার দিতে চাই। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘পরিচ্ছন্ন গ্রাম-পরিচ্ছন্ন শহর’ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। মন্ত্রী বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতোই বাংলাদেশে তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র পরিছন্নতা নিশ্চিত করা হবে। ভিশন ২০২১, ২০৪১, এসডিজি অর্জন উন্নয়নের মানদণ্ড হিসেবে পরিচ্ছন্ন জনপদ গড়ে তোলা হবে। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে- সর্বসাধারণের মধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দৈনন্দিন অভ্যাস গড়ে তোলার পাশাপাশি এ বিষয়ে তাদেরকে ‘সচেতন করা’।

কিন্তু জনগনকে সচেতন করে তোলার এই কাজটি কতটা কঠিন সেটি জানতে জিজ্ঞেস করতে হবে ‘বিডি ক্লিনে’র প্রধান সমন্বয়ক জনাব ফরিদ উদ্দিনকে। জিজ্ঞেস করতে হবে ‘পরিবর্তন চাই’ এর চেয়ারম্যন ফিদা হক কে। তারা বলবেন ‘এ এক কঠিন কাজ। তারা আরো বলবেন আমরা চাই মানুষের মাঝে পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক সচেতনতা তৈরি হোক। যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলার মানসিকতা পরিবর্তন হোক। এটি যে শুধু একদিনের কর্মসূচি তা নয়, সারাবছরই নিজেদের চারপাশকে পরিষ্কার রাখার অভ্যাস গড়তে হবে। গত বেশ কয়েকটি বছর ধরে তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায়ও মানুষ সচেতন হয়নি।

মানুষরা সচেতন না হওয়ার একমাত্র কারন হচ্ছে ‘পরিচ্ছন্নতা সংরক্ষণ এখনো আমাদের ইমানের অংশ হয়ে থাকা।’ ধর্মীয় চেতনা ও ধর্মীয় অনুশাষনকে যেভাবে ঝেটিয়ে দেশ থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে, সে কারনে বুকের ভেতর এখন আর মহান আল্লাহর ভীতি সেভাবে কাজ করেনা। তাই ইমানের অংশ নিয়ে তেমন মাথাব্যাথা আর এখন তেমন কারো নেই। পরিচ্ছন্নতা সংরক্ষণ বিষয়টি ঐচ্ছিক হওয়ায় মানুষ এখন আর তা পালনে আগ্রহী নয়। অথচ এই মানুষগুলোই বিদেশে গিয়ে পরিচ্ছন্নতা সংরক্ষণ বিধি পালন করে পরিচ্ছন্নতা সংরক্ষণ আইনের ভয়ে। জানে এর বিন্দুমাত্র অন্যথা করলেই মুহুর্ত মধ্যে উগ্রমূর্তি পুলিশের খপ্পরে পড়তে হবে।

এই প্রেক্ষিতেই প্রয়োজন হয়েছে বাধ্যবাধকতার। প্রয়োজন হয়েছে ‘পরিচ্ছন্নতা সংরক্ষন আইন’ প্রণয়নের। যে আইনের বিধানের কঠোরতার কারনে মানুষের ভেতর সৃষ্টি হবে পরিচ্ছন্নতা সংরক্ষণের বিষয়ে সচেতনতা। পরিবেশ দূষণের দীর্ঘমেয়াদি বিপদ সম্পর্কে ভয় সৃষ্টি হবে। হবে নদীর পানি দূষণের পরিনতি সম্পর্কে জ্ঞান। স্বয়ং দায়িত্ববান হবে নিজে পরিচ্ছন্ন থাকতে ও পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। আর ঐচ্ছিকতা নয়- প্রয়োজন বাধ্যতামূলক ভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার বিধান সমূহ পালন করে নিজ পরিবেশকে নির্মল রাখতে নাগরিকদের দায়িত্ববান করতে বাধ্য করা।

প্রস্তাবিত এই আইনটি শুধু প্রণয়ন করলেই চলবে না- আইনটির নিরপেক্ষ কঠোর প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। আইনের বিধানে দেশব্যাপী সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ গুলোকে বর্জ্য নিষ্কাশন দায়িত্বটিকে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসাবে বিবেচনা করার শর্ত থাকতে হবে। এইরুপ সকল প্রতিষ্ঠানকে বর্জ্য নিস্কাশনে আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। আইনের বিধানে এই প্রতিষ্ঠান গুলোকে প্রতিটি নাগরিকের গৃহের দোরগোড়া থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করতে বাধ্য করতে হবে, যেন শহরের রাস্তায় বর্জ্যের স্টোর রুম তৈরী না হয়। যেখানে সেখানে আবর্জনা বর্জ্য নিক্ষেপ করলে নাগরিকদের জেল জরিমানার ব্যবস্থা রাখতে হবে। রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান গুলোকে প্রতিটি বহুতল ভবনের প্রতিটি রান্না-ঘরের সাথে ‘গার্বেজ স্যুট’ নির্মান করতে বাধ্য করার বিধান থাকতে হবে। আইনটির প্রভাব এমন হতে হবে যাতে নাগরিকরা আইনটি মান্য করার জন্য স্বয়ং দায়িত্ববান হয়ে পড়ে।

এইরূপ একটি আইন প্রণয়ন করে তা নিরপেক্ষ ও কঠোরভাবে বছর দুয়েক প্রয়োগ করলে তিন বছরের মাথায় পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে আমরা উন্নত বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে পারব বলেই আমি বিশ্বাস করি।

মাননীয় আইন মন্ত্রী মহোদয় কি বিষয়টি বিবেচনা করবেন?

লেখক- বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান (অবঃ)

justicerahmanretd@gmail.com; www.justicerahman.webs.com