দিদার আহমদ, অ্যাডভোকেট

প্রসঙ্গ- প্যারোল এবং আমজনতার ভাবনা

দিদার আহমেদ :

প্যারোল। আমাদের দেশে এই শব্দের সাথে অনেকেই পরিচিত। বাস্তবে এ সম্পর্কে না জানলেও যখন তা টক অব দ্যা কান্ট্রি হয় তখন টেলিভিশনে ব্রেকিং নিঊজ বা পত্রিকার পাতার হেডলাইনে প্যারোলে মুক্তি লেখা দেখেছেন ঠিকই সবাই। যদিও এ বিষয়ে আমজনতার তেমন কৌতুহল নেই বা সচরাচর তা দেখে অভ্যস্থ নন,তবে সমসাময়িক রাজনীতির পর্যালোচনায়,চায়ের আড্ডায় বা খোশগল্পে অনেক সময় অনেকেকেই বলতে শুনা যায় প্যারোল কি? যে কারোও বেলায় সম্ভব? নাকি শুধু ভিআইপি ,প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি,উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাই কেবল এই সুবিধা পেয়ে থাকেন ?এটা কি রাজনীতিরই কোন অংশ নাকি আইনের কোন বিষয়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়তো অনেকের কাছে অজানাই রয়ে যায়। তাই চলুন জেনে নেই প্যারোল সম্পর্কে খুঁটিনাটি ।

প্যারোল (Parole) ফরাসী শব্দ যা শাব্দিক অর্থে প্রতিশ্রুতি দেওয়া। সহজভাবে বুঝাতে গেলে কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন মামলার আসামীকে সাময়িক সময়ের জন্য শর্তানুসারে নির্বাহী আদেশে মুক্তির নাম প্যারোলে মুক্তি । অর্থাৎ কয়েদী বা হাজতি আসামীকে শর্তাধীনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মুক্তি প্রদান করাকে প্যারোলে মুক্তি বলে।প্যারোলে মুক্তি হয় সাময়িক সময়ের জন্য। প্যারোলে মুক্তিপ্রাপ্তকে পুলিশের প্রহরায় সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয় এবং সময় ও উদ্দেশ্য শেষ হলে পুনরায় তাকে পুলিশ প্রহরায় কারাগারে প্রেরণ করা হয়।

উনিশ শতকের পরবর্তী সময়ে বিশ্বে প্যারোল ব্যবস্থা আইনগত ভিত্তির লাভ করে এবং বিশ্বজুড়ে পরিচিত হয়। স্কটল্যান্ডের আলেকজান্ডার ম্যাকোনিওচি প্যারোল প্রর্বতনে সবচেয়ে বেশী ভুমিকা রাখেন।

ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ প্যারোলে জামিন বলে কোন কথা বর্ননা করেনি। তবে ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ধারা ৪৯৮ এর ব্যাখ্যায় অন্তবর্তীকালীন জামিন হিসাবে প্যারোলে মুক্তির বিধান নিহিত আছে। অবশ্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন  ২০১০ ও  কোস্টগার্ড আইন ২০১৬ -তে প্যারোলের সুনির্দিষ্ট উল্লেখ পাওয়া গেলেও তা কেবলই বর্ডার গার্ড ও  কোস্টগার্ড  দুই বাহিনীর সদস্যদের বেলায়ই প্রযোজ্য।

দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডারস অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ এবং দ্য প্রিজন্স অ্যাক্ট, ১৮৯৪ তে প্যারোল প্রয়োগের সম্পর্কে সম্ভাব্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তবে সচরাচর গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিমালার আলোকে বাংলাদেশে প্যারোলের প্রয়োগ হয়ে আসছে। ৩ মার্চ ২০১০ সাল, পরবর্তীতে ২২ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সাল এবং সর্বশেষ ১ জুন ২০১৬ সালে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক হালনাগাদ করা প্যারোল নীতিমালা  প্রনীত হলেও তা কোন নির্দিষ্ট আইনের অধীন তা বলা হয়নি।

সর্বশেষ ১ জুন ২০১৬ সালের হালনাগাদ করা প্যারোল নীতিমালা দ্বারা পূর্বের  নীতিমালাদ্বয়কে বাতিল করা হয়েছে এবং উক্ত নীতিমালার আলোকে প্যারোলের প্রয়োগ হয়ে আসছে।

প্যারোলের মুক্তির আদেশটি মূলতঃ সরকারের প্রশাসনিক আদেশ। বাংলাদেশে এই আদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মঞ্জুর করে। যেকোনো অভিযুক্ত আসামীকে কারাগারে পাঠানো ও কারাগার থেকে বের হবার বেলায় বিচারিক আদেশের প্রয়োজন হয়। পক্ষান্তরে প্যারোলে মুক্তির ক্ষেত্রে বিচারিক আদেশের পরিবর্তে  প্রশাসনিক আদেশ প্রয়োজন হয়।

কারাগারে আটক যে কোন ব্যক্তির সাময়িক মুক্তির বিশেষ প্রয়োজনে বা কোনো নিকটাত্মীয় যেমন পিতা-মাতা, জীবনসঙ্গী, সন্তান সন্ততি,শ্বশুর বা শাশুড়ি বা  আপন ভাই বোন এর মৃত্যু ঘটলে তার জানাজায় বা শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার নিমিত্তে শর্তানুসারে একটি নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করে তার নিজের বা তার পরিবারের সদস্যদের বা নিকটাত্মীয় দ্বারা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সীমিত সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেয়া হয়।

গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় প্যারোলে মুক্তির সময়সীমা সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা উল্লেখ করা হয়েছে।ইতিপূর্বে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের জন্যও কারাগারের বন্দীরা প্যারোলে মুক্তি পেতে পারতেন।কিন্তু নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, কারাগারের বন্দীরা মা–বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানের মৃত্যুর কারণে প্যারোলে মুক্তি পাবেন। নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর কারণ ছাড়াও আদালতের আদেশ বা সরকারের বিশেষ সিদ্ধান্ত মোতাবেক সাময়িক মুক্তির প্রয়োজন দেখা দিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া যাবে।জেল গেট থেকে প্যারোলে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রহণ করার পর থেকেই সে পুলিশ এড় হেফাজতে থাকবে এবং  পরবর্তী ১২ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে পুনরায় পুলিশ প্রহরায়   কারাগারে ​পৌঁছে দিতে হবে। সময়সীমা কোনো অবস্থাতেই ১২ ঘণ্টার বেশি হবে না। ঊল্লেখ করা আবশ্যক যে, বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার মুক্তির সময়সীমা হ্রাস/বৃদ্ধি করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে। এই সময়সীমা বা মেয়াদ নির্ধারণের সম্পূর্ণ এখতিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ।

যে কোনো ধরণের বন্দী, কয়েদী বা হাজতি আসামী প্যারোলে মুক্তি পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন।সাজা প্রাপ্ত, অথবা সাজা ছাড়া আটক আছেন এমন যে কেউ এমন আবেদন করতে পারেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার গন্তব্যের দূরত্ব ও স্থান বিবেচনা করে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তার আবেদন মঞ্জুর করতে পারেন। প্যারোলে মুক্তি পেতে হলে অপরাধীকে আবেদন করতে হয়। আমাদের দেশে সাধারণত রাজনীতিবিদ,উচ্চশ্রেণির লোকেরা এই সুবিধা পেতে আমরা দেখেছি যদিও আইনে এই ব্যবস্থা কেবলমাত্র তাদের জন্য নয়। যে কোনো ধরণের বন্দী, কয়েদী বা হাজতি আসামী এই সুবিধা পেতে পারেন।তবে মঞ্জুর বা নামঞ্জুর করা সরকারের বিষয় ।

প্যারোলে মুক্তি বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালের ০১ জুন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। উক্ত নীতিমালায় বলা হয়েছে-

ক. ভিআইপি বা অন্যান্য সকল শ্রেণীর কয়েদি বা হাজতি বন্দীদের নিকটাত্মীয়ের যেমন বাবা-মা,  শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী-স্ত্রী, সন্তানসন্ততি এবং আপন ভাই-বোন মারা গেলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেয়া যাবে

খ. ভিআইপি বা অন্যান্য সব শ্রেণীর কয়েদি বা হাজতি বন্দীদের নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর কারণ ছাড়াও কোনো আদালতের আদেশ কিংবা সরকারের বিশেষ সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্যারোলে মুক্তি দেয়ার প্রয়োজন হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেয়া যাবে, তবে উভয় ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও দূরত্ব বিবেচনায় প্যারোল মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ সময় নির্ধারণ করে দেবেন।

গ. বন্দীকে সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহরাধীনে রাখতে হবে।

ঘ. মুক্তির সময়সীমা কোনো অবস্থাতেই ১২ ঘণ্টার অধিক হবে না, তবে বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার মুক্তির সময়সীমা কমানো বা বাড়ানোর ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে।

ঙ. কোনো বন্দী জেলার কোনো কেন্দ্রীয়, জেলা, বিশেষ কারাগার বা সাব-জেলে আটক থাকলে ঐ জেলার ভেতরে যেকোনো স্থানে মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ প্যারোল মঞ্জুর করতে পারবে। অপর দিকে কোনো বন্দী নিজ জেলায় অবস্থিত কেন্দ্রীয়, জেলা, বিশেষ কারাগার বা সাব-জেলে আটক না থেকে অন্য জেলায় অবস্থিত কোনো কেন্দ্রীয়, জেলা, বিশেষ কারাগার বা সাব-জেলে আটক থাকলে গন্তব্যের দূরত্ব বিবেচনা করে মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ প্যারোল মঞ্জুর করতে পারবে, তবে উভয় ক্ষেত্রেই দুর্গম এলাকা, যোগাযোগব্যবস্থা, দূরত্ব ও নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ প্যারোল মঞ্জুর কিংবা নামঞ্জুরের ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে।

চ. কারাগারের ফটক থেকে পুলিশ প্যারোলে মুক্ত বন্দীকে বুঝে নেয়ার অনুমোদিত সময়সীমার মধ্যেই পুনরায় কারাগারে পাঠাবে।

ছ. সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্যারোল মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবেন।

সুতরাং, প্যারোলে মুক্তি হল আবেদনের প্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট কারণে নির্দিষ্ট শর্তে নির্বাহী আদেশে পুলিশ প্রহরায় সাময়িক মুক্তি। যে কোন কারান্তরীন ব্যক্তি (সাজাপ্রাপ্ত বা সাজাহীন আটক) এই আবেদন করতে পারে। ঐ নির্দিষ্ট সময়ান্তে পুলিশ প্রহরায় পুনরায় কারাগারে প্রেরন করা হয়। তবে এই মেয়াদ বিশেষ কারনে হ্রাস বা বর্ধিত করা সরকারের ইচ্ছাধীন।

দিদার আহমেদ : অ্যাডভোকেট, জজকোর্ট, সিলেট।