ব্যারিস্টার খন্দকার এম এস কাউসার

বাণিজ্যিক চুক্তিভঙ্গ এবং করোনা ভাইরাস

ব্যারিস্টার খন্দকার এম এস কাউসার:

ব্যবসা বাণিজ্যে দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে কার্যসাধনের জন্য চুক্তি করা হয়ে থাকে। চুক্তি করার পর কাজ শুরু হলেই ধরে নেয়া হয় চুক্তি প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। ‘চুক্তিপ্রয়োগ’ শব্দটির সহজ কিন্তু ইংরেজি প্রকাশ হল ‘এনফোর্সমেন্ট অব কন্ট্রাক্ট’। চুক্তিবদ্ধ যে কোন পক্ষের তাঁর অংশটুকু সম্পাদন করা তাঁর আইনি দায়িত্ব, আর সে সম্পাদনের ব্যত্যয় ঘটলে চুক্তিভঙ্গ এবং এনফোর্সমেন্ট অব কন্ট্রাক্ট এর প্রশ্ন চলে আসে। তাই চুক্তির বিধানগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত, ‘একটা চুক্তি ঠিক ততটাই ভালো যতোটা চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী পক্ষগন ভালো’ (জেফ্রি ফ্রাই)।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইনফ্রাস্ট্রাকচার যেমন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, রূপপূর বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা ব্রিজ, কর্ণফুলী নদী নিচে টানেল, মেট্রোরেল, চার লেন বা আট লেন রাস্তা, মেগা ফ্লাইওভার, মাতারবারি, পায়রা বন্দর, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের তিন নম্বর টার্মিনাল, টেলিকমুনিকেশন, ইন্টারনেট থেকে শুরু করে রপ্তানি বাণিজ্য যেমন, গার্মেন্টস, ফার্মাসিউটিকেলস, চামড়াশিল্প, পাট ও অন্যান্য কৃষি এবং আমদানি বাণিজ্য যেমন, মেশিনারি ও অন্যান্য কাঁচামাল এবং অন্যান্য সকল বাণিজ্যিক লেনদেনেই রয়েছে চুক্তির উপস্থিতি।

যেকোনো বাণিজ্যিক চুক্তির ক্ষেত্রেই যেকোনো পক্ষ হয়তো কভিড-১৯ এর কারনে সম্পাদন করতে ব্যর্থ হতে পারে, বা নিকট ভবিষ্যতে চুক্তি ভঙ্গের সম্ভাবনা রয়েছে এবং এতে অনেক আইনি জটিলতা তৈরি হতে পারে। চুক্তি সম্পাদনে দায়িত্বপ্রাপ্ত বা চুক্তির সুবিধাভুগি যে কোন পক্ষ তাদের অংশটুকু সময়মত সম্পাদন করবে এটাই আকাঙ্ক্ষিত। এখানে দেখার বিষয় হচ্ছে কোন পক্ষ তাঁর অংশটুকু কভিড-১৯ এর কারনে সম্পাদনে ব্যর্থ হয়েছে কিনা। যে চুক্তি অনুযায়ী চুক্তি সম্পাদন শেষ হওয়ার কথা ছিল কভিড-১৯ এর তান্ডব শুরু হওয়ার আগে, সেক্ষেত্রে কভিড-১৯ কে আনা যাবেনা পক্ষসমর্থক (ডিফেন্স) হিসেবে। আবার কভিড-১৯ শুরুর পর ইতিমধ্যে চুক্তি সম্পাদনের উপযোগী পরিবেশ চলে আসার পরও চুক্তি সম্পাদনের প্রচেষ্টা শুরু না করে বসে থাকলে ও এ পক্ষসমর্থন (ডিফেন্স) নেয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে কোন পক্ষ যদি অন্য পক্ষ থেকে চুক্তিভঙ্গের বা তার সম্ভাবনার নোটিশ পায়, তবে আইনি জটিলতা শুরু হয়ে যেতে পারে। খোলা মন নিয়ে এবং সম্পর্ক রক্ষার মানসিকতা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান করাই হবে সর্বোত্তম। অন্যথায় সমস্যা সমাধানের অন্যান্য পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ সরকার কভিড-১৯ এর তান্ডবের শুরু থেকে  একটি নির্দিষ্ট সময়কে ‘স্থগিত সময়’ ঘোষণা করে সিঙ্গাপুর এর মতো একটি আইন করতে পারে, যা দিয়ে এ সময়ের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের বাধ্য বাধকতা স্থগিত থাকবে। তাতে অনেক আইনি জটিলতার সমাধান হয়ে যাবে। মাত্র ৯ দিনে আইন পাসের সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা এবং গত ৭ এপ্রিল ২০২০ পাস করা ‘দা কভিড-১৯ (টেম্পোরারি মিজারস) এক্ট ২০২০’ নামের সিঙ্গাপুর এর এই আইন কে বলা হয় ‘আইনি সার্কিট ব্রেকার’ বা ‘ব্রেথিং স্পেস’। এই আইন দ্বারা কিছু চুক্তির (বাণিজ্যিক এবং ব্যক্তিগত) শিডিউল করে দেয়া হয়েছে যেগুলো স্থগিত থাকবে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। এ  শিডিউল এ আছে অর্থনৈতিক দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক ভাড়াটিয়া ইত্যাদি। এছাড়া এ আইনে ছিল, ভার্চুয়াল কোর্ট, মানুষের চলাচলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। যেসব চুক্তি স্থগিত থাকবে এই আইনে তাদের মধ্যে কিছু, যেমন, বাণিজ্যিক প্রাঙ্গন ভাড়া, কন্সট্রাকশন চুক্তি, কন্সট্রাকশন উপকরণ সরবরাহ, এসএমই কে ব্যাংক বা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ, মেশিনারি কিনার চুক্তি, বিদেশীদের সাথে চুক্তি ইত্যাদি। প্রাথমিক ভাবে এ ‘স্থগিত সময়’ কে ছয় থেকে বার মাস পর্যন্ত নির্ধারিত করা হয়েছে। এ আইনে যিনি এ স্থগিতের সুবিধা চাইবে তিনি অপর পক্ষকে একটা নোটিশ দিবেন। এ আইনে বলা হয়েছে, এ নোটিশ পেলে অপর পক্ষ আর কোন আইনি বা আরবিট্রেশন এর পদক্ষেপ নিতে বা চালাতে পারবে না, স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তিতে কোন আঘাত করতে পারবে না, কোন রেজিস্টার্ড কোম্পানির বিরুদ্ধে পাওনাদারদের দ্বারা কোন পদক্ষেপ নিতে পারবে না, দেওলিয়া বিষয়ক কোন পদক্ষেপ নিতে পারবে না, কোন লিজ- লাইসেন্স বাতিল বা দখল করতে পারবে না ইত্যাদি। এ আইন বিল্ডিং কন্সট্রাকশন শিল্পকে বেশি সুরক্ষা দিয়েছে। বাংলাদেশের এ শিল্প বিশেষত এ আইনের জন্য চেষ্টা করতে পারে।

এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকার এসএমই দের জন্য তাঁর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ‘ফোরস মেঝর সার্টিফিকেট’ এর ব্যবস্থা করতে পারে যা এসব চুক্তির ক্ষেত্রে পক্ষসমর্থক (ডিফেন্স) হিসেবে কাজ করতে পারে যেকোনো আইনি জটিলতায় । এছাড়া এখন থেকে বাংলাদেশী কোন পক্ষের বিদেশী পক্ষের সাথে চুক্তি করার সময় ‘ফোরস মেঝর ক্লজ’ বাধ্যতামূলক ভাবে সংযোজন করতে হবে। এ ক্লজ এ মহামারি সহ বিধাতার সকল গজব (এক্ট অব গড) কে সংযোজন করতে হবে এবং আরও বলতে হবে ‘এমন প্রকৃতির আর যা যা ঘটনা আসবে তা ফোরস মেঝর হিসেবে পরিগণিত হবে।’ বিশেষত বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এলসি বা চুক্তিতে ‘ফোরস মেঝর ক্লজ’ বাধ্যতামূলক।

ইউসিপি ৬০০ (ইউনিফর্ম কাস্টমস অ্যান্ড প্র্যাকটিস ফর ডকুমেন্টারি ক্রেডিট ৬০০) এর অনুচ্ছেদ ৩৬ এ ব্যাংককে ফোরস মেঝর এ একটি নিরাপত্তা দিয়েছে বলে বাণিজ্যিক চুক্তির ক্ষেত্রে ফোরস মেঝর আরও জরুরী হয়ে পড়েছে, যে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। এগিয়ে আসতে হবে আমাদের ও। তাহলেই হয়তো আমরা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ‘এনফোর্সমেন্ট অব কন্ট্রাক্ট’ ইনডিকেটর এর ১৯০ টি দেশে ১৮৯ তম স্থান থেকে ফিরে আসতে পারব। এছাড়া,  বাংলাদেশ স্বাক্ষর করতে পারে জাতিসংঘের চুক্তি বিষয়ক কনভেনশন ‘ইউনাইটেড নেশন্স কনভেনশন অন কন্ট্রাক্টস ফর দা ইন্টারন্যাশনাল সেল অব গুডস’, যা ভিয়েনা কনভেনশন নামে পরিচিত। বাংলাদেশ কেন আজও স্বাক্ষর করেনি, তাঁর উত্তর নাই আমার কাছে।

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। চাকরি ও একটি চুক্তি যেখানে আপনি কিছু বেতনের বিনিময়ে নিজেকে একটু একটু করে বিকিয়ে দিচ্ছেন প্রতিদিন। তাই চাকরি থেকে বরখাস্ত মানে নিজেকে প্রতিদিন একটু একটু করে বিকিয়ে দেয়ার চুক্তি থেকে আপনাকে মুক্তি দেয়া হল (সানডে আডেলাজা)। চাকরি হারালে বিচলিত হবেন না। উদ্যোক্তা হয়ে উঠোন। নিজেকে প্রতিদিন একটু একটু করে বিক্রি করার চুক্তি থেকে মুক্ত হন।

ব্যারিস্টার খন্দকার এম এস কাউসার: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এর একজন আইনজীবী এবং ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স ইয়াং আরবিট্রেটরস ফোরাম (আইসিসি- ওয়াই এ এফ) এর রিজিওনাল (উত্তর এশিয়া) প্রতিনিধি। kawsarbar@gmail.com, kawsar215@yahoo.co.uk