বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান (অবঃ)

সামাজিক দূরত্ব নাকি শারীরিক দূরত্ব?

বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান:

এযাবৎকাল করোনা বিস্তার প্রতিরোধে বৈশ্বিক ও দেশীয়ভাবে মানুষে মানুষে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপরে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ইংরেজীতে এক নতুন টারমিনোলোজী ‘সোস্যাল ডিসট্যান্সিং’ আবিস্কৃত হয়ে তা মুখে মুখে বহুল প্রচলিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশে এই ফ্রেজটির বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে ‘সামাজিক দূরত্ব’ সংরক্ষণ। যিনি এই ইংরাজী ফ্রেজটি ব্যবহার প্রচলন করেছিলেন তিনি লক্ষ্য করেননি ‘সোশ্যাল’ তথা ‘সামাজিক’ তথা ‘সামস্টিক’ নয়, বরং এই প্রতিরোধটি ‘ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির শারীরিক স্পর্শ পরিহার’ এর সাথে সম্পর্কিত। সে কারনে এই ফ্রেজটি হওয়া উচিত ছিল ‘ফিজিকাল ডিসট্যান্সিং’ যার বাংলা প্রতিশব্দ হতে পারত ‘শারীরিক দুরত্ব’ সংরক্ষণ। ‘সামাজিক দূরত্ব’ ফ্রেজটি আমাদেরকে সার্বিকভাবে সমাজ থেকে দুরত্বে থাকার ভুল ম্যাসেজ বা ভুল উপদেশ দিচ্ছে।

মানুষ সমাজবদ্ধতায় বসবাস করার কারণে পারস্পারিক নির্ভরশীল এবং সে কারনে প্রতিটি মানুষ অপরের প্রতি দায়বদ্ধ। এই দায়বদ্ধতার কারণেই চিকিৎসক যে কোন সময় রোগী দেখতে বাধ্য, রিক্সাচালক রিক্সা নিয়ে রাস্তায় বেরোলেই যাত্রী পরিবহনে বাধ্য, মুদী তার দোকান খোলা রেখে ক্রেতার কাছে পন্য বিক্রয়ে বাধ্য ইত্যাদি। কিন্তু ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখার এই শব্দাবলী অচেতনভাবে মানুষকে এই দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত করে দেয়। কিন্তু শব্দটি যদি হয় ‘শারীরিক দূরত্ব’ তবে সেটা কিন্তু অচেতন মনে এরূপ কোন অভিব্যক্তি সৃষ্টি করেনা।

‘সামাজিক দুরত্ব’ শব্দাবলী দ্বারা সমাজ থেকে দুরত্বে থাকার এই তথাকথিত উপদেশের কারণে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড হারিয়ে ফেলার আশংকায়, এই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যে সব নিয়ম-নীতি ও প্রক্রিয়া আছে অবচেতন মনে তার বিরোধী হয়ে উঠছে। ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি মানুষ সব নিয়ম-নীতি ভেঙে রাস্তায় বেরিয়ে আসছে আর হু হু করে বেড়ে চলছে করোনার বিস্তার।

বিশেষজ্ঞদের আশংকা করোনার সাথে বসবাস চলবে আমাদের আগামী দু-তিন বছর। তাই যদি হয় আমাদের নিয়তি, তবে এখনিই পরিকল্পনা করতে হবে জীবন ও জীবিকাকে অক্ষুন্ন রেখে কিভাবে সহবস্থান করা যাবে করোনার সাথে। এ প্রেক্ষিতে জাতিগতভাবে আমাদের কি করা আবশ্যক সে বিষয়ে আমার নিজস্ব কিছু অভিমত এই লেখনীর উপজীব্য;

১. বদলাতে হবে শব্দ- প্রথমেই ‘সামাজিক দূরত্ব’ ফ্রেজটি ‘শারীরিক দূরত্ব’ ফ্রেজ দ্বারা পাল্টে ফেলতে হবে। সরকারী সকল প্রচারনায়, সকল গণমাধ্যমের লেখনীতে এবং সকলের মৌখিক উচ্চারণে এখনই ব্যবহার করতে হবে ‘শারীরিক দূরত্ব’ সংরক্ষণ শব্দাবলী। এতে মানুষের মনে এর উদ্দেশ্যের স্পষ্ট অভিব্যক্তির সৃষ্টি হবে।

২. বদলাতে হবে আচরণ- সামাজিক মানুষ হিসাবে, বিশেষ করে মুসলমান হিসাবে মানুষ মানুষের সাথে মুসাফাহা (শেকহ্যান্ড), কোলাকুলি ইত্যাদি করে সম্ভাষণ জানানোর যে আচরণ সেটা বদলাতে হবে। এতে ধর্ম পালনে কোন ত্রুটি হওয়ার সম্ভবনা নেই একারনে যে ইসলামে সম্ভাষণ জানানোর সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে ‘আসসালামুআলাইকুম’ বলে অপরের জন্য দোয়া করা। অন্যান্য ধর্মানুসারীরা নিজ নিজ ধর্মরীতি অনুযায়ী সম্ভাষণ বিনিময় করবেন।

৩. শিখতে হবে স্মার্ট ফোন ও কম্পিউটার ব্যবহার- বাইরে যাওয়া পরিহার করার বিকল্প হচ্ছে স্মার্ট ফোন ও কম্পিউটারের সর্বোচ্চ ব্যবহার শিখে নেয়া। একটু অধ্যবসায় দিয়ে এ পদ্ধতি শিখে নিতেই হবে। আধুনিক বিশ্ব এখন এক ক্লিকের দুরত্বে।

৪. হতে হবে ক্যাশলেস লেনদেনে অভ্যস্ত- কাগজের টাকা ভাইরাস বাহক। মোবাইল অর্থ লেনদেন পদ্ধতি, নিজ ব্যাংক একাউন্টের ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে অভ্যস্ত হোন। কাগজের টাকায় হাত দিতে বাধ্য হলে হাত ধুতে হবে সাথে সাথেই।

৫. করতে হবে ওয়ার্ক ফ্রম হোম- আপনার যদি আত্মকর্মসংস্থান থাকে তবে এর পরিচালনাটি নিজের বাড়িতেই স্থাপন করে ফেলুন। নিজের সুবিধামতো কর্মচারীদের নির্দেশ দিন। দোকানের মালিক হলে পাইকারী মার্কেট থেকে টেলিফোনে মালামাল কিনে ক্যাশলেস পেমেন্ট দিন; কুরিয়ারে মালামাল আনান। বেসরকারী চাকরীজীবি হলে আপনার কর্তৃপক্ষ ওয়ার্ক ফ্রম হোমের নীতিমালা তৈরী করবেন। সরকারী চাকরীজীবি হলে সরকারের দেয়া নীতিমালা অনুসরণ করুন।

৬. শপিং আনন্দ পরিত্যাগ করতে হবে- স্রেফ আনন্দ লাভের জন্য শপিং মলে যাওয়ার অভ্যাস বন্ধ করতে হবে। ই-কমার্স এখন আপনার ফিঙ্গার টিপসে। মলে গিয়ে শপিং এর আনন্দ এখন নিয়ে আসুন ঘরে বসে ই-কমার্সের আনন্দে। ই-কমার্স সাইটগুলো এখন প্রতিযোগীতামুলক মুল্যে পন্য বিক্রয় করে থাকে। মলের মুল্য আর ই-কমার্সের মুল্যে কোন পার্থক্য নেই। বাজার সদাই থেকে শুরু করে জীবনের প্রয়োজনীয় সকল পন্যই কেনা যায় ই-কমার্সে।

৭. পরিছন্নতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে- শুধু ব্যক্তিক নয় পারিপার্শিক পরিচ্ছন্নতাকে অবহেলা করার অভ্যাস পাল্টে ফেলতে হবে। নিজ গৃহের বর্জ্য জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। বর্জ্য নিস্কাশনের সুষ্ঠু পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। রাস্তায় চলতে নিজ হাতের আবর্জনা আর রাস্তায় ফেলা চলবেনা। এবার একটু পরিচ্ছন্নতা সচেতন হোন।

৮. পারস্পরিক প্রত্যক্ষ দেখা সাক্ষাৎ পরিহার করতে হবে

মার্কিন রোগতত্ত্ববিদেরা এরই মধ্যে বলেছেন, কোনো কার্যকর ভ্যাকসিন ও নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি হাতে আসার আগেই সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চালু করতে হলে মানুষকে নিজেদের মধ্যকার সরাসরি যোগাযোগের হার কমিয়ে আনতে হবে। জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির রোগতত্ত্ববিদ ড. জেরার্ডো চাওয়েলের নেতৃত্বে পরিচালিত এ-সম্পর্কিত এক গবেষণায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, মানুষকে নিজেদের মধ্যকার সরাসরি যোগাযোগের পরিমাণ আগের চেয়ে ৬৫ শতাংশ কমিয়ে সব কাজ ডিজিটাল পদ্ধতিতে সমাধা করার কৌশল শিখতে হবে। তবেই রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রেখে সব স্বাভাবিক করা যাবে।

শুধু ব্যক্তিক নয় সামস্টিক আচরণ বদলে ফেলতে হবে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ এমনই অভ্যাস বদলের ডাক দিয়েছে। আর এই বদলটি শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে হলে হবে না অপরকে এই পরিবর্তনে উদ্ভুত করতে হবে। করোনা ভাইরাসের বিস্তার একটি বৈশ্বিক মহামারির সৃষ্টি করেছে। তাই এ অভ্যাস বদল হতে হবে সামষ্টিকভাবে। এ ক্ষেত্রে জনপরিসরে একজন মানুষের আচরণ কেমন হবে, অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের ক্ষেত্রে নতুন কৌশল কী হবে সে সব নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারকদের।

বাজার, শপিং মল, আদালত প্রাঙ্গণ, মসজিদ, বাস ও রেলস্টেশনের মতো জন সমাগমের স্থলে মানুষের আচার ব্যবহারটি কী হবে সে সব সুনির্দিষ্ট করে নির্ধারন করতে হবে। জনসমাগমের এসব স্থলের নকশা কেমন হবে, মানুষ এসব স্থান কি প্রকারে ব্যবহার করবে এ সবকিছুই নির্ধারণ করে দেবে ভাইরাসটির সঙ্গে মানুষ কত দ্রুত সহাবস্থান করতে শিখবে।

যেহেতু খুব দ্রুত এর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি আসছে না বা একটি ভ্যাকসিন পেতে এবং তা সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে যেতে এখনো অনেক সময় লাগবে, তাই যে দেশের মানুষ যত দ্রুত এই কৌশলগুলো নিজেদের মতো করে আবিষ্কার করবে, তত দ্রুতই সব স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।

ইন্টারনেট নিউজ পোর্টালগুলোতে সারা পৃথিবীর মানুষদের পরিবর্তনের বিভিন্ন খবর বেরিয়েছে। একটি পোর্টালে লিখেছে “সরাসরি পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এমন পরিবর্তন এক বিরাট আচরিক পরিবর্তনের দাবি জানায়। দাবিটি শুধু ব্যক্তি মানুষের আচরণগত পরিবর্তনের কথাই বলে না। এটি একই সঙ্গে যাবতীয় সামাজিক চুক্তির নবায়নের কথাও বলে। এটি ব্যক্তিকে সমষ্টির কথা আরও বেশি করে মনে করিয়ে দিচ্ছে। কারণ, শুধু নিজে সাবধান থাকার মধ্য দিয়ে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশী থেকে শুরু করে দিনে একবার মাত্র যার সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তার সুস্থ ও সতর্ক থাকার ওপরও নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নির্ভর করছে। এ কারণে ব্যক্তিক আচরণ নয়, সামষ্টিক আচরণই নির্ধারণ করবে সবকিছু কবে স্বাভাবিক হবে।”

লেখক- বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান (অবঃ)

justicerahmanretd@gmail.com; www.justicerahman.webs.com