মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান

দেশের আইন জানতে আপনি বাধ্য কিনা এবং মাস্ক পরিধান প্রসঙ্গ

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান :

মানুষকে সুষ্ঠু, স্বাধীন এবং সুশৃংখলভাবে পরিচালনার জন্য যে নিয়ম-কানুন তৈরী করা হয় তাকে আইন বলে। রাষ্ট্র পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সময়ে সময়ে আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ সহ রাষ্ট্রকে বিভিন্ন বিধিবিধান প্রণয়ন করতে হয়। সহজভাবে বললে আইন কোন কাজটি অপরাধ আর কোন কাজটি অপরাধ নয় তা নির্ণয় করে, পাশাপাশি কৃত অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান রাখে যাতে করে মানুষ অপরাধ করতে ভয় পায়। অর্থাৎ আইন তৈরীর মূল উদ্দেশ্যই হল মানুষকে অপরাধ বিষয়ে সচেতন করা এবং জনগণকে অপরাধ থেকে দূরে রাখা।

এখন প্রশ্ন হলো রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আপনি সব আইন জানতে বাধ্য কিনা কিংবা যদি আপনি আইনের কোন নির্দিষ্ট বিধান সম্পর্কে না জানেন তাহলে আপনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোন ব্যাবস্থা নিতে পারবে কিনা?

এটার উত্তর খুঁজতে হলে নিন্মোক্ত বিষয়টি আপনাকে মাথায় রাখতে হবে- Ignorance of law is no excuse” (Ignorantia juris non excusat or ignorantia legis neminem excusat) আইন শাস্ত্রের এই প্রবাদ বাক্যটি শত শত বছর ধরে পৃথিবীতে দেশগুলু মেনে চলে।বাংলায় এই বাক্যটির অর্থ দাঁড়ায় আইনের অজ্ঞতা ক্ষমার অযোগ্য কিংবা আইনের অজ্ঞতা ক্ষমার কোন কারণ হতে পারে না। অর্থাৎ রাষ্ট্র ধরে নিবে যে সংশ্লিষ্ট প্রচলিত আইনটির বিধি-বিধান সম্পর্কে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক জানেন। কারণ সরকার জনগনকে তা জানাতে গেজেট প্রকাশ করে। তাই যদিও বাস্তবে আপনি সংশ্লিষ্ট আইন সম্পর্কে না জেনে উক্ত আইনটির কোন বিধি-বিধান লঙ্গন করেন আর পরে যদি আপনি সংশ্লিষ্ট আইনটি সম্পর্কে জানেন না বলে কোন অজুহাত ( Excuse) দেখান তবুও বিচারাদালতের কাছে তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। আপনাকে প্রচলিত আইন ভঙ্গ করার কারণে শাস্তি পেতে হবে।

আমরা জানি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কর্তৃক ঘোষিত বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে ইতোমধ্যে বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব মানবতা। দু দুটো বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছে এই পৃথিবী। শুনেছে মানবতার আর্তনাদ। কিন্তু এবার করোনার হিংস্র থাবা সবকিছুকেই যেন ম্লান করে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে মানুষকে এই মহামারী থেকে বাঁচাতে দেশে দেশে সরকারকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। দীর্ঘদিনের লকডাউন খুলতে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশে তেমনি বাংলাদেশেও এর ব্যাতিক্রম নয়।

যেহেতু করোনা ভাইরাসের প্রকোপ এখনো রয়ে গেছে সেহেতু জীবন ও জীবিকা দুটোই বাঁচাতে বাংলাদেশে সরকারও জনগনের জানমাল রক্ষার্থে বিভিন্ন আইনগত পদক্ষেপ নিচ্ছে।ইতোমধ্যে গত এপ্রিলের মাঝামাঝি বাংলাদেশে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল আইন ২০১৮’র ক্ষমতাবলে সারা দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে।তাই লকডাউনের পাশাপাশি সংক্রমন ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বারবার বলা হচ্ছে। পাশাপাশি এখন অঘোষিত লকডাউন শেষে কেউ মাস্ক না পরলে জেল জরিমানার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।

গত ৩০ মে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি বিজ্ঞপ্তিত প্রকাশিত হয়।এতে বলা হয়েছে, বাইরে চলাচলের ক্ষেত্রে সবসময় মাস্ক পরিধানসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। তা নাহলে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ এর ধারা ২৪ (১), (২) ও ধারা ২৫ (১) ও (২) অনুয়ায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর এই আইন বাস্তবায়ন করবে জেলা প্রশাসন ও যথাযথ কর্তৃপক্ষ।

এদিকে, আইনের ধারা অনুযায়ী কেউ মাস্ক না পড়ে বের হলে সর্বোচ্চ ৬ মাস জেল অথবা এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়া কেউ যদি এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন তাহলে তিন মাসের জেল এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

এখন একনজরে দেখে নেয়া যাক উক্ত আইনটির ২৪ ও ২৫ ধারায় মূলত কি বলা আছে-

ধারা ২৪, উপধারা ১- যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক জীবাণুর বিস্তার ঘটান বা বিস্তার ঘটিতে সহায়তা করেন, বা জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও অপর কোনো ব্যক্তি সংক্রমিত ব্যক্তি বা স্থাপনার সংস্পর্শে আসিবার সময় সংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি তাহার নিকট গোপন করেন তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।

উপধারা ২- যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনূর্ধ্ব ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ডে, বা অনূর্ধ্ব ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

ধারা ২৫, উপধারা ১- যদি কোনো ব্যক্তি-
(ক) মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তাহার উপর অর্পিত কোনো দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন, এবং

(খ) সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কোনো নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন,
তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।

উপধারা ২- যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে, বা অনূর্ধ্ব ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

অতএব যদি খুব সহজ ভাষায় বলি- করোনা মহামারীর ভয়ংকর এই পরিস্থিতিতে দেশপ্রেমের অংশ হিসেবে, দেশকে বাঁচাতে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পরিশেষে নিজেকে ও নিজের প্রিয় মানুষগুলুকে বাঁচাতে আমরা আইন জানব, সরকারের নির্দেশনা মানব, মাস্ক পড়বো এবং জেল জরিমানা থেকে নিজেদের রক্ষা করবো।

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ ও প্রক্টর ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়