মো: সোবহান আলী

কর্তৃপক্ষের অরক্ষিত বৈদ্যুতিক তারে স্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু কি নিছক দূর্ঘটনা নাকি অন্য কিছু?

মো: সোবহান আলী:

এ ধরণের ঘটনা কি দূর্ঘটনা কি-না, সেটি বুঝতে হলে সর্বপ্রথম বুঝতে হবে দূর্ঘটনা বলতে আসলে কী বোঝায়? সাধারণভাবে দূর্ঘটনা বলতে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত, আকস্মিক এবং অপরিকল্পিত ঘটনাকে বোঝায় যা স্বাভাবিক, সাধারণ বা দৈনন্দিন কাজের ফল নয়। দূর্ঘটনার কোনো একক আইনী সংজ্ঞা না থাকলেও ব্যাপকভাবে দূর্ঘটনা বলতে এমন কোনো ঘটনাকে বোঝায় যেটিকে মানুষ সাধারণ যত্ন, সতর্কতা এবং দক্ষতা দিয়ে প্রতিহত করতে পারে না। Slattery v. Haley মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। এ মামলাতে একজন গাড়ি চালক গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং গাড়ির ভেতরেই পড়ে যান। ফলতঃ গাড়িটি একা একা চলতে থাকে। চলতে চলতে গাড়িটি একজন মানুষকে ধাক্কা দেয় এবং ধাক্কা খেয়ে লোকটি মারা যান। প্রশ্ন ওঠে, এজন্য গাড়ির চালক কি দায়ী হবেন কি-না? আদালত এ মামলায় সিদ্ধান্ত দেন যে, ঘটনাটি একটি দূর্ঘটনা এবং গাড়ির চালক এজন্য দায়ী হবেন না, কারণ গাড়ির চালক তাঁর সাধারণ যত্ন, সতর্কতা এবং দক্ষতার মাধ্যমে ঘটনাটিকে প্রতিহত করতে পারতেন না।

যত্রতত্র বৈদ্যুতিক তার, বিলবোর্ড আর পোস্টার সম্বলিত খণ্ড চিত্র যেন খোদ বাংলাদেশেরই তিলক, টুপি,পৈতা। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে প্রায় সব রাস্তায় মাথার উপর ঝুলে থাকে অরক্ষিত বৈদ্যুতিক তার। শুধু রাস্তায় মাথার উপরই নয়; কম উচু ভবনের উপরে, বেশি উচু ভবনের পাশে, জলাশয়ের উপর, ক্ষেতের উপর, রেললাইনের উপর সহ বিভিন্ন যায়গায় এ অরক্ষিত তারের ছড়াছড়ি, যা থেকে নিয়মিতভাবে অগ্নিকাণ্ড এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। প্রশ্ন হচ্ছে এসব ঘটনা কি দূর্ঘটনা কি-না? পূর্বোল্লিখিত ধারণা অনুযায়ী এটি দূর্ঘটনা নয়, কারণ এটি কর্তৃপক্ষের সাধারণ যত্ন, সতর্কতা এবং দক্ষতার মাধ্যমে প্রতিহত করা সম্ভব ছিলো। আমি বার বার অরক্ষিত বৈদ্যুতিক তারের কথা বলছি কারণ অধিকাংশ এরকম বৈদ্যুতিক তারে কোনো বিদ্যুৎ অপরিবাহী পদার্থের প্রলেপ থাকে না এবং তারগুলো ছিঁড়ে গেলে যাতে নীচে না পড়ে যায়, তারও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ কর্তৃপক্ষ নেয় না বললেই চলে ; Underground Wiring এর কথা বাদই দিলাম। কর্তৃপক্ষ যদি অপরিবাহী পদার্থের প্রলেপযুক্ত তার ব্যবহার করতো, কিংবা তারগুলো যেকোনোভাবে জনগনের সব ধরণের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতো তাহলে এ ধরণের ঘটনাগুলো প্রতিহত করা সম্ভব ছিলো। কাজেই এরকম অরক্ষিত বৈদ্যুতিক তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু অন্য আর যা কিছুই হোক, দূর্ঘটনা নয়।

তাহলে এসব অগ্নিকাণ্ড কিংবা প্রাণহানির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কি ফৌজদারি আইনে দায়ী করা যাবে?

দণ্ডবিধির ধারা ৬ অনুযায়ী, দণ্ডবিধির সকল অপরাধ সাধারণ ব্যতিক্রম সাপেক্ষ। অর্থ্যাৎ কোনো ব্যক্তি দণ্ডবিধির অধীনে কোনো অপরাধ করলে সেটি যদি একই সঙ্গে সাধারণ ব্যতিক্রমের আওতায় আসে তাহলে সেটি অপরাধ নয়। তাই, কর্তৃপক্ষকে ফৌজদারী আইনে দায়ী করার আগে আমরা দেখব কর্তৃপক্ষ কোনো সাধারণ ব্যতিক্রমের অজুহাত তুলতে পারেন কি- না।

কর্তৃপক্ষ দণ্ডবিধিতে উল্লেখিত সাধারণ ব্যতিক্রমগুলোর মধ্যে ৮০ ধারায় অজুহাত তুলতে পারেন। এখন আমরা দেখব, কর্তৃপক্ষের ৮০ ধারার অজুহাত শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকে কি-না।

দণ্ডবিধির ৮০ ধারায় বলা আছে, দূর্ঘটনা বা দূর্ভাগ্যক্রমে এবং কোনো প্রকার অপরাধমূলক উদ্দেশ্য কিংবা অবগতি ব্যতিরেখে, আইনানুগ পদ্ধতিতে, আইনানুগ মাধ্যমের সাহায্যে এবং যথাযথ যত্ন ও সতর্কতার সাথে সম্পাদিত কোনো আইনানুগ কাজই অপরাধ নয়।

মজার ব্যাপার হচ্ছে দণ্ডবিধির কোথাও দূর্ঘটনা, দূর্ভাগ্য কিংবা উপযুক্ত যত্ন ও সতর্কতার সংজ্ঞা নেই। ধরে নিলাম, কর্তৃপক্ষ বললো এটি দূর্ঘটনা, ঘটনাটি দূর্ভাগ্যবশতঃ ঘটেছে এবং তাঁরা এ ঘটনা এড়ানোর জন্য উপযুক্ত যত্ন ও সতর্কতার অংশ হিসেবে অপরিবাহী পদার্থের প্রলেপহীন তার মাটিতে শুয়ে না রেখে মাথার উপর ঝুলিয়ে দিয়েছেন, যাতে কেউ আক্রান্ত না হয়। কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি যে, ব্যাপকভাবে প্রচলিত দূর্ঘটনার সংজ্ঞা অনুযায়ী উল্লেখিত মৃত্যু কোনো দূর্ঘটনা নয় এবং তাঁরা যেটিকে উপযুক্ত যত্ন এবং সতর্কতা বলছেন, সেটি উপযুক্ত নয়। কারণ বৈদ্যুতিক তারগুলো আমাদের সংস্পর্শে না থাকলেও সংস্পর্শে আসার যথেষ্ট সুযোগ তাঁরা তৈরী করে দিয়েছেন(তারে কোনো অপরিবাহী কভার নেই, তার ছিঁড়ে নীচে পড়তে পারে)।

তার মানে আমরা বুঝলাম সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দণ্ডবিধির ৮০ ধারার অজুহাত তুললেও সেটি ধোপে টিকবে না।

আমরা জানলাম যে, এধরণের মৃত্যু দূর্ঘটনা নয় এবং একইসাথে এটি দণ্ডবিধির ৮০ ধারার নিরাপত্তাও পাবে না। তাহলে এটি কি দণ্ডবিধির ৩০৪ক ধারার কর্তৃপক্ষের অবহেলার ফলে সংঘটিত মৃত্যু?

৩০৪ক ধারামতে, যদি কোনো ব্যক্তি অপরাধজনক নরহত্যা বলে গণ্য নয় এ রকম কোনো বেপরোয়া বা তাচ্ছিল্যপূর্ণ কাজ করে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটান, তিনি পাঁচ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

৩০৪ক ধারায় আসতে হলে, প্রথমত, যে মৃত্যুটি হয়েছে তা অপরাধমূলক নরহত্যা হওয়া যাবে না এবং দ্বিতীয়ত, যে কাজের ফলে মৃত্যু হয়েছে তা হতে হবে কোনো বেপরোয়া বা তাচ্ছিল্যপূর্ণ কাজ।

দণ্ডবিধির ২৯৯ এবং ৩০০ ধারায় অপরাধমূলক নরহত্যার যে ব্যাখা দেওয়া হয়েছে তা অনুযায়ী কোনো একটি মৃত্যু ঘটানো অপরাধমূলক নরহত্যা হবে, যদি অপরাধী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জেনেশুনে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায়। যেমন- কেউ পূর্ব শত্রুতার জের ধরে কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি করে মেরে ফেলল কিংবা কোনো পূর্বপরিকল্পনা বা মৃত্যু ঘটানোর কোনো আকাঙ্ক্ষা ছাড়াই কারো পেটে চাকু বসিয়ে দিলো কিন্তু সে জানতো যে, কারো পেটে চাকু ঢুকালে সেটি তার মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

অর্থ্যাৎ, ৩০৪ক ধারায় আসতে হলে মৃত্যু ঘটানোটি আবশ্যিকভাবেই ইচ্ছাকৃত বা অবগতি সহকারে মৃত্যু ঘটানো হওয়া যাবে না। ইচ্ছাকৃত বা অবগতি ছাড়াও কি তাহলে কারো মৃত্যু ঘটানো যায়? উত্তর হচ্ছে হ্যা। যেমন- Bhimbhai Kalabhai v. State of Gujarat মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি গুজরাটের বাগদানা গ্রামে এলাকার মানুষের সুবিধার্থে একটি পানির ট্যাংকি নির্মাণ করেছিলেন যা ভেঙ্গে গিয়ে গ্রামের ৭ জন মানুষ মারা যান এবং অনেকেই আহত হন। এ মামলায় ট্যাংকি নির্মাণকারীকে ৩০৪ক ধারায় শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। কারণ, সে যে ট্যাংকি ধ্বসের মাধ্যমে মানুষ মেরেছিল তা তার ইচ্ছাকৃত ছিলো না এবং সে জানতোও না যে ট্যাংকিটি ধ্বসে গিয়ে মানুষ মারা যাবে। কিন্তু সে ট্যাংকিটি নির্মাণে কিছু সস্তা উপাদান ব্যবহার করেছিলো। অর্থ্যাৎ অভিযুক্ত ব্যক্তির অবহেলার ফলে এতোগুলো মানুষ মারা গিয়েছিলো।

এখন আসি আমাদের আলোচিত মৃত্যুটি কি অবহেলাজনিত মৃত্যু কি-না?

আমাদের আলোচিত মৃত্যুটি অবহেলা জনিত মৃত্যু না। কারণ, যদিও অরক্ষিত বৈদ্যুতিক তার রাখার মাধ্যমে তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে মারছেন না কিন্তু তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন যে এভাবে তার রাখার ফলে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ বিভিন্নভাবে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। এরমধ্যে অরক্ষিত বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে আসার ফলে যদি একশো জন মানুষও মারা যান, তাহলে কর্তৃপক্ষ এরমধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে অবগত যে, এভাবে অরক্ষিত তার রাখলে তা মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই এ ধরণের মৃত্যুর ঘটনা দণ্ডবিধির ৩০৪ক ধারায় আসবে না।

অর্থ্যাৎ আমাদের আলোচ্য মৃত্যুটি দূর্ঘটনাও নয় আবার অবহেলাজনিত মৃত্যুও নয়। তাহলে এ ধরণের মৃত্যু কি অপরাধমূলক নরহত্যা?

দণ্ডবিধির ২৯৯ এবং ৩০০ ধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে , যেহেতু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যক্তির মৃত্যু সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই অবগত থাকেন এবং কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটান, যা অবহেলাজনিত মৃত্যু নয় কিংবা দূর্ঘটনাও নয়। অতএব আমাদের আলোচ্য মৃত্যু ঘটানোর ঘটনাটি এক ধরণের অপরাধমূলক নরহত্যা।

অপরাধমূলক নরহত্যা তো বুঝলাম। এটি কি তাহলে খুন নাকি শুধুমাত্র অপরাধমূলক নরহত্যা?

Reg v. Govinda মামলার রায় পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, কোনো একটি অপরাধমূলক নরহত্যা খুন হবে নাকি শুধুমাত্র অপরাধমূলক নরহত্যা হবে তা নির্ভর করে, যে কাজের ফলে মৃত্যু সংঘটিত হয়েছে সেটির মৃত্যু ঘটানোর সম্ভাবনার মাত্রা এবং কাজটির সম্ভাব্য ঝুঁকির মাত্রার ওপর। কোনো কাজে যদি মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা এবং জীবনের ঝুঁকি বেশি থাকে, তাহলে সেটি খুন আর কম হলে শুধুমাত্র অপরাধমূলক নরহত্যা৷

আমাদের আলোচ্য মৃত্যুটিতে মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনার কিংবা জীবনের ঝুঁকির মাত্রার ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে এটি কখনো শুধুমাত্র অপরাধমূলক নরহত্যা হতে পারে আবার কখনো খুনও হতে পারে। এটি খুন নাকি শুধুমাত্র অপরাধমূলক নরহত্যা সেটি নির্ধারণের বিষয় একান্তই আদালতের। আদালত যদি মনে করেন যে, অরক্ষিত তার তো সবার বিপদ ডেকে আনছেনা এবং তার না ছোঁয়া পর্যন্ত এটিতো কাউকে আক্রমণ করেনা; তাই এটিতে মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা এবং জীবনের ঝুঁকি কম। তাহলে আদালত এটিকে শুধুমাত্র অপরাধমূলক নরহত্যা হিসেবে গণ্য করে ৩০৪ ধারায় শাস্তি দিতে পারেন যেখানে এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে ১০ বছরের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড কিংবা অর্থদণ্ড কিংবা উভয়ই।

আবার আদালত যদি মনে করেন যে এখানে মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক বেশি; ছোঁয়া লাগলেই শেষ, তার ছিঁড়ে গায়ে পড়লেই শেষ এবং এখানে মৃত্যুঝুঁকি বেশি। তাহলে আদালত এ ধরণের মৃত্যুকে খুন হিসেবে ধরতে পারেন এবং দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সাথে অর্থদণ্ড দিবেন।

এধরণের মৃত্যু ঘটানো খুন কিংবা শুধুমাত্র অপরাধমূলক নরহত্যা, সেটি প্রমাণ করলাম কিন্তু অপরাধীকে নিয়ে একটি বিপত্তি বাঁধতে পারে। বিপত্তিটা হচ্ছে, এক্ষেত্রে তাহলে অপরাধী কে? বিদ্যুৎ নিজে, বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষ নাকি কর্তৃপক্ষের হয়ে যারা কাজ করছেন তারা।

এর উত্তর দেওয়া সহজ নয়। কর্তৃপক্ষকে তো আর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায়না, আবার জেলেও রাখা যায়না। হ্যা, একটা উপায় আছে। কর্তৃপক্ষকে তো জরিমানা করা যায়। কিন্তু আমরা ৩০২ ধারা দেখলে দেখতে পাব যে, এখানে আদালতকে জরিমানার সাথে সাথে আবশ্যিকভাবেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে; যা কোনো কর্তৃপক্ষকে দেওয়া সম্ভব নয়।

এখনো বিপত্তির শেষ হয়নি। আমাদের মনে হতে পারে, আদালত এধরণের মৃত্যুকে খুন নয় এমন অপরাধমূলক নরহত্যা হিসেবে গণ্য করে কর্তৃপক্ষকে জরিমানা তো করতে পারে। হ্যা পারে, কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধবে যখন বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষ বা তৎসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান হবে। ভাবছেন এখানে বিপত্তির কী আছে? বিপত্তিটা হচ্ছে, ফৌজদারি মামলায় সবসময় প্রসিকিউশন হিসেবে থাকে সরকার। এক্ষেত্রে অভিযুক্তও সরকার। তাহলে মামলাটি সরকার বনাম সরকার মামলা হয়ে যাবে। এ-ও কী সম্ভব যে সরকার নিজেই নিজের বিরুদ্ধে মামলা চালাবে? হ্যা, চালানো সম্ভব। ভাবছেন কীভাবে? বাংলাদেশের আইনগত কাঠামোতে সরকার মামলার দুটো পক্ষই হতে পারেনা এরকম ধরাবাঁধা স্পষ্ট কোনো বিষয় আছে বলে আমি জানি না।তবে, আইনগত ব্যাপারে আমাদের আরো উদার হওয়ার ব্যাপক সুযোগ আছে। শুধু সুযোগ নয়, ভারতে ইতিমধ্যে একটি মামলাও আছে এরকম। Union Carbide Corporation v. Union of India and others মামলার দুপক্ষেই ছিলো সরকার। মামলাটি একটি শিল্প বিপর্যয় নিয়ে। একটি কোম্পানির একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক শেয়ারের মালিক ছিলো সরকার। একটি বিপর্যয়ে প্রায় লাখখানেক মানুষ মারা যায় এবং কোম্পানিটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ফলতঃ মামলার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয় সরকারের কাছে। কিন্তু, আদালতে মামলার Locus Standi নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় যে, সরকার একই সাথে মামলার বাদী এবং বিবাদী হতে পারে না কারণ কোম্পানীতে শেয়ার থাকায় সরকার বাদী এবং সরকারের কাছে ক্ষতিপূরন দাবী করায় সরকার বিবাদী। কোর্ট মামলাটিকে আমলে নিয়ে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলেন এ যুক্তিতে যে, সরকার একই সাথে বাদী ও বিবাদী হলেও, তার একই সাথে বাদী ও বিবাদী হওয়া অনিবার্য এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে এরকম মামলারও নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এক্ষেত্রে তো সরকারের ক্ষতিপূরণ সরকারের কাছেই থাকছে, লাভ কী? লাভটা হচ্ছে এর মাধ্যমে সরকারের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। অর্থ্যাৎ আমাদের প্রচলিত আইনেই কর্তৃপক্ষকে খুন নয় এমন অপরাধমূলক নরহত্যার জন্য শাস্তি দেওয়া সম্ভব।

এবার আসি কর্তৃপক্ষের হয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদেরকে দায়ী করা যায় কি-না? যদিও পর্দার আড়ালে তাঁরাই আসলে কর্তৃপক্ষের হয়ে কাজ করছেন কিন্তু কাজটা করছে কর্তৃপক্ষ, কোনো Natural Person নয়। উপরন্তু, ফৌজদারি আইনে Vicarious Liability বলে কিছু নেই যে, কর্তৃপক্ষের অপরাধের জন্য অন্য কোনো ব্যক্তিকে দায়ী করা যাবে। তবে আমাদের উচ্চ আদালত এখন কিছুকিছু ক্ষেত্রে উদার হয়ে ফৌজদারি আইনেও Vicarious Liability আরোপ করছেন। যেমন- ২০১৭ সালে উচ্চ আদালত Eusof babu and Ors v. State and Others মামলায় উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন এবং Artificial Person কে ফৌজদারি আইন মোতাবেক শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি এর পর্দার আড়ালে থাকা Natural Person কেও শাস্তি দেওয়ার নজীর সৃষ্টি করেছেন।

থাক সেসব কথা। বাস্তবতা হচ্ছে আমরা সাধারণ মানুষ এখনো ভাবতেই পারিনি যে এ ধরণের মৃত্যু খুন কিংবা খুন নয় এমন অপরাধমূলক নরহত্যা হতে পারে। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, আমরা যারা আইন অঙ্গনে আছি যেমন- বিচারক, আইনজীবী, ছাত্র, শিক্ষক, পুলিশ বাহিনী ইত্যাদি ইত্যাদি, তাঁরাও কিন্তু এ ধরণের মৃত্যুকে খুন বা খুন নয় এমন অপরাধমূলক নরহত্যা হিসেবে মেনে নিতে পারিনি। আমরা সয়ে গেছি। গতকাল Seven নামে একটা মুভি দেখলাম ওখানকার একটা Dialogue আমার মনে ধরেছে এবং প্রসঙ্গক্রমে আমাদের এ আলোচনার সাথে প্রাসঙ্গিক। Dialogue টা হচ্ছে, ”We see a deadly sin on every street corner in every home and we tolerate it. We tolerate it because it’s common. We tolerate it morning, noon and night.”

ফৌজদারি আইনের প্রতিকার ছাড়াও এ ধরণের মৃত্যুতে সংবিধানের ৪৪ এবং ১০২ অনুচ্ছেদ অনুসারে হাইকোর্টে রিট পিটিশনও ফাইল করা যায়। যা একই সঙ্গে টর্ট আইনকে বই থেকে বের করে এনে বাস্তবেও ঠাঁই দিবে৷ আনন্দের সংবাদ হচ্ছে, টর্ট আইনকে কেন্দ্র করে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যে কয়েকটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এবং সাম্প্রতিক হচ্ছে CCB Foundation v. Government of Bangladesh যা সাধারণ মানুষের মুখে জিহাদ হত্যা মামলা নামে পরিচিত। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে ২০১৪ সালে ঢাকার শাহজাহানপুরে শিশু জিহাদের পাইপে পড়ে মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা। সে হত্যার জন্য আদালত কিন্তু সাংবিধানিক টর্টের অধীনে, রিটের মাধ্যমে প্রতিকার দিয়েছিলেন।

যাহোক, আশার কথা দিয়ে শেষ করতে চাই। সরকার ২০০৯ সাল থেকেই Underground Wiring করার ব্যাপারে কথা বলে যাচ্ছে। জানিনা, কী কারণে এ প্রজেক্টটি পুরোদমে শুরু হচ্ছে না। ইতিমধ্যে চলতি বছরের শুরুর দিকে সিলেট শহরের কিছু এলাকায় Underground Wiring করা হয়েছে এবং ধীরে ধীরে হয়তো পুরো দেশই Underground Wiring এর আওতায় আসবে৷ কিন্তু সে পর্যন্ত তো আর আমরা মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে পারি না। Underground Wiring একটি বিরাট প্রজেক্ট যার সুবিধা পুরো দেশের সব জায়গায় পৌঁছা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই পুরো দেশ প্রজেক্টটির সুবিধার আওতায় না আসা পর্যন্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গা চিহ্নিত করে সেসব জায়গায় অপরিবাহী পদার্থ দ্বারা আবৃত তার দিতে হবে। তার ছিঁড়ে গেলে যাতে মানুষের সংস্পর্শে না আসে সে ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও মৃত্যু কাম্য নয়, কিন্তু কর্তৃপক্ষের অরক্ষিত তারের সংস্পর্শে এসে যদি কারো মৃত্যু হয়, তার দায়ভার কর্তৃপক্ষকে বা ক্ষেত্রভেদে সরকারকে নিতে হবে।

বিদ্যুৎ থেকে সাবধানে থাকুন, ভালো থাকুন।

লেখক: চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।