ভার্চ্যুয়াল কোর্ট
ভার্চ্যুয়াল কোর্ট

ভার্চ্যুয়াল কোর্ট: নিম্ন আদালতের বাস্তবতা ও কিছু সুপারিশ

আবু জাফর:

গত ৮ মার্চ দেশে সর্বপ্রথম নভেল করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের সরকারী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে গত ২৬ মার্চ থেকে দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। একইভাবে, সুপ্রীম কোর্ট ২৪/০৩/২০২০ইং তারিখের ১৯৪নং নোটিশমূলে ২৯/০৩/২০২০ইং তারিখ থেকে ০২/০৪/২০২০ইং তারিখ পর্যন্ত সকল আদালতের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। তৎপরবর্তীতে ১৯৭, ১৯৮, ১৯৯, ২০৩, ২০৯, ২১৯ নং নোটিশ মূলে বিগত ২৮/০৫/২০২০ পর্যন্ত সাধারণ ছুটি বর্ধিত করা হয়।

ন্যায়বিচার প্রদানের দায় থেকেই ইতিমধ্যে ভার্চ্যুয়াল আদালত চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত ৭ মে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গণভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠকে “আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০” এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। দুই দিন পর ৯ মে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ভার্চ্যুয়াল কোর্ট সম্পর্কিত অধ্যাদেশ জারি করা হলে ১০ মে শুধুমাত্র হাজতে থাকা আসামীদের জামিন শুনানীর জন্য বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের ২১১ নং নোটিশ মূলে ভার্চ্যুয়াল আদালতের সূচনা হয়।

পরবর্তীতে গত ৭ জুন সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক ৩নং নোটিশ মূলে রিমান্ড শুনানি ও বিশেষ কিছু দেওয়ানি, ফৌজদারি মামলা ও আপীল রুজু সংক্রান্তে প্র্যাকটিস নির্দেশনা প্রদান করা হয়, ৪ জুলাই শুধুমাত্র চীফ জুডিসিয়াল ও চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযুক্ত আসামীদের আত্মসমর্পণের জন্য প্র্যাকটিস ডিরেকশন ইস্যু করা হলেও অদ্যাবধি সাধারণ মামলা রুজুসহ বিচারের অন্যান্য কোন কার্যধারা ভার্চ্যুয়াল আদালতের এখতিয়ারে প্রদান করা হয় নাই। যার ফলে অসংখ্য বিচারপ্রার্থী মানুষ অবর্ণনীয় কষ্টের সম্মুখীন হচ্ছেন।

এটি নিরসনের লক্ষ্যে ২৩ জুন মহান জাতীয় সংসদে বা.জা.স.-১৫/২০২০ মূলে “আদালত কর্তৃক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার আইন” উত্থাপন করা হয় যা বর্তমানে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে টেকনিক্যাল মূল্যায়নের জন্য অপেক্ষামান। উক্ত আইনের মাধ্যমে ই-জুডিশিয়ারি বাস্তবায়ন হলে তা বিচারপ্রার্থীদের স্বল্প খরচে ও অল্প আয়াসে ন্যায় বিচার প্রাপ্তিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে আশাবাদী।

তবে পূর্ণাঙ্গরূপে ই-জুডিশিয়ারি বাস্তবায়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জনসচেতনতা তৈরী, স্টেকহোল্ডারদের প্রশিক্ষণ প্রদান করার মাধ্যমে সম্পূর্ণ নিরাপদ ও কার্যকর ভার্চ্যুয়াল আদালত প্রতিষ্ঠা সময়সাপেক্ষ বিষয়।

তাই, বর্তমানে চলমান ভার্চ্যুয়াল আদালতকে সর্বোচ্চ কার্যকর উপায়ে ব্যবহার করার কোন বিকল্প নেই। তবে, ইন্টারনেট প্যাকেজের উচ্চমূল্য, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় নিম্ন আদালতের ভার্চ্যুয়াল আদালত ব্যবস্থা শ্লথ হয়ে পড়েছে৷ উপরন্তু আদালতের অটোমেটেড রিপ্লাই সার্ভিস না থাকায় ইমেইল প্রদান করার পরও আইনজীবীদের শুনানির তারিখ ও অন্যান্য বিষয়ের জন্য অফলাইনে আদালত কর্মচারীদের সাথে যোগাযোগ করতে হচ্ছে৷ যা ভার্চ্যুয়াল আদালতকে প্রকারান্তরে ব্যর্থ করে দিচ্ছে৷

অতি স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ হিসেবে আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে দ্রুত সমন্বয় করে সুপ্রিম কোর্ট এর জন্য ডেডিকেটেড কেন্দ্রীয় সার্ভার স্থাপন করে এর অধীনে অধস্তন সকল ম্যাজিস্ট্রেসি ও জাজশিপের জন্য লোকাল সার্ভার স্থাপন করা প্রয়োজন৷

সুপ্রিম কোর্টের অধীনে থাকা অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনাল এর প্রকৃত সংখ্যা জানা না গেলেও তা ৩০০০ এর বেশি নয়। এই ৩০০০ আদালতের জন্য জিমেইল (gmail) ব্যবহারের পরিবর্তে নিজস্ব সার্ভারের অধীনে থাকা মেইল ব্যবহার করা উচিত। এতে অনলাইনে দাখিলকৃত দরখাস্ত ও আদেশসমূহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে এবং উর্ধতন আদালতের নথি তলবের আদেশ বাস্তবায়ন ও নথি ব্যবস্থাপনা সহজতর হবে৷ মোবাইল ইন্টারনেট সেবাদাতা ও আইএসপি প্রোভাইডারদের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান আইসিটি মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে সাথে নিয়ে বিচার বিভাগের স্টেকহোল্ডারদের তথা বিচারক, আইনজীবী, স্থানীয় থানা, হাসপাতাল, জেল কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য খুবই স্বল্পমূল্যে দ্রুতগতির ডেটা প্যাকেজ এর ব্যবস্থা করা গেলে ভার্চ্যুয়াল আদালত কাংখিত গতি ফিরে পাবে৷

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন এটুআই প্রকল্পের অধীনে মিটিং এপ্লিকেশন ডেভলপ করার সুযোগ রয়েছে৷ এর পাশাপাশি দরখাস্ত, আরজির স্ক্যানড কপির সহজ ডকুমেন্টেশনের জন্য বাংলা ভাষায় অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিডার এপ নির্মাণে শ্রম, সময় ও অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে ভার্চ্যুয়াল আদালত কার্যক্রমকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সময়ের দাবি।

আদালত ও আইনজীবীদের দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড বেশি এরকম স্থানে অফিস সময়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সাথে ইতিবাচক সমন্বয় জরুরি৷

এছাড়া, আদালত কর্তৃক প্রাপ্ত আইনজীবীদের দরখাস্ত সংবলিত মেইলগুলোর অটোমেশন খুবই জরুরি৷ ইমেইল পাওয়ার সাথে সাথে শুনানির তারিখ সংবলিত ফিরতি মেইল প্রদান করা না হলে দায়িত্বশীল কর্মচারীদের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির সুযোগ বেড়ে যায়৷ তাই, স্বচ্ছতার স্বার্থে ইমেইলে দরখাস্ত পাওয়ার সাথে সাথে ভার্চ্যুয়াল কেস নাম্বার বা ই-ডকেট নাম্বার প্রদান করা নিশ্চিত করতে হবে৷

ব্যস্ত আদালতগুলোতে স্থানীয় প্রশাসন, আইনজীবী সমিতির সহযোগিতায় বেশ কিছু ইন্টারনেট বুথ স্থাপন করে সেবা কার্যক্রমের গতি বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

সবার সহযোগিতায় করোনাকাল পেরিয়ে গেলেও যেন ন্যায়বিচার পৌঁছে দেয়ার এই উদ্যোগ যেন গতি না হারায় সেই প্রত্যাশাই থাকবে৷

আবু জাফর: আইনজীবী; বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ই-মেইল: mailatabuzafar@gmail.com