অ্যাডভোকেট

ডিগ্রী নিয়ে আইনজীবী হবার স্বপ্নপূরণের বদলে বিভিষীকাময় বাস্তবতার মুখোমুখি হয় শিক্ষানবিশরা

পার্থ প্রতিম বড়ুয়া সিংহ:

শিরোনাম পড়েই অনেকের হয়তো কৌতুহল তৈরী হতে পারে আসলে আমি কি বলতে চাই। মূলকথা শুরু করার আগে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ে কথা বলতে চাই। অনেক শিক্ষার্থী ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন থাকে সে বড় হয়ে আইনজীবী হবে। তার স্বপ্নের শুরু হয় তখন থেকেই যখন সে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে চান্স না পেলেও কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়। এরপর আইনে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী গ্রহণ করে বিশাল এক স্বপ্ন নিয়ে সে শিক্ষানবিশকাল শুরু করে। কিন্তু স্বপ্নপূরণের পরিবর্তে সম্ভবত অনেক শিক্ষানবিশ আইনজীবীর জীবনে চলে আসে বিভিষীকাময় কিছু বাস্তবতা।

বিচার বিভাগ আলাদা হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যার অন্যতম উদ্দেশ্যে হচ্ছে বিসিএসে যেমন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয় ঠিক তেমনি জুডিসিয়াল পরীক্ষার মাধ্যমে আলাদা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া যাতে বিচার বিভাগের মামলা ত্বরান্বিত হয় এবং মামলা জোট কমে যায়। যা ছিল বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় মাইলফলক। ফলশ্রুতিতে অনেক আইনের শিক্ষার্থীর স্বপ্নের পরিধি বাড়তে থাকে কেননা জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন প্রতিষ্ঠার কারণে একজন আইনের শিক্ষার্থীর শুধুমাত্র আইনজীবী নয় তার সাথে সাথে একজন জজ হওয়ার সুযোগ তৈরী হয়।

সম্ভবত ২০০৭ সালে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পরীক্ষার মাধ্যমে রেকর্ড ৪০০ জন সহকারী জজ নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে অনেক শিক্ষার্থীর মনে আইন বিষয়ে পড়াটা স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায়। এই সুযোগটা তখন লুফে নেয় ব্যবসায়িক স্বার্থে গড়ে উঠা কিছু বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। বিভিন্ন চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তারা ঢালাওভাবে আইন বিষয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো শুরু করে। মূলত তখন থেকেই পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।

এরপর থেকেই আইন বিষয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কিছু মানহীন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেখেলা শুরু করে যার বলী হতে হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের উচিত ছিল শুরু থেকেই সচেতন হওয়া। যদিওবা ২০১৩ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এসব মানহীন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে হার্ড লাইন ঘোষণা করে। বিভিন্ন মানহীন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগ নিষিদ্ধ করা হয় এবং ছাত্রছাত্রীদেরও আইন বিষয়ে পড়তে কিছু শর্ত আরোপ করা হয়।

এখন মূল প্রসঙ্গে আসা যাক, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৬০,০০০ সনদপ্রাপ্ত আইনজীবী রয়েছে। সনদের অপেক্ষায় রয়েছে আরও প্রায় ৭০,০০০ (ইতোমধ্যে আইনে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন তারাসহ) শিক্ষানবিশ আইনজীবী। সবাইকে ঢালাওভাবে সনদ দেওয়া সম্ভব কি না বা এত সংখ্যক আইনজীবী রাষ্ট্রের বিচার বিভাগের কোন কাজে আসবে কি না সে উত্তর আমার জানা নেই। সম্ভবত বার কাউন্সিলের জানা নেই। তবে আমি নিজেও যেহেতু একসময় শিক্ষানবিশ ছিলাম শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের কষ্ট আমি বুঝি। তাই প্রতিবছর বার কাউন্সিল পরীক্ষার মাধ্যমে মেধানুসারে সবাইকে সনদ দেওয়া উচিত অর্থাৎ যারা সত্যিকার অর্থে আইনজীবী হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে চায় তাদেরকেই সনদ দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। তাছাড়া পেশার মান অক্ষুণ্ণ রাখতে নন প্র্যাকটিশনার আইনজীবী যারা আছেন জরিপের মাধ্যমে তাদের সদস্যপদ বাতিল করা যায় কি না সেদিকে বার কাউন্সিল ভেবে দেখতে পারে।

অতি সাম্প্রতিক সময়ে যেসব শিক্ষানবিশ আইনজীবী বার কাউন্সিল প্রিলি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তারা বর্তমান পরিস্থিতির কারনে লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষা ছাড়া গেজেটের মাধ্যমে সনদ দাবী করছেন। আমার মনে হয় এটা আদৌ কখনোই সম্ভব নয়। কেননা সনদের বিষয়ে বার কাউন্সিলের কিছু রুলস রয়েছে যা বাতিল করে কখনো এভাবে ঢালাওভাবে সনদ দেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া এভাবে সনদ প্রদান করলে বার কাউন্সিল পূর্ববর্তী ব্যাচের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ এবং পরবর্তী ব্যাচের কাছে কঠিন দায়বদ্ধ থাকবে। এমতাবস্থায় বার কাউন্সিলের উচিত হবে লিখিত পরীক্ষার একটি সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করা এবং আগামী ৩/৪ মাসের মধ্যে ভাইবাসহ সমস্ত পদ্ধতি সম্পন্ন করা। তাছাড়া বর্তমান পরিস্থিতির জন্য কিছু মানহীন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কোনভাবেই দায় এড়াতে পারে না। বার কাউন্সিলের উচিত হবে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর আরও কঠিন শর্তসহ জরিমানা আরোপ করা এবং জরিমানার সম্পূর্ণ অর্থ শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের জন্য ব্যয় করা।

সর্বশেষ একটি কথা বলতে চাই, আমি নিজেও একসময় শিক্ষানবিশ ছিলাম। তাই শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের কষ্টগুলা আমিও অনুভব করি। নিজের অভিজ্ঞতা অনুসারে শিক্ষানবিশদের বলতে চাই, এ পেশায় টিকে থাকতে যেমন ধৈর্য্য সহকারে কঠিন পরিশ্রম করতে হবে ঠিক তেমনি পারিবারিক সমর্থনও থাকতে হবে। হয়তো অনেকের পরিবার অতটা আর্থিকভাবে সচ্ছল নয়। তাই তাদের প্রতি পরামর্শ থাকবে ল’ প্র্যাকটিসের পাশাপাশি ভিন্ন কিছু চিন্তা করা। নয়তো হতাশা প্রতিনিয়ত গ্রাস করবে।

পার্থ প্রতিম বড়ুয়া সিংহ: অ্যাডভোকেট; জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।