কে এম মাহ্ফুজুর রহমান মিশু

আমি শিক্ষানবিশ আইনজীবী বলছি

কে এম মাহ্ফুজুর রহমান মিশু:

হ্যাঁ, আমি শিক্ষানবিশ আইনজীবী বলছি। আজ সারাদেশে ৭০ হাজার ‘শিক্ষানবিশ আইনজীবী’ শব্দের জন্মের ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছি। সবেচেয়ে সম্মানীত ও রাজকীয় পেশায় নিয়োজিত এ পেশার মানুষদের উকিল, মুক্তার, আইনজীবী হিসেবে পরিচিত ছিল। হঠাৎ এই ‘শিক্ষানবীশ আইনজীবীর’ আমদানি হলো কোত্থকে? আইনে আদৌও এই পদবীর কোন স্বীকৃতি নেই। কোর্টের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে উপায়ান্ত না পেয়ে সান্তনা স্বরূপ নিজের নামের আগে ‘শিক্ষানবীশ আইনজীবী’ বসিয়ে নিয়েছি। আজও নিজেদের দাবি আদায়ে সুপ্রিম কোর্টের মত পবিত্র আঙ্গিনায় অনশন বসা হয়েছে। এটি জাতি হিসেবে লজ্জাজনক ব্যাপার। দোষটা তাহলে কোথায়? এর থেকে পরিত্রাণের উপায় বা কি?

The Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Order,1972 এর ৬০ ধারায় বলা হয়েছে সদ্য আইনের স্নাতক ডিগ্রিধারী ব্যক্তি আইন পেশা গ্রহণের জন্য ১০ বছর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বিজ্ঞ কোন আইনজীবীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে হবে। সাথে পাঁচটি দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলার অংশ নেওয়া ডায়েরী নোট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হবে।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো আইনী কাঠামোতে বার এনরোলমেন্ট না হওয়া পর্যন্ত কোর্টে আসতে বারণ। যেখানে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত সেখানে আমি একজন আইনের ক্ষুদ্র শিক্ষার্থী হয়ে শিক্ষানবিশ আইনজীবীর পরিচয় দেওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে একজন এলএলবি স্নাতক ডিগ্রিধারী ব্যক্তিকে যে কোন স্টেটে বার কাউন্সিলে ইন্টিমেশন জমা দেওয়ার ৩০ দিন পরই সে তার স্থানীয় জেলা কোর্টে এডভোকেট হিসেবে কাজ শুরু করতে পারবে যার মেয়াদকাল থাকবে ২ বছর। এটাকে পেশা প্রবেশের জন্য মহৎ উদ্যোগ বলে। ভারতে ২০১০ সালের আগে সরাসরিই আইনজীবী হতে কোন বাধা বিপত্তি ছিল না। আর আমার প্রিয় মাতৃভূমিতেও অনেকে পরীক্ষা ছাড়াই বিজ্ঞ আইনজীবীর কাতারে দাঁড়িয়েছেন। তাহলে আমরা কেন নই? আমরা তো জেনেছি প্রদীপের পাদদেশে থেকেই চোখ মুখ ফুটাতে হয়। কর্তৃপক্ষ সনদ দিলেই তো রাতারাতি নাম করা আইনজীবী হওয়া যাবে না। বাস্তবিক আইন পেশায় ভালো কিছু করতে বছরের পর বছর পড়াশুনা আর কেইস স্টাডি নিয়ে ধৈর্য্য ধরে এগুতো হয়।

বিগত ১৬ বছরের বার কাউন্সিলের আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরিক্রমায় দেখা যায়, গত ২০০৪ সালের ২৭ আগস্ট থেকে ২০১৫ পর্যন্ত মাত্র এক বছর ত্রুটিগত কারনে আইনজীবী অন্তর্ভুক্তি করতে পারেননি। তবে ২০০৬ সালে বছরে দুইবার অন্তর্ভুক্তিকরণ নজির হয়ে আছে। কিন্তু ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মাত্র একবার আইনজীবীর সনদ দেওয়া হয়েছে। তাহলে কিভাবে ব্যর্থতার এই বীজ রোপিত হলো। কারা, কি প্রয়োজনে এমন অদ্ভুত পদ্ধতি চালু করলেন? এতে কি ৭০ হাজার শিক্ষানবিশ অদৃশ্য শক্তির কাছে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে?

২০১৪ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল বনাম দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় মামলায় মাননীয় আপিল বিভাগ ২০১৭ সালে পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা করেন। মামলায় ১২ টি নির্দেশনার সর্বশেষ নির্দেশনা ছিল ‘The Bar Council shall complete the enrollment process of the applicants to be enrolled as Advocates in the district court each Calendar year’ সুতরাং প্রতি ক্যালেন্ডার ইয়ারে এনরোলমেন্ট পরীক্ষায় সম্পূর্ণ প্রসেস সম্পন্ন হবে এটিই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। এই দায় থেকে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা গ্রহণ করতে না পারলেও শিক্ষানবিশদের তোড়জোড়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক ধাপের পরীক্ষা সম্পন্ন করলেও অঘোষিত থেকে যায় লিখিত পরীক্ষার সিডিউল।

আইনজীবী একটি স্বাধীন কর্মমুখী পেশা। কিন্তু বার কাউন্সিল যদি এই পেশাকে বেকারত্বের কারখানায় পরিণত করেন সেটি আমাদের জন্য উদ্বেগজনক হতাশার ব্যাপার। সমগ্র বিশ্বে একই নিয়ম যে আইন বিষয়ে গ্রাজুয়েশন করার পর আইনজীবী হিসাবে কাজ করার অনুমতি দেওয়া বা সনদ দেওয়া। অনেকটাই ট্রেড লাইসেন্সের মত সরকারের ঘরে টাকা জমা দিয়ে আইনজীবী হিসাবে কাজ শুরু হয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদিও সেটি দুরূহ ব্যাপার। ব্যাঙের ছাতার মত গিজ গিজ করে গড়ে ওঠা আইন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ব্যাবসাধারীদের লাগাম টেনে না ধরে সেটি সম্ভব নয়। করোনাকালের মহাদুযোর্গময় সংকটকালীন সবারই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা শুরু হয়েছে। কবে নাগাদ স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসবে সেটা বলা সম্ভবপর নয়। সুতরাং যৌক্তিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বার কর্তৃপক্ষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যেভাবে ১৯৭২ সালে আপদকালীন সময়ে মুক্তারবৃন্দকে আইনজীবী হিসেবে যেভাবে উন্নতি করেছিলেন। এই মুজিব বর্ষে আপনারা তেমনটি করে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারেন। যদিও বর্তমান বারের কার্যক্রমে আশায় বুক বেধেছে। শিক্ষানবিশদের চলমান আন্দোলনকে সামনে রেখে বার কাউন্সিলের ভাইস-চেয়ারম্যান বিজ্ঞ আইনজীবী ইউসুফ হোসেন মহোদয়ের বিভিন্ন মিডিয়াতে দেওয়া সাক্ষাৎকার তেমনটিই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যদিও কিছু ক্রটিগত বিষয়েও বলা হয়েছে। ১২,৫০০ জন উর্ত্তীণ শিক্ষানবিশ পরিবারের সকলেই সেই সিদ্ধান্তের মুখপানে চেয়ে আছে।

তাছাড়াও The Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Order,1972 এর ২৭(১) (ডি) অনুচ্ছেদ মাফিক প্রাথমিক ধাপে উত্তীর্ণ ২০১৭ এবং ২০২০ সালের শিক্ষানবীশদের, আদেশ ৪০(১) ও ৪০(২)(এম) অনুযায়ী গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা সনদ প্রদান করতে আইনী কোন বাঁধা নিষেধ নেই। অর্ডার ৪০(১)-এ বলা হয়েছে ‘The Bar Council may, with the prior approval of the Government by notification in the official Gazette, make rules to carry out the purposes of this Order.’ অনুচ্ছেদ ৪০(২) (এম)-এ বলা হয়েছে ‘the examination to pass for admission as an advocate.’ অতএব এটি বার কাউন্সিলের সংরক্ষিত ক্ষমতা। শুধুমাত্র প্রনীত বিধিতে আইন মন্ত্রনালয়ের অনুমতি নিতে হবে। এটি আইন মন্ত্রনালয়ের রুটিন ওয়ার্ক। বার কাউন্সিল এ মর্মে রেজুলেশন গ্রহণ করে আইন মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়ে দিবেন, মন্ত্রনালয় সেটির অনুমোদন দিবেন, এটিই আইনের বিধান। এক্ষেত্রে কাউন্সিল তার প্রনীত বিধির ৬০(৩)-এর যেকোন জায়গায় সাপ্লিমেনটারি আইন সংযুক্ত করলে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের আইনজীবী হতে কোন আইনী বাধা থাকবেনা।

প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষার্থী এমসিকিউ পরীক্ষার প্রতিক্ষারত। সামগ্রিক বিচারে ২০১৭ ও ২০২০ সালে প্রাথমিক ধাপে উত্তীর্র্ণদের সনদ প্রদান অযৌক্তিক কিছু নয়। গত ২০১৮ সালের মে মাসের বার কাউন্সিলের নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃক প্রকাশিত ভোটার তালিকা অনুসারে আইনজীবীর সংখ্যা ৪৩,৮৮৪ জন। ২০১৮ সালের ২৩শে ডিসেম্বরে ৭,৭৩২ জন আইনজীবী তালিকাভুক্ত হয়। দুইটি সংখ্যা যোগ করলে হয় ৫১, ৬১৬ জন। এর মধ্যে অনেক বিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মৃত্যুবরণ করেছেন। আবার অনেকেই আইনজীবী পদবীটা নামের আগে পিছে লাগিয়ে রেখেছেন কিন্তু পেশার সাথে জড়িত নন। ১৮ কোটি জনসংখ্যার এই দেশের তুলনায় আইনজীবী অপ্রতুল। আমাদের প্রতিবেশী দেশের আইনজীবী সংখ্যা ১২ লাখ। প্রতি বছর পরীক্ষায় পাশের হার ৭০ শতাংশ। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বার কাউন্সিল বেশ কঠিনভাবেই আইনজীবী যাচাই-বাছাই করেন।

সামগ্রিক পরিস্থিতির ইতিহাস বিবেচনায় এই আলোকিত পেশার দাফন সম্পন্ন করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান। একবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে এসে শিক্ষানবিশদের মহা দুর্যোগে না রেখে সামনের দিগন্ত প্রসারিত করতে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের মহান ও কার্যকরী পদক্ষেপের প্রতীক্ষায় আমরা শিক্ষানবীশ আইনজীবীরা।

কে এম মাহ্ফুজুর রহমান মিশু: কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।