মোহাম্মদ রেজাউল করিম সিদ্দিকী: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গণে ‘পরিবেশ কমিটি’ চাই

মোহাম্মদ রেজাউল করিম সিদ্দিকী: বার কাউন্সিলে নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় তালিকাভুক্ত হবার পরেই কেবল একজনকে আইনজীবী বলা যায়। তাহলে তালিকাভুক্তির পূর্বেই “শিক্ষানবীশ আইনজীবী” কিভাবে বলা সম্ভব? মনে রাখবেন, আপনি যদি কোনো কবিরাজকে “ডাক্তার” সম্বোধন করেন তাহলে তার মনে ডাক্তার হিসেবেই পরিচিত হবার এবং ডাক্তারের সমকক্ষ হিসেবে মর্যাদা লাভের অধিকার জন্মে যায়! আপনি যদি তাকে ডাক্তার হিসেবে কখনো গ্রাহ্য করতে না চান, তাহলে নিশ্চিত সে মর্মাহত হবে, এবং ক্ষেত্রবিশেষে সে শক্তি প্রয়োগ করে আপনাকে আপনার অভ্যাসে ফিরে যেতে বাধ্যও করতে পারে!

ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা কখনো ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে গিয়ে নিজেদের নামের আগে “প্রকৌশলী” লিখবার অনুমোদন চাইতে আন্দোলন করেছে? মেডিকেল কাউন্সিলে নিবন্ধিত হবার আগেই কেউ নিজের নামের আগে ডাঃ লিখবার অধিকার আদায়ে আন্দোলন করেছে? তাহলে কিন্ডারগার্টেনের মতো গজিয়ে উঠা শত শত আইন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার আইনের ছাত্র কেবল আইন পড়ার কারণেই “আইনজীবী” হবার আবদার করতে পারে?

অনেকেই বার কাউন্সিলের উপর দোষ চাপিয়ে উচ্ছৃঙ্খল আইন শিক্ষানবীশদের পক্ষাবলম্বন করে তাদের অযৌক্তিক দাবিকে ইনিয়ে বিনিয়ে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করছেন। বার কাউন্সিল না-কি পরীক্ষা নিতে বিলম্ব করছে! যদি বার কাউন্সিল পরীক্ষা নিতে বিলম্ব করে থাকে তাহলে আন্দোলনটা সুস্পষ্টভাবে পরীক্ষা গ্রহণের দাবিতেই হতে পারে, আইনজীবী হিসেবে অনুমোদন লাভের জন্য কেনো? যারা এই বিষয়ে সজ্ঞানে বা অসচেতনভাবে রাজনীতি করছেন বা করতে চাইছেন তারা অনুগ্রহ করে এটি করবেন না। মনে রাখা উচিৎ, যে ডালে বসেছেন সেই ডালটি কেটে ফেলতে সহযোগিতা করলে ভিক্টিম আপনিই হবেন। আমরাই ভিকটিম হবো।

যেই এলএল.বি (সম্মান) শেষ হবার কথা ২০০৩ এ সেটা সেশন জ্যামের কারণে শেষ হলো ২০০৫-এ এবং আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হলাম ২০০৭-এ! তাহলে অনার্স শেষ হবার আগেই ২০০৩-এ বার কাউন্সিল আমাদের তালিকাভূক্তির পরীক্ষা না নিয়ে ভীষণ ক্ষতি করে দিয়েছে? ক্ষতি আমাদের অবশ্যই হয়েছে। বাবা-মা’র অধিক টাকা বাড়তি চার বছরে বেশি ব্যয় হয়েছে। কিন্তু সেটা ঘটেছে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে। কেবল আমাদের সাথেই ঘটেনি, সবার সাথে ঘটেছে! আন্দোলনরত ছেলেমেয়েগুলোর ক্ষতিও নিশ্চয়ই হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে ভ্রূণ হিসেবে গঠিত হবার আগেই আইনজীবী হিসেবে ভূমিষ্ঠ হবার আবদার করতে হবে?

আমাদের মনে রাখা উচিৎ, আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তি শুধু উপার্জনের মাধ্যম নয়। এর সাথে জড়িত মানুষের সহজাত জন্মগত অধিকার, গণমানুষের ন্যায়বিচার লাভের অধিকার। সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য আইনজীবীর ভূমিকা সর্বাগ্রে! তাহলে যেনতেনভাবে আইনজীবী হয়ে যাওয়ার পথ উম্মুক্ত হলে জাতির কি অবস্থা হতে পারে?

কয়েকদিন যাবৎ খুব ব্যথীত মনে লক্ষ্য করছি কিছু উচ্ছৃঙ্খল তরুণ আইনের ছাত্র আইনজীবী হিসেবে শর্টকাট পথে সনদ লাভের জন্য বেপরোয়া আচরণ করছেন। তারা সিনিয়র আইনজীবীবৃন্দের সাথেও বেআদবি করেছেন বলে শুনেছি। এহেন আচরণের দায়ে তাদের আইনজীবী হবার ক্ষেত্রে আজীবনের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা সমীচীন।

সাম্প্রতিক ঘটনায় আমি মনেকরি ইতোমধ্যে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত আইনজীবীগণের জন্যও একটা আচরণ বিধি বার এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে অনুসরণ করা দরকার। অনেকে হয়তো একমত হবেন না, তবে আমার কাছে সুপ্রীমকোর্ট বার আইনজীবী সমিতির বিগত নির্বাচনগুলোর সময় মনে হয়েছে কোনো কারখানার সিবিএ নির্বাচন হচ্ছে! ভোটার ও প্রার্থী গড়পড়তা সকলের আচরনেই কেমন একটা অস্বাস্থ্যকর, অপ্রীতিকর অবস্থা লক্ষ্য করেছি। কারো আচরনে মনে হয়নি এমন একটা নির্বাচন ওখানে হচ্ছে যেখানে সকল ভোটার উচ্চশিক্ষিত, প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, এমন কি অধিকাংশ ভোটার প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক পদ “বিচারপতি” হিসেবে নিযুক্ত হবার যোগ্যতা রাখেন! ব্রেকআপ পার্টির দিনে মনে হয়েছে কোন গন্যমান্য ব্যক্তির চেহলাম হচ্ছে- যেখানে দুস্থ ও অভুক্ত মানুষরা আমন্ত্রিত হয়েছেন! চারদিকে ভোটের কাগজ, ব্যানারের ছড়াছড়ি! মুহুর্মূহু উচ্চস্বরে মিছিল! অথচ এই নির্বাচন হবার কথা ছিল নিঃশব্দে, শব্দ ও পরিবেশ দূষণ না করেই!

যখন বারের সদস্য ও নেতৃবৃন্দের আচরণ ঐ পর্যায়ে চলে যায় তখন বাহিরের মানুষরা আমাদের “উচ্চমার্গের” ব্যক্তি হিসেবে সম্মান না করারই কথা! আইনজীবী সমিতিকেই দেখতে হবে আইনাঙ্গনে সুস্থ পরিবেশ বিরাজ করছে কি-না?

সুপ্রীমকোর্টে বহিরাগত নবীশগুলো কিভাবে অবস্থান করে? এটাকে প্রশ্রয় দিলে অন্যান্য শ্রেণীগোষ্ঠীর সবাই যদি সুপ্রীম প্রাঙ্গণকে কথীত ন্যায়বিচার লাভের আন্দোলনের ময়দানে পরিণত করে বা করতে চায় তার দায় কে নেবে? রিক্সাশ্রমিক ইউনিয়নের মামলায় কয়েক লক্ষ রিক্সাশ্রমিক সুপীম কোর্টে প্রভাব বিস্তারারে জন্য প্রেসক্লাবে না দাঁড়িয়ে এজলাসের সামনে অবস্থান নিতে চাইলে সেটিকেও যৌক্তিক মনে করবেন?

সুপ্রীম কোর্টের নিরাপত্তা ও আইনজীবীবৃন্দের সম্মান সুরক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে অবিলম্বে উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষানবীশদের অপকর্মের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি জানাই। ভবিষ্যতে অনাকাঙখীত ঘটনা এঁড়াতে এবং সুপ্রীমকোর্টের মর্যাদা অটুট রাখতে প্রয়োজনে কোর্টপ্রাঙ্গনে “পরিবেশ কমিটি” গঠন করে একটি অবশ্যপালনীয় প্রটোকল তৈরী করা হোক।

সেই সাথে বার কাউন্সিলের পক্ষ থেকে শিক্ষানবীশদের যথাযথ পদ্ধতিতে তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে সাপ্তাহিক ব্রিফিং দাবি করছি।

মোহাম্মদ রেজাউল করিম সিদ্দিকী: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।