অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

বিচারক ও আইনজীবী: তুলনামূলক আলোচনা (শেষ পর্ব)

সিরাজ প্রামাণিক:

বিচারক ও আইনজীবীদের সমন্বয়েই বিচারব্যবস্থা। মানুষ যেহেতু অপরাধপ্রবণ প্রাণী, তাই বিচারব্যবস্থা মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। মানবজ্ঞানের অর্থাৎ দর্শন-বিজ্ঞানের সূচনালগ্নেই ন্যায়বিচারের প্রসঙ্গটি মানুষের মাথায় এসেছিল। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকেরা ন্যায়-অন্যায় ও ন্যায়বিচার নিয়ে আলোচনা করেছেন। আধুনিক রাজনৈতিক দর্শনে ন্যায়বিচারের প্রসঙ্গটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমার চেয়ে বেশি জানেন আমাদের সিনিয়র বিজ্ঞ আইনজীবীরা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি বিচারব্যবস্থাই চালু থাকে। এখনো আছে। আইনকানুন সব ইংরেজ আমলের, তবে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে যুগের প্রয়োজনে নতুন আইন। কিন্তু পদ্ধটিটি ব্রিটিশ। কেউ মামলায় জড়ালে সে হবে ফতুর এবং ভারী হবে উকিলের পকেট। কোনো কোনো বিচারকের অবিচারকসুলভ আচরণ ও অসাধুতার কথাও আমরা জেনে আসছি। কোনো মানুষই ফেরেশতা নয়, বিচারকও মানুষ। সময়ের হাওয়া যেকোনো পদের মানুষের গায়েও লাগা সম্ভব। যেমন চাণক্য ২০০০ বছর আগে বলেছেন, “জিহবার ডগায় বিষ বা মধু থাকলে তা না চেটে থাকা যেমন অবাস্তব তেমনি অসম্ভব হলো সরকারের তহবিল নিয়ে লেনদেন করে একটুকুও সরকারের সম্পদ চেখে না দেখা”। কিংবা, “জলে বিচরণরত মাছ কখন জল পান করে তা জানা যেমন অসম্ভব তেমনি নির্ণয় সম্ভব নয় কখন দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী তহবিল তছরুপ করে”।

বাংলাদেশ আজ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মামলা-মোকদ্দমার দেশ। ভারতে আদালত ও বিচারকদের মধ্যে প্রাণবন্ত বিতর্ক হয়ে থাকে। প্রধান বিচারপতি থেকে আইন বিশেষজ্ঞগণ তাতে অংশ নেন। ভারতে হাইকোর্টের কোনো কোনো বিচারক অপরাধ করে বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন এবং চাকরি খুইয়েছেন।

কোন মূল মোকদ্দমার বিচার কার্য অথবা কোন আপিলের শুনানিকালে মোয়াক্কেলের নিয়োজিত আইনজীবী অধিকার কোনমতেই লঙ্ঘন করা যাবে না। কারণ এটা প্রাকৃতিক বিচারের নীতিমালার একটি সার্বজনীন বিধান যা অস্বীকার করলে প্রদত্ত রায়টি অকার্যকর হয়ে যাবে। (৬ ডিএলআর ৬৫)

কোন মক্কেলের পক্ষে ন্যায়বিচার না পাওয়ার ব্যাপারে আদালতের ওপর আস্থা হারানোর প্রেক্ষাপট তুলে ধরার অধিকার তার নিযুক্তীয় আইনজীবীর রয়েছে। (M.H. Khondoker V. State (1960) D.L.R. (SC) 124)

মোকদ্দমার কোন পক্ষ অপর পক্ষের আইনজীবীর প্রতি হুমকি প্রদর্শন করলে আদালত অবমাননা হবে; কারণ এটা বিচার কার্যে বাধার শামিল। (State V. Abdul Aziz P.L.D (1962) Lahore, 335)

পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে আইনজীবীকে দায়ী/অভিযুক্ত করা যায় না: 13BLD (AD) 152

একজন আইন উপদেষ্টা তার আইনগত অভিমতের জন্য দায়ী নহেন। (BLC (1996) page 63)

আইনজীবী কর্তৃক মামলা পরিচালনারত অবস্থায় পুলিশ অফিসার কর্তৃক ইশারা দিয়ে ডেকে নিয়ে তাকে গ্রেফতার করা এবং হ্যান্ডকাপ দিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া গুরুতর অবমাননা। (রাজশাহী বার কাউন্সিল-বনাম-নাথুরাম, এ, আই, আর ১৯৫৬ রাজ: ১৭৯ (১৮৪): আই, এল,আর (১৯৬৬) ৬ রাজ: ৯৬৪, ১৯৫৬ সিআর,এল, জে ১৩৫০ (বিডি)।

উদ্দেশ্যমূলকভাবে এবং বিচারকার্যে বাধা সৃষ্টির বা অন্য কোন অসৎ উদ্দেশ্যে মামলা দায়ের করার জন্য হাইকোর্টে উপস্থিত হওয়ার জন্য যাওয়ার সময় পুলিশ অফিসার কর্তৃক আইনজীবীকে গ্রেফতার করলে তা আদালত অবমাননার অপরাধ। শুধুমাত্র ভুলবশত এবং সততাপরায়ণ গ্রেফতার অবমাননা হবে না। (Home Rustomji V. Sub-Inspector Baig, AIR 1944 Lah 196 (199-200) 46 cr.LJI (S.B)

‘আদালত’ বলতে বিচারস্থলের সকল অংশসহ আদালতের অফিসার, কর্মচারী ও সাক্ষীদের ব্যবহৃত স্থানকেও বোঝায়। অর্থাৎ যখন কোন আইনজীবী আদালতে কোন মামলায় উপস্থিত হওয়ার জন্য অগ্রসর হন তখন যদি তাকে গ্রেফতার করা হয় তখন আদালতের স্বাভাবিক গতিকে হস্তক্ষেপের শামিল বিধায় তা আদালত অবমাননা হবে। এছাড়া যথার্থ কারণে আইনজীবীকে গ্রেফতার করা আদালত অবমাননা হবে না। তাছাড়া আইনজীবীর চেম্বার আদালতের অংশ বিশেষ হিসেবে বিবেচিত হয়।

আরও পড়ুন: বিচারক ও আইনজীবী: তুলনামূলক আলোচনা (পর্ব-০২)

একজন আইনজীবী প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় নিজ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে উল্লেখিত আইননানুগ সুযোগ-সুবিধা বা বিশেষ অধিকার ভোগ করেন সত্য কিন্তু যদি ওইসব সুযোগ-সুবিধা সদ্ব্যবহার না করে তিনি মক্কেলের পক্ষে আদালতে এমন সব যুক্তিতর্কের অবতারণা করেন, যার মধ্যে আদালতের মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত হয়ে পড়ে, তাহলে অবশ্যই তাকে ততখানি অধিকার প্রদান করা চলে না।

আইনজীবীদের থেকে উচ্চাদালতে অধিকাংশ বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়। যত বড় জঘন্য অপরাধেরই হোক না কেন বিচার প্রক্রিয়া খুবই নিরাবেগ ব্যাপার। জাজমেন্ট বিষয়টিই হলো সত্য অনুসন্ধান করা, সেটা করতে হয় বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী ধারণার তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে। আদালতের দেওয়া রায়কে অত্যন্ত সংগত কারণ ছাড়া নাকচ করে দেওয়া অর্থাৎ শাস্তিপ্রাপ্ত দোষীকে ক্ষমা করা কি বিচারব্যবস্থার অবমাননা নয়? স্বজনপ্রীতি জিনিসটি খুবই নিন্দনীয়। এবং স্বজনপ্রীতিরও একটি স্তর থাকে। সেই স্তর অতিক্রম বাঞ্ছনীয় নয়। আমরা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা অনর্গল বলি। সে চেতনা হলো আত্মসম্মানবোধ, আত্মনিভর্রশীলতা, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার। একটি উন্নত জাতি হিসেবে যদি আমরা পৃথিবীর মানুষের কাছে পরিচিত হতে চাই তাহলে বিচারব্যবস্থাকে বিতর্কিত করা চলবে না।

সিরাজ প্রামাণিক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com

আরও পড়ুন: বিচারক ও আইনজীবী: তুলনামূলক আলোচনা (পর্ব- ০১)