রাম কেশব দাস

অন্য এক আইনজীবীর সনদ দাখিল করে দু’বছর ধরে আইনপেশায় টাউট রাম কেশব

নিজের নাম পরিচয় গোপন করে অন্য এক আইনজীবীর সনদ দাখিল করে গত দুই বছর যাবত কুমিল্লা ও ঢাকায় আইনপেশা চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে রাম কেশব দাস নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। কুমিল্লা বারে কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির তরুণ আইনজীবী সাগর ঘোষের সনদ দাখিল করে প্রতারণা করেন রাম কেশব দাস। তার দুটি বিজনেস কার্ডে রয়েছে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টসহ চারটি চেম্বারের ঠিকানা।

ধর্ষণের একটি মামলার সূত্র ধরে তার প্রতারণার বিষয়টি সিআইডি’র নজরে আসে। এরপর গত এক মাস ধরে হদিস মিলছে না ওই ভুয়া আইনজীবীর। এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য জানাজানি হলে আদালত অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়। ঘটনাটি ভাইরাল হয় ফেসবুকেও। খোদ আদালত অঙ্গণে প্রতারণার এমন ঘটনায় বিষ্মিত কুমিল্লার আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টরা এর কঠোর বিচার দাবি করেছেন।

রাম কেশব দাস কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার দাসপাড়া গ্রামের অনিল চন্দ্র দাস ও সন্ধ্যা রানী দাস দম্পতির ছেলে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘সাগর ঘোষ কেশব’ পরিচয়ে ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা জেলা আইনজীবী সমিতিতে যোগ দেন রাম কেশব দাস। ‘সাগর ঘোষ কেশব’ নামে সদস্যপদ নেওয়ার পর থেকেই তিনি নিয়মিত বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনা করে আসছিলেন। এসময়ে সমিতি থেকে বিভিন্ন ভাতাও পেয়েছেন। সমিতির নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। প্রকৃত সনদ না থাকলেও গত দুই বছর ধরে বীরদর্পে চালিয়েছেন আইন পেশা।

গত বছরের ৬ নভেম্বর আসামিপক্ষের যোগসাজশে ধর্ষণের একটি মামলায় কুমিল্লা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালত-১ এ ভুয়া বাদি সাজিয়ে হাসিনা আক্তার নামে অন্য এক আইনজীবীর নাম ব্যবহার করে ধার্য তারিখের আগে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন ওই ভুয়া আইনজীবী। এতে মামলাটি নিষ্পত্তি হয়ে যায়।

পরে বাদিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট নূর মোহাম্মদ বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে সংশ্লিষ্ট আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন। এরপর চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি আদালতের বিচারক এম.এ আউয়াল বিষয়টি তদন্তপূর্বক ১৫ মার্চের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন।

এ ঘটনায় আদালত অঙ্গনে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয় এবং সাগর ঘোষ কেশব পরিচয়ের ওই আইনজীবীর নাম প্রকাশ পেয়ে যায়। পরে এ ঘটনায় কথিত আইনজীবী সাগর ঘোষ কেশব আদালতে ৫০ টাকার স্ট্যাম্পে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থণা করেন। এদিকে আদালতের নির্দেশে তদন্ত চালিয়ে যায় সিআইডি।

তদন্তকারী কর্মকর্তা ও কুমিল্লা সিআইডি পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম জানান, তদন্তে তার দুটি ঠিকানা ভুয়া পাওয়া যায়। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক। গত ৫-৬ বছর আগে কিশোরগঞ্জ সদরের খড়মপট্টি এলাকার এক বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে তিনি বসবাস করতেন। পরে নাম-পরিচয় গোপন করে কুমিল্লায় সাগর ঘোষ কেশব নামে আইনজীবী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। প্রকৃতপক্ষে সাগর ঘোষ নামে কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতিতে একজন আইনজীবী রয়েছেন।

তদন্তের বিষয়টি টের পেয়ে চেম্বার ও ভাড়া বাসা ছেড়ে পালিয়েছেন ভুয়া ওই আইনজীবী। এদিকে তার দুটি বিজনেস কার্ডে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এনেক্স বিল্ডিং হল রুম-১৬ এবং কুমিল্লার তিনটি নিয়ে চারটি চেম্বারের ঠিকানা রয়েছে। অপর তিনটি ঠিকানা হচ্ছে- আদালত প্রাঙ্গণে জেলা আইনজীবী সমিতি ভবনের ৩নং হল রুম, কোতয়ালী জি.আর অফিস কক্ষের সামনে কাশেম ভেন্ডার ও কোতয়ালী মডেল থানার সামনে মেসার্স সাঈদ এন্টারপ্রাইজ।

কিশোরগঞ্জের প্রকৃত আইনজীবী সাগর ঘোষ জানান, একটি মামলার তদন্তে যাচাইকালে আমার নাম ব্যবহারের বিষয়টি আমি জানতে পেরেছি। কুমিল্লা বারে তৎকালীন সময়ে যারা নেতৃত্বে এবং দায়িত্বে ছিলেন, তাদের যোগসাজশে হয়তো এ ঘটনা ঘটেছে। এটা কুমিল্লা বারের তৎকালীন নেতৃত্বের ব্যর্থতা।

কুমিল্লা আইনজীবী সমিতির তৎকালীন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট গোলাম মোস্তফা বলেন, প্রত্যেকটা কাগজ নিখুঁতভাবে যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এ ঘটনায় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমারও দায় আছে। কিন্তু বিচারালয়ের একজন আইনজীবী পরিচয়ে এমন কাজ কেউ করতে পারে- আমরা তা ভাবিনি। অতীতে কোনো আইনজীবী এমন কাজ করেনি। সে বার কাউন্সিল থেকে চিঠিসহ কাগজপত্র নিয়ে এসেছে, তাই বিশ্বাস থেকেই তাকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল। আমরা যদি তাৎক্ষণিক যাচাই করতাম, তাহলে এমন ভুল হতো না।’

কুমিল্লা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. সামছুর রহমান ফারুক বলেন, বিষয়টি নিয়ে বেশ নাড়া পড়েছে। এ ধরণের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, এজন্য আমরা সতর্ক থাকবো। ঘটনাটি তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে জানার জন্য ভুয়া আইনজীবী রাম কেশব দাসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার চেম্বার ও মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় বক্তব্য জানা যায়নি।