ড. এম শাহ আলম: আমার আইন আকাশের এক ধ্রুবতারা

আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী:

আন্তর্জাতিক আইনের ক্লাস। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামক দানবীয় কনসেপ্টের জন্মের শুরুর দিকের ঘটনা। আমেরিকা এই মূল মন্ত্রে আফগানিস্তান আক্রমন করলো। এরপর বুশ ডকট্রিনের অজুহাতে ইরাক আক্রান্ত হলো। ৯/১১ এর পরবর্তী সময়ের কথা। ক্লাস সরগরম। তারুন্যের আইনী ও আবেগী তর্ক- বিতর্কে শিক্ষক বিমোহিত। আবার নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে তিনি ক্লান্ত। একসময় ছাত্ররা রেগে স্যারকে জিজ্ঞাসা করলেন, জাতিসংঘের প্রয়োজনীয়তা কি? এই অন্যায়, অনৈতিক যুদ্ধ থামানোর ব্যর্থতায় জাতিসংঘকে বিলুপ্ত করে দেয়া উচিত কিনা? শিক্ষক প্রতি উত্তরে বললেন, কোন্ Standard বা নীতিমালায় এটি অন্যায্য যুদ্ধ? এটি যে অন্যায় আক্রমণ তা কিভাবে নির্ধারণ করা হলো? ছাত্ররা মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। অবাক হল, উত্তর দিতে ব্যর্থ হলো। শিক্ষক উত্তর দিলেন, এই Standard বা নীতিমালা জানার জন্যই জাতিসংঘ বা তার চার্টারের প্রয়োজন আছে। এই কারনেই আমরা পার্থক্য করতে পারছি কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়। জাতিসংঘ না থাকলে এটা কি করে সম্ভব হতো? আন্তর্জাতিক আইনে এটিও একটা বড় অর্জন। এই দর্শন উপস্থিত শিক্ষার্থীদের খুব পছন্দ হলো। সৌভাগ্যক্রমে আমি ছাত্র হিসেবে ঐ ক্লাসে ছিলাম, আর এই শিক্ষক ছিলেন চির আশাবাদী মনের এক কিংবদন্তী শিক্ষাগুরু, আইন জগতের প্রানপুরুষ প্রফেসর ডঃ এম শাহ আলম স্যার।

২০১২ সালের ১৪ মার্চ জার্মানির সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে (ITLOS জার্মানির হামবুর্গ) বাংলাদেশের ১ম সমুদ্র জয় হয় মিয়ানমারের সাথে, নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিসি আদালত (পার্মানেন্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশন-পিসিএ) এ ৭ জুলাই, ২০১৪ বাংলাদেশের ২য় জয় হয় ভারতের সাথে। শাহ আলম স্যার আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনে পিএইচডি করেছিলেন। এই জয়ে স্যার ছিলেন খুবই উচ্ছসিত। মায়ানমারের বিরুদ্ধে জয়ের পর আইন কমিশনের তৎকালীন সদস্য এম শাহ আলম স্যারের ইচ্ছে হলো এই অর্জনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে তিনি একবেলা আপ্যায়ন করবেন। উদার মনের সম্পদের প্রতি নির্মোহ এই মানুষটির ব্যাংক একাউন্টে কখনোই খুব বেশি টাকা জমা থাকেনা। একাউন্ট ঘেঁটে সেসময় যা পাওয়া গেল তার সবটুকুই তিনি খরচ করলেন একটি পাঁচ তারকা হোটেলে এই আয়োজনের জন্য। বুকে নিখাঁদ দেশপ্রেম এবং এই মাটির জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ছিলো বলেই নিজের সব টাকা উজাড় করে দিয়ে দেশের এই যোদ্ধাদের তিনি সম্মানিত করতে চেয়েছিলেন।

সেই ২০০৪ সালের কথা। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ষষ্ঠ ব্যাচের মাস্টার্সের কয়েকজন শিক্ষার্থী মানবাধিকার আইনের Research Monograph উপলক্ষে মঙ্গাপীড়িত জেলা কুড়িগ্রাম যাবে। সৌজন্য বশতঃ প্রফেসর শাহ আলম স্যারের সাথে দেখা করতে গেল। স্যার বললেন, যাওয়ার মূহুর্তে বা তার কিছু আগে তাঁর সাথে আবার দেখা করার জন্য। শিক্ষার্থীরা সেই অনুযায়ী দেখা করতে গিয়ে দেখলেন, স্যার এক পুটলা জামা কাপড় নিয়ে অপেক্ষা করে আছেন। ছাত্রদের এই জামাগুলো হস্তান্তর করে স্যার বললেন, তাঁর এই কাপড়গুলো যেন গরীব মঙ্গাপীড়িত এলাকায় বন্টন করা হয়। এই প্যাকেটের অধিকাংশ কাপড়ই ছিল নতুন ও ব্যবহার উপযোগী।

ডঃ শাহ আলম স্যার গড়নে হয়তো অত সুপুরুষ ছিলেননা, ছোটখাটো একজন মানুষ। কি অবলীলায় তিনি ধীরে ধীরে একটা সাম্রাজ্য জয় করলেন, যারা তাঁর সংস্পর্শে এসেছে তাদের হৃদয়ে তিনি নাড়া দিয়েছেন, হোকনা সে শিক্ষক বা ছাত্র, আইনবিদ বা জ্ঞানতাপস।

আমরা যখন চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলাম তিনি তখন আইন ফ্যাকাল্টির ডিন ছিলেন, অনেক দিন তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন। সময় যায়, ডিন বদলায়। কিন্তু শাহ আলম স্যার আমাদের বা আমাদের পূর্ববর্তী বা কতেক পরবর্তীদের জন্য আজীবন ডীন হয়ে থাকলেন। আমাদের কাছে শাহ আলম স্যারের অপর পরিচয় হয়ে উঠলো ডিন স্যার।

শিক্ষা মানুষকে বিনয় শেখায়, শেখায় ভদ্রতা। স্যারের বিনয় ও ভদ্রতা যেন সহজাত। ছাত্রদের তিনি শুধু আইনই শিখাননি, শিখিয়েছেন মানবিকতা- মানবিক মর্যাদা । কত ছাত্র তাদের কঠিন মূহুর্তগুলোতে স্যারের মানবিক স্পর্শ পেয়েছে তা তুলনাহীন। কেউ ক্লাসে কোন খারাপ প্রশ্ন করলে তিনি কখনো বলেননি এটি ভুল বরং ভাল প্রশ্ন বলে উৎসাহ দিয়েছেন। এখন মাঝে মধ্যে আমরা শুনি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাস নেননা। আমরা জুরিসপ্রুডেন্স ও আন্তর্জাতিক আইনের ক্লাসে স্যারকে পেয়েছিলাম। তিনি ক্লাস নেননি বা ক্লাসে দেরী করে এসেছেন এমন ঘটনা আমার মনে পড়েনা। Law Family, Social Engineer এই শব্দগুলো স্যার বার বার বলতেন। লেকচারে সবসময় ঘুরে ফিরে স্যারের নিজস্ব দর্শন ‘সাধারন সম্মতি তত্ত্বের ‘ (Common Consent Theory) বিষয় আসতো। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মেনে নিলে আইনের বৈধতা চলে আসে, আইন বাধ্যকরী হয়- এটাই ছিল স্যারের ব্যাখ্যা। একবার মনে হয় তিনি চাকুরে ছিলেননা, শিক্ষক ছিলেন। আবার মনে হয় তিনি শিক্ষকের বাইরে ছাত্রদের কাছে অন্য পরিচয়ে ছিলেন, সবার অভিভাবক ছিলেন, দল মতের উর্ধ্বে ছিলেন, সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিলেন।

এই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা। ডঃ শাহ আলম স্যারের এমন শ্রেষ্ঠত্বের বিষয় অনেক পরে জেনেছি। স্যার ক্লাসে বা অন্য কোথাও তা প্রকাশ করতেননা। হয়তো অভিমান ছিল, হয়তোবা ভাবতেন এই জাতি যে স্বাধীন হয়েছে এটাই তাঁর প্রাপ্তি, এটাই তাঁর বড় পরিচয়। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল স্যারের অন্য একটি কষ্টের বা আত্মত্যাগের ঠিকানা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর একমাত্র সন্তান পানিতে ডুবে মারা যান। তিনি পুরো আইন বিভাগকে নিজ সন্তান কিংবা নিজ পরিবারের মতই ভালবাসতেন । স্যারের এই কষ্ট, ব্যাথা কি আমরা কখনো বুঝতে পেরেছিলাম?

কাউকে দার্শনিক বলা বা ভাবা অনেক কঠিন। শাহ আলম স্যারের সংস্পর্শে আসা শিক্ষার্থীরা স্যারকে দার্শনিকই ভাবতেন। তার প্রত্যেকটি ক্লাসকে আমরা এক একটি সেমিনার হিসেবে চিন্তা করতাম। তিনি দেশে সর্বপ্রথম চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ক্লিনিক্যাল লিগ্যাল এডুকেশন প্রোগ্রাম চালু করেন এবং তিনিই এক্ষেত্রে অগ্রদূত (Pioneer) ছিলেন। পরবর্তীতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ও ক্লিনিক্যাল লিগ্যাল এডুকেশন কার্যক্রম শুরু করে। তাকে শিক্ষকরা শিক্ষকদের শিক্ষক বলতেন। বেহেশতি মানুষরা কোমল, মানবিক ও সরল হয়। ইসলাম ধর্মের বক্তব্য এরকমই। স্যার এমন সরল ছিলেন যিনি ছাত্রের প্রতিটি কথাকে বিশ্বাস করতেন, গুরুত্ব দিয়ে শুনতেন। স্যারের রাগ, উস্মা এই মাটি ও পরিবেশের ব্যতিক্রম ছিল।

ডঃ শাহ আলম বাংলাদেশ আইন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্য ছিলেন দীর্ঘদিন। রাশিয়ার Moscow People’s Friendship University থেকে পিএইচডি শেষে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দীর্ঘ ২৫ বছর অধ্যাপনা করেছেন। স্যার বই লিখেছেন, বিভিন্ন দেশি-বিদেশি জার্নালে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। স্যারের লিখা বই কয়েকটি হলো- সমকালীন আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক সংগঠন আইন, বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাস ও সংবিধানের সহজপাঠ, বাংলাদেশে আইনের সংস্কার ও আইন কমিশন, Enforcement of International Law by Domestic Courts, Selected Writings on International Law, Constitutional Law & Human Rights ইত্যাদি। উনি চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ জার্নাল (Chittagong University Journal of Law) এর এডিটর ছিলেন বহু বছর। বাবার স্মৃতিকথা নিয়ে স্যার লিখেছেন, ‘আমার বাবার জীবন, দর্শন ও ধর্মচিন্তা’। আইন কমিশনে একবার দেখা করতে গেলে উক্ত বইসহ ‘বাংলাদেশে আইনের সংস্কার ও আইন কমিশন’ বইটি তিনি আমাকে উপহার দেন। ‘আমার বাবার জীবন, দর্শন ও ধর্মচিন্তা’ বইয়ের একাধিক চ্যাপ্টারে স্যারের ধর্মদর্শনও প্রতিফলিত হয়েছে। একজন প্রকৃত ধর্মানুরাগী হিসেবে তিনি ধর্মের উদারনৈতিক ব্যাখ্যার কথা বলেছেন বার বার। ছাত্রজীবনে কিংবা কর্মজীবনে যেকোনো ছাত্র তাঁর কাছে আশ্রয় খুঁজে পেতো। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের প্রাক্তন, বর্তমান, ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীরা আজীবন গর্ব করে বলবে, আমাদের একজন শাহ আলম স্যার ছিলেন।

জীবিতকালে যে বিষয়টি ঢাকঢোল বাজিয়ে তিনি প্রচার করেননি, মৃত্যুর পর সেটা স্পষ্ট জানলাম। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবন শেষে আট অঙ্কের যে অবসর ভাতা, অর্থাৎ টাকা পেয়েছিলেন, তার প্রায় সবটাই কয়েক মাস আগে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ তিন–চারটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি দান করে দিয়েছেন। মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে বাকি যে কয়েক লাখ টাকা ছিল, সেটাও নাকি দান করে দিয়েছেন। ডঃ শাহদীন মালিকের লিখায় আমরা এই বিষয়ে আরো নিশ্চিত হলাম। তিনি এমন নির্ভেজাল শিক্ষানুরাগী ছিলেন যিনি মৃত্যুর আগে তাঁর সমস্ত বই চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ফ্যাকাল্টির লাইব্রেরিতে দান করে দেন।

শেক্সপিয়ার বলেছিলেন, কেউ মহত্ত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, কেউ মহত্ত্ব অর্জন করে, কারো উপর মহত্ত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়। শাহ আলম স্যার হয়তোবা জন্ম থেকেই মহৎ ছিলেন। জীবদ্দশায় স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানোর সুযোগ আমাদের ছিল, আমরা ব্যর্থ, আমরা তা পারিনি। অগনিত বিচারক, আইনজীবী, শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠিত মানুষ সৃষ্টির এই শিক্ষাগুরু চলে গেলেন নিরবে নিভৃতে। কোন এক অজ্ঞাত কারণে, কোন এক শূন্যতার অনুভবে আমার মত অনেকেই হয়তোবা কোন এক ক্ষনে স্যারের স্মরণ আসলেই আনমনে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, “স্যার, আপনাকে আমরা অনেক ভালবাসি, বড্ড বেশি ভালবাসি”।

আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী: অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, নোয়াখালী