লিগ্যাল নোটিশ
লিগ্যাল নোটিশ

পুলিশের অপরাধ তদন্তে কমিশন গঠনের দাবিতে ৫৩ আইনজীবীর লিগ্যাল নোটিশ

পুলিশের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন ‘পুলিশ অভিযোগ তদন্ত কমিশন’ (পুলিশ কমপ্লেইন্ট ইনভেস্টিগেশন কমিশন বা পিসিআইসি) গঠন করতে সরকারকে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার (১০ সেপ্টেম্বর) সকালে সুপ্রিম কোর্টের ৫৩ জন আইনজীবীর পক্ষে আইনজীবী মুহাম্মদ শিশির মনির এই লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। নোটিশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজি) বিবাদী করা হয়েছে।

নোটিশে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য ও ইতিহাস, পুলিশের গৌরবময় অর্জন ও তাদের শৃঙ্খলা বিধানের আইনি কাঠামো সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে পুলিশ সদস্যদের সংঘটিত অপরাধ ও অসদাচরণের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ৫০০টি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।

নোটিশের সঙ্গে ওই ঘটনাগুলোর ৯০৮ পৃষ্ঠা সম্বলিত একটি নথি সংযুক্তি আকারে দেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পুলিশ বাহিনীর উল্লেখযোগ্য অংশ বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে মৃত্যু, হেফাজতে নির্যাতন, গুম, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়, খুন, মারধর, হুমকি ও হয়রানি, ধর্ষণ, ইভটিজিং ও নারী নির্যাতন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও লুটপাট, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য ও ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, জমি দখল ও সম্পত্তি বিনষ্টকরণ, মাদক ব্যবসা ও উদ্ধারকৃত মাদক আত্মসাৎ, স্বেচ্ছাচারী আটক ও আটক বাণিজ্য, অপরাধীদের আশ্রয়, প্রশ্রয় ও টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া, মামলা নিতে গড়িমসি ও মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ, মিথ্যা ও পাল্টা মামলা দিয়ে হয়রানি, তদন্তে গাফিলতি, হয়রানি ও ঘুষ গ্রহণ, সাংবাদিক নির্যাতন, কর্তব্যে অবহেলা, সাক্ষ্য-প্রমাণ বিনষ্টকরণ ও আসামিদের নাম বাদ দেওয়া এবং নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতিতে দুর্নীতিসহ মোট ১৮ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে।

এছাড়াও নোটিশে বিদ্যমান আইনি কাঠামোর দুর্বলতা এবং পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন তদন্ত কমিশনের অভাবকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

নোটিশে বলা হয়েছে, বর্তমান আইনি কাঠামোতে পুলিশের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের তদন্তভার পুলিশের ওপরেই ন্যস্ত। ফলে বিচারের প্রাথমিক ধাপ ‘তদন্ত’ সঠিক ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয় না। প্রস্তাবিত পুলিশ অধ্যাদেশ ২০০৭ এর ৭১ দফায় ‘পুলিশ কমপ্লেইন্ট কমিশন’ গঠনের বিধান ছিল। কিন্তু সেই অধ্যাদেশ আজও আলোর মুখ দেখেনি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইনে পুলিশ কর্তৃক সংঘটিত অপরাধ তদন্ত করতে আলাদা কর্তৃপক্ষ/কমিশন গঠনের জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান, কেনিয়া, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, গ্রিস, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, ফিনল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, হাঙ্গেরি, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস ও মাল্টাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই স্বাধীন ও স্বতন্ত্র তদন্ত কমিশন কার্যকর আছে। ২০০৬ সালে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট বিখ্যাত প্রকাশ সিং বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া মামলায় পুলিশ ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য সাত দফা নির্দেশনা প্রদান করেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল একজন বিচারপতির নেতৃত্বে ‘পুলিশ কমপ্লেইন্ট  অথরিটি’ গঠন। নির্দেশনা মেনে ইতোমধ্যে ২৭টি অঙ্গরাজ্যে ‘পুলিশ কমপ্লেইন্ট  অথরিটি’ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এ ধরনের কমিশন বা কর্তৃপক্ষ গঠনের কোনও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়নি।

ক্ষেত্রবিশেষে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার, পুলিশ রিমান্ড ও পুলিশের পেশাদারিত্বের উন্নয়নে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। সুষ্ঠু তদন্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫ (৩) ও ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ব্যক্তির মৌলিক অধিকার।

তাই নাগরিকদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নোটিশ প্রাপ্তির চার সপ্তাহের মধ্যে একটি স্বাধীন ‘পুলিশ অভিযোগ তদন্ত কমিশন’ (পুলিশ কমপ্লেইন্ট ইনভেস্টিগেশন কমিশন বা পিসিআইসি) গঠন করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। অন্যথায় নোটিশদাতারা উচ্চ আদালতে যাবেন বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে কমিশন গঠনের পক্ষে ৫৩ আইনজীবীদের একজন আসাদ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপকর্মে জড়ানোর অভিযোগ বরাবরই রয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশের থানা ও ইউনিটগুলোতে কঠোর নজরদারি সত্ত্বেও পুলিশের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। আবার এটাও ঠিক যে কোনো কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অপকর্মের অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত হচ্ছে। বদলি, প্রত্যাহার বা সাময়িক বরখাস্তের মতো ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে কিন্তু পুলিশের অপরাধ বন্ধ হচ্ছে না।’

আইনজীবী বলেন, ‘এর কারণ পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলেই সেটি তদন্তের দায়িত্ব পুলিশের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার ওপর বর্তায়। তখন সেই তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এজন্য কমিশন গঠন করতে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছি।’