অ্যাডভোকেট মিঠুন বিশ্বাস

হাজারো তরুণ শিক্ষানবিশ আইনজীবীর নীরব কান্না: দায় কার?

মিঠুন বিশ্বাস: বিশ্বে যে কয়টি পেশা মানব জীবনকে স্পর্শ করে, প্রভাবিত করে তার মধ্যে অন্যতম আইনপেশা। সেকারণেই আইনপেশা বিশ্বের সব সমাজেই ঐতিহাসিকভাবে এক অনন্য মর্যাদা লাভ করেছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মহত্মা গান্ধী, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী সফল আন্দোলনের রূপকার নেলসন ম্যান্ডেলা, স্বাধীন বাংলাদেশ রাস্ট্রের স্থপতি, বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – এঁরা সবাই ছিলেন আইনজীবী। শুধুমাত্র প্রকৃত অপরাধী চিহ্নিত করতে বিচারককে সহায়তাই নয়- বঞ্চিত অসহায় মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামেও আইনজীবীদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার বহু গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে বিশ্বে।সেকারণেই আইনজীবীদের সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়।

পেশা হিসেবে অনন্য হওয়ার কারণে অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও আজও সন্তানকে ভবিষ্যতে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানানোর পাশাপাশি একজন আইনজীবী বানানোর স্বপ্নও দেখেনবহু মা বাবা।তাইআইন পেশা এখনো বহু তরুণ-তরুণীর স্বপ্নের পেশা।তবে এই পেশায় প্রবেশের পথ মোটেই মসৃণ নয়। আইন শাস্ত্রে পড়াশোনা শেষ করলেই যে কেউ আইনজীবী হিসেবে স্বীকৃতি পান না। পরিপূর্ণ আইনজীবী হিসেবে মর্যাদা পেতে, আদালতে মামলা পরিচালনার অনুমতি পেতে জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ইতালি, জাপান, সিঙ্গাপুর, স্পেন এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপালেও আইন শাস্ত্রে একাডেমিক পড়াশোনা সম্পন্ন একজন ব্যক্তিকে একটি পৃথক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয় যেটি বার এক্সামিনেশন নামে সর্বত্র পরিচিত। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কেবল কেউ আইনকে পেশা হিসেবে নিয়ে আদালতে মামলা পরিচালনা করতে পারেন। আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাধ্যমে অনেক দেশে এসব পরীক্ষা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হলেও আমাদের দেশের চিত্র ভিন্ন। আমাদের দেশে শুধু যে তালিকাভুক্তি পরীক্ষা অনিয়মিতভাবে হয় তা নয় – এদেশে আইন পেশায় প্রবেশের কোন বয়সও নির্ধারিত নেই। একজন ব্যক্তি জীবনসায়াহ্নে এসেও এ পেশায় প্রবেশ করতে পারেন। অর্থাৎ আইনজীবী তালিকাভুক্তি পরীক্ষায় একজন পিতা ও সন্তানের একসাথে অংশ নেয়ারও সুযোগ আছে। এই অসম প্রতিযোগীতা অন্য কোন পেশায় আছে কিনা সন্দেহ আছে। অসম বলার কারণ হল, একজন পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তি ও পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের সদ্য শিক্ষা জীবন শেষ করা একজন তরুণ বা তরুণীর কাছে জীবন এক রকম নয়। তাঁদের দুজনের মনস্তত্ত্বও ভিন্ন। পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তিটি জীবনের নানা বাঁক দেখেছেন-ছুঁয়েছেন সফলতা কিংবা আলিঙ্গন করেছেন ব্যর্থতাকে। জীবনের কোন এই সময়ে একটি আইনের ডিগ্রি নেয়া ব্যক্তিটির কাছে এই বয়সে আইনজীবী হতে পারা একধরণের ‘প্রিভিলেজ’ ।

কিন্তু নিজের মেধা দিয়েআইনজীবী হিসেবে জীবনকে গড়ে তোলার, নিজের পায়ে দাঁড়াবার স্বপ্ন নিয়ে যে তরুণটি দীর্ঘ সময় ধরে আইন শাস্ত্রে পড়াশোনা করে ডিগ্রি নিয়েছেন তাঁর কাছে আইনজীবী সনদটি কেবলই সুযোগ নয় বরং অধিকার। কারণ রাস্ট্রই তাঁকে সেই স্বপ্ন দেখিয়েছে। তাই মেধা,যোগ্যতা দিয়ে সে যেন তাঁর লালিত স্বপ্নকে পূর্ণতা দিতে পারেতার নিশ্চয়তা দেয়া রাস্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে তালিকাভুক্তি পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে আইন শাস্ত্রে ডিগ্রি নেয়া একজন তরুণকে শুরুতেই মানসিকভাবে ধাক্কা খেতে হয় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। অনিয়মিত পরীক্ষা আয়োজনের এই ধারা চলে আসছে ২০১২ সাল থেকে। ফলে এক ধরণের জট সৃষ্টি হয়েছে আইন পেশায়। বর্তমানে অন্তত ৫০ হাজার আইন শিক্ষার্থী আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে অপেক্ষা করছে পরবর্তী তালিকাভুক্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে যাঁদের অনেকেই তরুণ। অনেকের অভিযোগ, আইনজীবী তালিকাভুক্তি পরীক্ষার ব্যাপারে পরীক্ষার্থীরা যতটা উদগ্রীব নিয়ন্ত্রক সংস্থা বার কাউন্সিল ঠিক ততোটাই উদাসীন। প্রকৃত পক্ষে এই অবস্থার জন্য কি কেবল বার কাউন্সিলই দায়ী? অন্য কারো কি কোন দায় নেই?

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে যে গতিতে আইন শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে, সে তুলনায় বার কাউন্সিলের সক্ষমতা কি বাড়ানো হয়েছে? যে দেশে স্বাধীনতার ৫০ বছরে মোট ৫৫-৬০ হাজার আইনজীবী আইন পেশায় যুক্ত আছেন সে দেশেই এক সঙ্গে আরো ৫০ হাজার শিক্ষার্থীএই পেশায় যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছেন- এটা কি অস্বাভাবিক নয়? এই দায় কি শুধুই বার কাউন্সিলের?

১৯৭২ সালের আইনে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাকে এক সঙ্গে এত বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থীর নিয়মিত পরীক্ষা নেয়ার মত সক্ষম করে কি তৈরি করা হয়েছে কি? যে ১৫ জন সদস্য নিয়ে বার কাউন্সিল গঠিত হয় তাঁদের মধ্যে একজন হলেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বা এটর্নী জেনারেল যিনি এই সংস্থার সভাপতি। তাঁর পক্ষে রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তার অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পর বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্তি পরীক্ষা আয়োজনে কার্যকর ভূমিকা রাখা বাস্তবিকভাবেই কি সম্ভব? সংস্থায় অন্য যে ১৪ জন নির্বাচিত সদস্য রয়েছেন তাঁরা প্রত্যেকেই দেশের প্রথিতযশা সিনিয়র বিজ্ঞ আইনজীবী। সারাদেশের বিজ্ঞ আইনজীবীদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে তিন বছরের জন্য তাঁরা বার কাউন্সিলের দায়িত্ব নেন। পেশা জীবনে অত্যন্ত সফল ও ব্যস্ত এসব প্রাজ্ঞ সিনিয়রের পক্ষে বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য নিয়মিত পরীক্ষা আয়োজনের মত রুটিন কাজ করা দুঃসাধ্য নয় কি? বার কাউন্সিলের একমাত্র ফুলটাইম অফিসার হলেন জেলা ও দায়রা জজ সমমানের একজন সচিব যিনি সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হন। আসলে বিদ্যমান এই লোকবলে এত বিশাল সংখ্যক পরীক্ষার্থীর নিয়মিত পরীক্ষা আয়োজনের সক্ষমতা বার কাউন্সিলের নেই যেখানে পরীক্ষা আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় হল বা স্থান প্রাপ্তির জন্যও অন্য প্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষী হতে হয় বার কাউন্সিলকে। তাই বিদ্যমান নির্বাচিত প্রতিনিধি কাঠামো ঠিক রেখে বার কাউন্সিলের জনবল বৃদ্ধি করে প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতা বাড়ানো উচিত। অন্যথায় আইন পেশায় প্রবেশের স্বপ্নে বিভোর হাজারো তরুণের স্বপ্নভঙ্গের জন্য শুধুমাত্র বার কাউন্সিলকে দায়ী করে মূল সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়া হবে কেবল- সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবেনা।

দেশে বর্তমানে প্রায় ৩৫-৪০ লাখ মামলা বিচারাধীন। লক্ষ লক্ষ বিচার প্রার্থী মানুষ ন্যায় বিচারের আশায় দিনের পর দিন নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। ১৮ কোটি মানুষের দেশে নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালত মিলিয়ে মোট বিচারক মাত্র দুই হাজারের কাছাকাছি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশে থানার সংখ্যা বাড়লেও তুলনামূলকভাবে বাড়ছেনা আদালত। অন্যদিকে তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নতুন নতুন অপরাধ। এসব অপরাধ দমনে প্রণীত হচ্ছে নতুন আইন। অন্যদিকে যে বিশাল সংখ্যক মামলা অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে সে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হলে নতুন পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। আদালত বসানোর জন্য তৈরি করতে হবে নতুন অবকাঠামো। এই বিশাল সংখ্যক অনিষ্পন্ন মামলা নিষ্পত্তিতে প্রয়োজন হবে নতুন আইনজীবীর। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাষ্ট্রের যে সাংবিধানিক অঙ্গীকার তা পূরণের স্বার্থেই পর্যাপ্ত নতুন বিচারক নিয়োগ দিয়ে, আদালতের ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত করে সম্ভাবনাময় মেধাবী তরুণ-তরুণীদের আইন পেশায় আকৃষ্ট করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে জনগণের কাছে উন্নয়নের সুফল পৌছে দিতে হলে অবশ্যই সব নাগরিকের ন্যায় বিচার প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে- প্রতিষ্ঠা করতে হবে আইনের শাসন। এজন্য বিচার বিভাগে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন জরুরি ।

আইনপেশা একটি স্বাধীন পেশা। এই পেশায় যুক্তদের জন্য রাষ্ট্রকে কোন অর্থ ব্যয় করতে হয়না। বরং আইনজীবীরাই রাষ্ট্রকে কর দিয়ে সহায়তা করেন। নতুন আইনজীবীরা কোনভাবেই রাষ্ট্রের বোঝা হবেন না। যাঁরা সত্যিকারের মেধাবী তাঁরাই এ পেশায় টিকে থাকেন শেষ পর্যন্ত। তাই আইন শাস্ত্রে শিক্ষা সমাপ্ত দেশের হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর দীর্ঘশ্বাসের দ্রুত অবসান হোক। নিজের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকুক সবাই।

মিঠুন বিশ্বাস: আইনজীবী; ই-মেইল: adv.mithunbiswascdba@gmail.com