মনিরা নাজমী জাহান: শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

শুধুমাত্র শাস্তি দ্বারা কি শিশুধর্ষণ নির্মূল সম্ভব?

মনিরা নাজমী জাহান: শিশু ধর্ষণ সভ্য সমাজের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। আজকের দিনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে যখন সভ্যতা সমৃদ্ধ হচ্ছে।যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই যেই শাখায় মানুষ উন্নতি করছে না, ঠিক সেই সময়েও শিশু ধর্ষণের মত ভয়াবহ কলঙ্কিত ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলছে। এমন একটি দিন পাওয়া যাবে না যেদিন পত্রিকার পাতায় শিশু ধর্ষণের মত ঘটনা আমাদের চোখে পড়ে না। একটি জাতি কতটা বিকারগ্রস্থ হলে সেই জাতিতে শিশু ধর্ষণ নিত্য দিনের ঘটনায় পরিনত হয়! একটি শিশুকেও নিরাপদে বেড়ে ওঠার পরিবেশ আমরা দিতে পারছি না। সর্বদা এক আতংকিত পরিবেশে তাকে বড় হতে হচ্ছে, জাতি হিসেবে এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আমাদের আর কি হতে পারে?

যে প্রশ্নটি এখন সর্বত্র দেখা দিয়েছে তা হল একটি শিশু আসলে কোথায় নিরাপদ? খেলার মাঠ, বিদ্যালয়, ধর্মীয় উপাসনালয় তো বটেই এমনকি নিজের নিকট আত্মীয় স্বজনের কাছেও নিরাপদ নয় একটি শিশুও। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ গড় আয়ু বৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়সহ সামাজিক বিভিন্ন সূচকে উন্নতি করেছে। বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণ ঘটেছে। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে এখন তার শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়নি। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী আগস্ট মাস পর্যন্ত দেশে ধর্ষণের বীভৎস শিকার হয়েছে ৩২৪ জন শিশু।

কি বীভৎস সমাজের এই রূপ! এই করোনার মহামারিতেও ধর্ষকের করাল থাবা থেকে সুরক্ষিত ছিল না আমদের দেশের শিশুরা। যে সময় মানুষ করোনার সাথে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করেছে সেই সময়েও বীভৎসতা শিকার হয়েছে শিশুরা। কেন ঘটছে এই বীভৎসতা? বাংলাদেশের কি আইনে যথাযথ শাস্তির বিধান নেই? নাকি আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটছে না? আসুন বিষয়গুলোতে আলোকপাতের চেষ্টা করি।

যদি আইনের দিকে তাকাই তবে দেখবো, ১৮৬০ সালের পেনাল কোডে ধর্ষণকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং ধর্ষণকারীদের শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে ।এছাড়াও, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ -এর ৯নং ধারায় ধর্ষণকারীদের শাস্তি বর্ণনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি যদি নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে তাকে জরিমানা সহ যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে কোনও পুরুষ যদি ষোল বছরের কম বয়সী কোনও মহিলার সাথে তার সম্মতি সহ অথবা সম্মতি ছাড়া যে কোন উপায়েই যৌনকার্জে লিপ্ত হয় তবে তাকে ধর্ষণ হিসাবে গণ্য করা হবে।

এখানে আরও উল্লেখ্য যে, ধর্ষণের ফলে বা ধর্ষণ পরবর্তী কোন কাজের ফলে যদি কোন মহিলা বা শিশু মারা যায়, তবে ধর্ষক অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা জরিমানা সহ  মৃত্যুদণ্ড বা সশ্রম যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

গণধর্ষণের বিষয়ে বলা হয়েছে, যদি একজন মহিলা বা শিশু একাধিক ধর্ষক দ্বারা ধর্ষিত হয় এবং ধর্ষণের ফলে মহিলা বা শিশুটি মারা যায় বা আহত হয়, তবে এই ধর্ষক দলের প্রত্যেক সদস্যকে অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা জরিমানা সহ মৃত্যুদণ্ড বা সশ্রমযাবজ্জীবন কারাদন্ডে দণ্ডিত করা হবে।

সুতরাং, এটি বলা যেতে পারে যে শিশু ধর্ষণের ন্যূনতম শাস্তি হল জরিমানা সহ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর শাস্তির ক্ষেত্রে এই কঠোর বিধান করা হয়েছে কারন যাতে সমাজের মানুষ এই শাস্তির ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে এই জঘন্য অপরাধ থেকে নিজেকে বিরত রাখে।

কাজেই যখনই কোনও শিশু ধর্ষক শাস্তি পায় তখন আমরা এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করি , আমরা ভাবি যে সমাজ একটি মানুষ রুপী দানব থেকে মুক্তি পেল। কিন্তু বিষয়টি কি আসলেই তাই?

আসুন গাইবান্ধার চতুর্থ শ্রেণির সাদিয়া সুলতানা ত্রিশার ভয়াবহ ঘটনাটির দিকে আলোকপাত করি। ২০০২ সালের ১৭ জুলাই গাইবান্ধা মধ্যপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী সাদিয়া সুলতানা তৃষাকে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে মর্ডানসহ ৩ বখাটে  ধাওয়া করে। এ সময় পুকুরে ডুবে তৃষা মারা যায়।পরবর্তীতে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ হত্যার অভিযোগে মর্ডানসহ জড়িত ৩ জনের ১৪বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দণ্ডিত করেছিল।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, জেল থেকে সাজা খেটে বের হবার পর গাইবান্ধার ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীকে স্কুলে যাওয়ার পথে অপহরণ করে সেই মর্ডানসহ কয়েক বখাটে। এরপর তারা বাদিয়াখালীর একটি কম্পিউটারের দোকানের পেছনে নিয়ে তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে।

এখন সহজাত ভাবেই যে প্রশ্নগুলো মানুষের মনে উত্থাপিত হয় তা হল,কেন সাজা খাটার পর ও একজন মানুষ পরিবর্তিত হচ্ছে না ? আমাদের আইন ও শাস্তির বিধানগুলি কোনও অপরাধীকে একই অপরাধ পুনরাবৃত্তি করা থেকে বিরত রাখতে যথেষ্ট কিনা?, সংস্কারমূলক পদ্ধতির যথাযথ প্রয়োগ করা হচ্ছে কিনা?

আমরা প্রায়শই পেডোফিলিয়া শব্দটি ব্যবহার করি।পেডোফিলিয়া বা শিশুদের প্রতি যৌন আকর্ষণ একটি মানসিক রোগ যার ফলে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক, শিশু ও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের উপর যৌন আকর্ষণ বোধ করে।পেডোফিলিয়াকে ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকাল ম্যানুয়াল অফ মেন্টাল ডিসঅর্ডার (ডিএসএম -5) এ পেডোফিলিক ডিসঅর্ডার বলা হয় এবং এটিকে তীব্র এবং পুনরাবৃত্ত যৌন আহ্বানের সাথে জড়িত এমন একটি প্যারাফিলিয়া হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। পেডোফিলিয়া শব্দটি প্রায়শই বাচ্চাদের প্রতি যে কোনও যৌন আগ্রহ বা শিশু যৌন নির্যাতনের প্রচেষ্টায় প্রয়োগ হয়।

সহজ  কথায় একটি পেডোফাইল এমনই এক ব্যক্তি যার যৌন কল্পনাগুলি কেবল বাচ্চাদের বেলাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।

সুতরাং, এই কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়  শিশুধর্ষণকারীরা এক ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। এজন্য কঠোর ও উপযুক্ত শাস্তির পাশাপাশি ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাও এই ধরণের অপরাধীদের মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা উচিত। মালদ্বীপের ২০০৯ সালে শিশু যৌন নির্যাতন প্রতিরোধের যে বিশেষ বিধান রয়েছে তাতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে,কঠোর শাস্তি প্রদানের পরেও রাষ্ট্র শিশু নির্যাতনকারীকে কঠোর নজরদারিতে রাখবে।

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আজ যে শিশুটি রয়েছে আগামী দিনে সে সমাজের কোন না কোন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিবে। ভবিষ্যতের সঠিক নেতৃত্ব তৈরির লক্ষ্যে এই শিশুদের জন্য নিরাপদ ও বসবাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলা রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য। তাই শিশুধর্ষণকারীর বিষয়ে বিন্দুমাত্র ছাড়ের সুযোগ নেই। অবশ্যই শিশু ধর্ষণকারীর কঠোর থেকে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ঠিক তেমনি শিশু ধর্ষণের ঘটনা বন্ধ করতে শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি এখন সংস্কারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সময় এসেছে।

মনিরা নাজমী জাহান: শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।